ভালোর জন্যই!

১.
“হুজুর আমার ছেলে কথা শোনে না”
কী হাহাকার জড়ানো কন্ঠ! হুজুরের ভ্রুক্ষেপ নেই তবু। চোখ বন্ধ করে আছেন।

খোদেজা বেগম আবার বললেন, “হুজুর ছেলে আমার কোনো কথা শোনে না!”

“কার কথা শোনে?” হুজুরের চোখ এখনও বন্ধ।

খোদেজা বেগম সব খুলে বললেন। বড় কষ্টের কথা। লজ্জারও বটে! এত বছর খাইয়ে পরিয়ে বড় করা ছেলে শুধু তার বউ আর শাশুড়ির কথা শোনে।
হুজুরের কাছে টাকা ঢেলে এর আগে কেউ ব্যর্থ হয়নি। খোদেজা বেগম এর আগেও এসেছিলেন। ছেলে এক মেয়ের প্রেমে পড়ে গেল। মেয়ের না আছে রূপ, না আছে বংশ।

হুজুর বলল মেয়ে জাদু টোনা করেছে। ছেলে এজন্য বিড়ালের মত ঘুরছে মেয়ের পিছে পিছে। কীভাবে জাদু কার্যকর করেছে তা মুখে আনার যোগ্য না। অমন ঘটনা শুনে মা হিসেবে মুখ থেকে শুধু অভিশাপই এসেছে খোদেজা বেগমের। এত ভাল ছেলেকে ঐ ফকিন্নির মেয়ে এভাবে ফাঁদে ফেলেছে!

খোদেজা বেগম সামর্থ্য অনুযায়ী খরচ করেছেন। একটাই ছেলে তার। অনেক সাধনার পর ছেলে পেয়েছিলেন। তখন দরবারে এই হুজুর ছিল না, এই হুজুরের মামা ছিলেন। তার ওষুধ পথ্য খেয়ে তাবিজ ঝুলিয়ে খোদেজা বেগমের তিন তিনটা মেয়ের পর কোল আলো করে রাশেদ এল।

এই রাশেদ যখন চালচুলোহীন মেয়ের প্রেমে পড়ল, খোদেজা ছুটে এলেন হুজুরের কাছে। হুজুরের নাম যশ এমনি এমনি হয়নি। ঐ মেয়ের সাথে সম্পর্ক ভেংগে গেছে এক মাসের মাথায়। এরপর খোদেজাই দেখে শুনে ভাল বংশের সুন্দরী মেয়েকে বউ করে এনেছেন। সৌন্দর্য আর কয়দিন। তবে বংশ একটু না দেখলে বিপদ। তিন মেয়েকে পার করতে যা খরচ হয়েছে তা সুদে আসলে ফেরত আসা চাই নিজ বাড়িতে। এসেছেও তাই।

মেয়ের গা আগাগোড়া গয়নায় মুড়িয়ে দিয়েছে বাবার বাড়ি থেকে। খোদেজার জা তো বলেই বসল মেয়ের চেহারা তো দেখি না, সব তো গয়না! হ্যাঁ রে রাশেদ তোর বউ কে চিনব কেমন করে?

কী যে অদ্ভুত এক তৃপ্তি! বলে বোঝানো যাবে না। অবশ্য জা কথাটা বলেছে হিংসা থেকে। তাতে কী যায় আসে!

গয়না, ফার্নিচার সবকিছুতে খোদেজা বেগম খুশি। মেয়ের মা বাবা বেশ শিক্ষিত। শিক্ষিত লোকজন আজকাল মেয়েকে মাগনা পার করে দিতে চায়। গিফটকেও যৌতুক মনে করে। কিন্তু এরা ব্যতিক্রম। কার্পণ্য করেননি কোনো কিছুতেই।

প্রথম কয়েকটা মাস খোদেজা ব্যস্ত ছিলেন আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশী নিয়ে। মেয়ের বাড়ি থেকে কী কী এসেছে দেখানো চাই। পিলপিল করে বাড়িতে মানুষ আসে, খোদেজা বেগম আসবাব দেখান। ফ্রিজটা অত বড় দেয়নি। খোদেজাই না করেছিল। জায়গা আঁটানো মুশকিল। আলমারিটা দেখার মত। ওটা রাশেদের ঘরে। অনিমা দুপুরে খেয়ে দরজা লাগিয়ে ঘুমায়।

পাশের বাড়ির সেলিমের মাকে আর যাই হোক আলমারিটা দেখাতেই হবে। সেলিমের বিয়ের পর সে দুইবার খোদেজাকে নিজ বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল খাট পালঙ দেখাতে। দুপুরে সেলিমের মা আসলেন। অনিমা তো বেঘোরে ঘুম। খোদেজা বেগম তখন মা মা করে ঘুম ভাংগিয়ে সেলিমের মা কে নিয়ে রাশেদ অনিমার ঘরে ঢুকলেন। খাট, ড্রেসিং টেবিল, আলমারি দেখানোর এক ফাঁকে আলমারির পাল্লাটা খুলেছেন শুধু, অমনি অনিমার চিৎকার! মা আপনি আমার আলমারি খুলছেন কেন!

