বুমেরাং

রেস্টুরেন্ট এর আলোগুলো চেক করছেন জাভেদ সাহেব। বেছে বেছে আলো বেশি এবং প্রসরিত জায়গায় সিটিং টেবিল চ্যুজ করলেন। আজ একমাত্র মেয়ে জানভির দেখাদেখি আছে। স্বপ্ন দেখতেন মেয়েকে কেউ এক দেখায় পছন্দ করবে। কিন্তু সব ছেলেরা তো আর বাবার চোখ দিয়ে তার মেয়েকে দেখছে না।

জানভি দেখতে ভাল। বোঁচা আর সরু নাকের মাঝামাঝি নাক। মায়ের পুরো চেহারা পেলে চোখে পড়া সুন্দরীই বলা যেত। কিন্তু বাবা আর মায়ের মিশেলে চেহারা পেয়েছে জানভি। উচ্চতা নিয়ে ভয় নেই।

যেকোন চাহিদার পাত্রদের উচ্চতায় চুপ করিয়ে রাখবে। কারণ উচ্চতা ৫’৪”। গায়ের রঙটা বাবার দিকে ঝুঁকেছে। জানভির মা কেয়া পুরোদস্তুর সুন্দরী। তার প্রমান দুটো বিয়ে বাড়িতে মা কে দেখে তার মেয়ে আছে, তার মতই সুন্দর হবে এই ভাবনায় প্রস্তাব এসেছে। সেই প্রস্তাবেই আজ দেখা সাক্ষাৎ।

জাভেদের বুক ধড়ফড় করছে অনেকগুলো কারনে।
যদি মেয়েকে দেখে পছন্দ না হয়?

যদি বলে মেয়ে যেমন সুন্দর হবে ভেবেছিলাম সেরকম সুন্দর না।

যদি বলে মেয়ের সাথে কথা বলে ভাল লাগেনি,
যদি বলে মেয়ের গায়ের রঙ তার মায়ের মত সাদা চিকচিকে ফর্সা না তাই। কারণ তারা ফর্সা মেয়ে খুঁজছে।

বুকের ভেতর হাজারো আশংকা, মানসিক চাপকে বাইরে বের হতে দিচ্ছেন না মন্ত্রনালয়ের বড় স্যার। কিন্তু সব কিছুর পরে মেয়ের বাবাদের বুকের ভেতরই এরকম চাপ তৈরি হয়। নিজের মা, স্ত্রীর পরে পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর নারী হয় একজন বাবার কাছে তার কন্যা সন্তান। ঠিক রুপকথার রাজকন্যা।

জাভেদ সাহেবের কাছেও তাই। কন্যার চাপা রঙ, টিংটিঙে শারীরিক গড়ন কোনকিছুই বাবার চোখে খারাপ লাগে না। কিন্তু ২২ বছরের মেয়েটিকে আজ যখন রেস্টুরেন্ট এর আলোয় পাত্রের চোখে দেখার চেষ্টা করছেন তখন প্রথমেই প্রশ্ন উঠল গায়ের রঙ নিয়ে! এত এত শিক্ষাদীক্ষা, ধর্ম কর্ম নৈতিকতাবোধ সব রেখে মেয়ের চাপা রঙের দিকে চোখ পড়ছে। মুহূর্ত গুলো অসহায় থেকে অসহায়তর হয়ে উঠছে।

একটু আসছি বলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন জাভেদ সাহেব। খারাপ লাগলে, দুশিন্তা হলে শুধু চোখে মুখে পানির ঝাপটার পরিবর্তে ওজু করে নেন। ওজুতে অনেক প্রশান্তি আছে। ওজু শেষ করেছেন। দাড়ি থেকে টপটপ পানি পড়ছে। সামনের আয়না দিয়ে নিজেকে দেখছেন। পানির ঢেউয়ের মত আয়নার মধ্যে কেমন একটা ঢেউ খেলে গেল। জাভেদ সাহেব ফিরে গেছেন নিজের সময়ে।

মায়ের সামনে বসে আছে সদ্য বিসিএস এ চান্স পাওয়া জাভেদ। মা তো ছেলের জন্য একশ তে একশ পাবে এমন মেয়ে চাই। ছেলে মানেই সোনার টুকরা। সেখানে এত যোগ্যতা যে ছেলের তাকে আর কি বলা যায়। জাভেদ বিয়েটাকে সহজ করতে চাইছেন।