কী অপমান! পাল্লা না খুললে বাইরে থেকে আলমারি বোঝা যায়? খোদেজার মুখটা ছোট হয়ে গিয়েছিল। সেলিমের মা যাওয়ার আগে বলে গেছে মেয়ের বাপের টাকা পয়সাই দেখেছেন শুধু? মেয়ের আদব লেহাজ দেখেন নি?

ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। রাশেদের কাছে নালিশ পৌঁছে গেছে অফিস থেকে ফিরতে না ফিরতেই। রাতে বাড়ি ফিরে রাশেদ বিচার করল। আসামী খোদেজা বেগম।

সেই থেকে শুরু। ছেলে তার মা কে চেনে না। বউ যা বলে সেটাই সত্য! সাথে আছে শিক্ষিত শাশুড়ি। এদের ভীড়ে খোদেজা বেগম বড় একা! বড় অসহায়!

২.
অনিমার মা ভীষণ রেগে গেছেন। শৈলী যেন আর বাড়িতে না আসে এ কথা মেয়ের ঘরে এসে তিনবার বলে গেছেন।

অনিমা বুঝতে পারছে না কী করা উচিত। অনিমার মা সবসময় বলেন, বিয়ের পর একটা মেয়ে অথৈ সাগরে গিয়ে পড়ে। শাশুড়ি তার ছেলেকে আগলে রাখতে চায় যক্ষের ধনের মত। ননদিনী থাকলে তো কথাই নেই। আর জা তো সাক্ষাৎ শত্রু। এর মাঝে মেয়েকে একটু আধটু কৌশলী হতে হয়। চারদিকে এত বৈরীতা এত ঝুট ঝামেলায় স্বামীর মন পাওয়া চাট্টিখানি কথা না।

আজ শৈলী এসেছিল অনিমার সাথে দেখা করতে। শৈলি অনিমার স্কুল ফ্রেন্ড। মেয়েটা হিজাব ধরেছে বেশিদিন হয় নি। দেখলেই মনটা ভরে যায় সেলিনা হোসেনের। তিনিও বাইরে গেলে মাথায় কাপড় দিয়ে বের হন। মেয়েকে অনেকবার বলেছেন একা বের হলে একটু পর্দা করে বের হবি। মেয়ে শোনে না। অথচ শৈলী মা শা আল্লাহ কী শালীনভাবে চলে! অনিমার বিয়েতেও এসেছিল পর্দা করে।

এই মেয়েকে নিরাপদ ভেবেই তিনি চিনি পড়ার কথা তুলেছিলেন। এক হুজুরের থেকে মেয়ের জামাইয়ের জন্য চিনি পড়া এনেছিলেন। কিন্তু ঠিকঠাক যেন কাজ হচ্ছে না। অনিমার শাশুড়ি বড্ড বেশি নাটক জানে। তার ছোট্ট মেয়েটা ঐ বাড়িতে গিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। মেয়ে, মেয়ে জামাইয়ের ভালোর জন্যই তিনি চিনি পড়ার ব্যবস্থা করেছেন। প্রথম প্রথম বেশ ভাল কাজও হচ্ছিল। রাশেদ অনিমাকে চোখে হারাতো। এখন হুট করে যেন তাল কেটে গেছে।

শৈলীর খোঁজে ভাল কোনো হুজুর আছে কি না জিজ্ঞেস করতেই মেয়ে আঁৎকে উঠল। আস্তাগফিরুল্লাহ নাউযুবিল্লাহ বলে তিন হাত দূরে সরে গেল। এসব নাকি খুব খারাপ, কুফুরি কাজ। ঈমান থাকে না এসব করলে! এরকম হাবিজাবি কত কী যে বলল!

সেলিনা হোসেনের মেজাজ চড়ে গেছে। মেয়ে তার জামাইকে নিয়ে সুখে থাকবে। এতে খারাপের কী আছে? দুইদিন হয়েছে পর্দা করে মেয়ে। এখনই কার ঈমান আছে কার ঈমান গেছে হিসেব কষতে শুরু করেছে!

খুশবুর ছেলেটা কলেজ ফাঁকি দিয়ে টো টো করত। খুশবুর স্বামী চিনিপড়া দেয়া হুজুরকে বাড়িতে আনলেন। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়েই হুজুর বলে দিলেন ছেলে কই যায়, কী করে! এমনই তার এলেম! আল্লাহর সাক্ষাৎ অলী না হলে এমনটা সম্ভব? খুশবুর মুখে প্রশংসা শুনেই না সেলিনা গিয়েছিলেন হুজুরের কাছে।

চুপচাপ বোকা বোকা শৈলী আজ খুব ফটফট করল। বলল হুজুর নাকি আল্লাহর অলী না, শয়তান পূজারী। অলীরা হাটেমাঠে কারামত দেখিয়ে বেড়ান না। ঐ ছেলের সাথে থাকা ক্বারীন জ্বীন আর হুজুরের পোষা জ্বীন যোগাযোগ করে নাকি বের করেছে ছেলে ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে কই যায়।

সেলিনা হোসেন ততক্ষণে রাগে দিশেহারা। পরিস্থিতি সামাল দিতে অনিমা শৈলীকে একরকম জোর করে বাসা থেকে তাড়িয়েছে। শৈলী ফ্রেন্ডদের মা বাবার সামনে খুব ভদ্র সাজে। সব ফ্রেন্ডের মায়েরা শৈলী বলতে অজ্ঞান। এ নিয়ে অনিমার মনে মনে ক্ষোভ ছিল ভীষণ। আজ তো প্রমাণ হল ও আসলে কেমন! সত্য কখনো চাপা থাকে না।

৩.
আজ অল্পের জন্য এক্সিডেন্ট থেকে বেঁচে গেছে রাশেদ। রাস্তায় বের হলে কী যেন হয় আজকাল। মনে হয় ঘাড়টা কেউ চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে, ডানে বামে খেয়াল রাখতে পারে না। ফুটপাথে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে রাস্তায় নেমে গেছে টের পায়নি। রিকশাওয়ালা অনেক্ষণ নাকি হর্ন বাজিয়েছে। শেষে মুখ খারাপ করে দু’টো গালি দেয়ার পর রাশেদের সম্বিৎ ফিরেছে।

আশ্চর্য ব্যাপার, মায়ের ভদ্র ছেলে রাশেদও রিকশাওয়ালাকে পালটা গালি দিয়ে ফেলেছে। গালিটা নিজের কানেই ধাক্কা মারলো! কখনো মনেও এমন গালি আনেনি রাশেদ। কী হল ওর! মনের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সারাক্ষণ কী যেন ভাবতে থাকে। অফিসে থাকলে বাড়ি ফেরার জন্য মন ছটফট করে। বাড়ি ফিরলে আর ভাল লাগে না। মা, অনিমা সবাইকে অসহ্য লাগে। নিজেকেও খুব অসহ্য লাগে! ভয়ানক অসহ্য!

কোনো কারণ ছাড়াই প্রচন্ড রাগ উঠে যায়। বিধ্বংসী রাগ। রাগের চোটে রাতে ঘুম হয় না। চোখ বন্ধ করলেই দেখে উঁচু বিল্ডিং এর সানশেডে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। এক জোড়া স্নিকার পরা পা দুলছে। হাত দুটো সানশেডে ভর দিয়ে রাখা। সব রাগ কষ্ট ঝরে ঝরে নিচে পড়ে যাচ্ছে। সত্যিই সানশেডে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে রাশেদের।

অনিমাকে এ কথা বলেছিল একবার। বলতে দেরি, অনিমা মায়ের কাছে পৌঁছাতে দেরি করে নি। তৎক্ষণাৎ রাশেদকে সেলিনা হোসেন ফোন দিয়ে বসেছে।
বাবা তোমার কী হল? এমন কথা বলতে হয়?

এরপর রাশেদের মায়ের সাথে অনিমার মা, অনিমার সাথে রাশেদের মা, অনিমার মায়ের সাথে রাশেদের কয়েক দফা সংলাপ হয়ে গেল সানশেডে বসা নিয়ে। এক কথায় হুলুস্থুল কান্ড!