যেকোন ভদ্র পরিবারের মেয়ে হলেই হবে কিন্তু তার কথা আমি যেহেতু শ্যামলা তাই আমি ফর্সা মেয়েই বিয়ে করতে চাই। এই এক কথাতেই অনড়। এমন না যে, শ্যামলা, কালোদের সে অবজ্ঞা করছে। কিন্তু তার যুক্তি, দুজনেরই যদি রঙ চাপা হয় তাহলে তো সন্তান ও চাপা রঙ পাবে। মায়ের কথা তো তাই। বউ মানেই লাল শাড়ীতে ঘোমটা টানা ফর্সা টুকটুকে মিষ্টি চেহারার বউ।

এটা না ওটা না। সেটা না। অবশেষে কেয়াদের বাড়িতে কেয়ার মুখোমুখি তরুন জাভেদ। কেয়ার সাথে দেখা হওয়ার আগে কেয়ার বাবার সাথে অনেকক্ষণ কথা হল।

কেয়ার বাবা খুব নমনীয় হয়ে বললেন, “দেখ বাবা আমার মেয়েটা মাশাআল্লাহ দেখতে ভাল এটা দশজনেই বলে। কিন্তু এই যে সুন্দর রঙ চেহারা সেটা কতদিন থাকবে তার নিশ্চয়তা আমি দিতে পারব না।

আর তুমি আমার মেয়ে সুন্দর শুধু এটা দেখে আমার মেয়েকে বিয়ে কর তা চাই না। কারণ বাবা হিসেবে বলব আমার মেয়ের কাছে তার বাহ্যিক সৌন্দর্য ছাড়াও দামি কিছু আছে। কারণ বাবা হিসেবে মেয়ের চারিত্রিক বিষয়ের কিছু নিশ্চয়তা আমি দিতে পারব।

আর সম্পদ হিসেবে তুমি সেগুলো সারাজীবনের জন্যই পাবে”। শশুরবাবার কথাগুলো সাধারণ কথার মতই লেগেছিল তরুন জাভেদের কাছে। কি সম্পদ সে পেতে যাচ্ছে এটা সে ঐ সময় বিবাহের পাত্র হিসেবে উপলব্ধিই করেনি।

কেয়াকে জাভেদের খুব পছন্দ হয়, বিয়ে হয় দুজনের। তাদের সন্তান জানভি। ঐ দেখাদেখির একদিনই কেমন জহুরীর মত কেয়ার গায়ের রঙ পরখ করেছিল। বিয়ের প্রথম রাতে কত কি মানুষ বলে বউকে। কিন্তু জাভেদ কোনদিন বলে নি কি সুন্দর তোমার গায়ের রঙ।

কারণ কেয়ার মন মানসিকতা গুনাবলীর কাছে সেই দেনমোহরের দরদেনার সময়েই বাহ্যিক সৌন্দর্য ফিকে হয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল তার বুদ্ধিমত্তা, ব্যক্তিত্ব। জাভেদকে টাকার অংকের কোন চাপে পড়তেই দেয়নি।

এক্সকিউজ মি, অনেকক্ষণ ধরে আপনি পানির কলটা ছেড়ে রেখেছেন। অপরিচিত কণ্ঠের আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেলেন জানভির বাবা অরফে জাভেদ সাহেব। আয়নায় আজ নিজেকে অনেক বেশি বুড়ো লাগছে।

বুকের ভেতর কত কত কথা লুটোপুটি খাচ্ছে। নিজের পাত্রী দেখার অনুভূতি আর বিয়ের পরের উপলব্ধি শেয়ার করতে চাইছেন বিবাহইচ্ছুক সব ছেলেদের। বিশেষ করে আজ যে তার মেয়েকে দেখতে আসবে তাকে বলতে চাইছেন। কিন্তু তিনি তো মেয়ের বাবা।

তাই আর যাকেই বলেন এই পাত্রকে কোন নসিহা করতে পারবেন না। আয়নায় নিজেকে বুড়ো দেখালেও সেখানে অসহায়ত্বের ছাপ খুঁজে পাচ্ছেন না। পজিটিভ থাকা এই মানুষটা জানেন তার কি করতে হবে।

নিজের মেয়ের আজ যা হয় হবে। কিন্তু ছেলের বউ খোঁজার ক্ষেত্রে এই সাদা ফর্সার কোন শর্ত তিনি রাখবেন না এবং ছেলেকেও বোঝাবেন নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। শুধু ছেলে? বোনের ছেলে, ভাইয়ের ছেলে, বন্ধুর ছেলে, মসজিদে দেখা হয় যারা তাদের ছেলে, যাদেরকে পাবেন সবাইকে বোঝাবেন।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে যে বুক ভার করা, নাভিশ্বাস ওঠা যন্ত্রনাময় অনুভুতির ভেতর দিয়ে গিয়েছেন তা আর কোন বাবা কে স্পর্শ না করুক, এটাই দোয়া।

বুমেরাং
কাজী দিশা

সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৯ইং