খোদেজা বেগম হায় হায় করলেন, মা মেয়ের খপ্পরে পড়ে তার ছেলেটা পাগল হয়ে গেল।

অনিমার মা হায়হায় করলেন, নাটকবাজ খোদেজা বেগম ছেলেকে বউ থেকে আলাদা করার পাঁয়তারা করছে।

ঘটনা বাইরে থেকে না দেখলে জানার উপায় নেই যে দুইদিকের চেষ্টা তদবিরে রাশেদের এই হাল।

৪.
শব্দটা শোনা গিয়েছিল রাত তিনটে সময়। ছয়তলা থেকে পড়ার শব্দ আর রাশেদের চিৎকার মিলেমিশে একাকার। অনিমা ঘুমিয়ে ছিল। রাশেদের মা ঘুমান না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করেন সারারাত। রাশেদ পা টিপে টিপে দরজা খুলে ছাদে চলে যাওয়ার সময় খুট করে শব্দ পেয়েছিলেন। পাত্তা দেননি। রাত বিরাতে অমন অনেক শব্দই হয়। তখনও জানতেন না সারাজীবন আফসোস করতে হবে এজন্য।

রাশেদ অবশ্য মরতে চায়নি। ঐ রাতে নিজেকে আটকাতে পারেনি আসলে। মনে হচ্ছিল সানশেডে না বসলে মরেই যাবে। ওকে যেতেই হবে ছাদে। ছাদ থেকে সানশেড।

সানশেডে পা ঝুলালে দু:খ কষ্ট রাগ অভিমান ঝরে যাবে কথাটা সত্যি না। রাশেদ টের পেয়েছিল। সব রাগ কষ্ট নিয়ে ধপ করে নিচে পড়ে যাওয়ার আগে ঠিক টের পেয়েছিল।

এরপরের ঘটনা বর্ণণাতীত। এক মেয়ে বিধবা হল, এক মা সন্তান হারালো। রাশেদের বিয়ের পর যেমন পিলপিল করে মানুষ এসেছিল মেয়ের বাড়ির উপঢৌকন দেখতে, মৃত্যুর পরও পিলপিল করে মানুষ আসতে লাগল। শোক সন্তাপের আড়ালে ঘটনার আদ্যোপান্ত বোঝার আপ্রাণ চেষ্টা।

বিয়েতেও ঠিক তাই হয়েছিল। আনন্দের ঘনঘটায় কেউ লেনদেনের হিসেব করতে ভুলে যায়নি। কতটুকু দেয়াতে কতটুকু নেয়া হল, সবাই যার যার মত বুঝে নিয়েছে।

দুই মা এক বুক কষ্ট নিয়ে জায়নামাযে বসেছে। দু’হাত তুলে দুজনই আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানিয়েছে। যাদের জন্য একজন পুত্রহারা হল, যার জন্য একজন বিধবার মা হল, আল্লাহ যেন তাদের শান্তিতে না রাখে।
কেউই টের পেল না, কী আত্মঘাতী দু’আ করে বসেছে। টের পাবেই বা কী করে! ওরা তো যা করেছিল ভালোর জন্যই করেছিল!

——————————

[ সিহর বা জাদুটোনা আমাদের সমাজে অনেক স্বাভাবিকভাবে নেয়া হয়।

কাউকে ভাল লাগেনাই? কবিরাজের কাছে দৌড়।
কাউকে ভাল লাগসে? কবিরাজের কাছে দৌড়।
কোনো মনোবাসনা পূরণ হচ্ছে না? কবিরাজের কাছে দৌড়।

যারা এসব করে তাদের অনেকেই জানে না ঈমান বিকিয়ে দিচ্ছে। জ্বীনসাধক জাদুকরকে ভাবে মুত্তাকী হুজুর। এখানেই শেষ না। এসব করতে গিয়ে নিজেরা যখন বিপদে পড়ে তখন ভাবে কেউ তাদের তাবিজ করেছে ]

—————————
ভালোর জন্যই

আফিফা আবেদীন সাওদা

—————————-
বিদ্র: দাম্পত্য সম্পর্ক নষ্ট হয় এমন কিছু করতে ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ রয়েছে। পবিত্র কুরআনে জাদুর ক্ষতি বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহপাক বলেন,

‘তারা তাদের কাছে এমন জাদু শিখতো যা দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটানো যায়।’ [সুরা বাকারাহ, আয়াত-১০২]

পরে জাদুর পরিণাম বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন,

‘তারা নিশ্চিত জানে—যে জাদু টোনা খরিদ করে আখেরাতে তার জন্য কোনো অংশ নেই।’ [সুরা বাকারাহ, আয়াত-১০২]

-রৌদ্রময়ী এডমিন

মে ০৫, ২০১৮ইং