মঙ্গলে আবাস


“ব্লু বেরি! ব্লু বেরি! ইউ দেয়ার?”

নাসা কন্ট্রোল রুম থেকে ভেসে আসা ডাকে সাড়া দেয়ার কেউ নেই। এলিজা কার্সন আস্তে আস্তে ঢলে পড়ছে মঙ্গলের লাল মাটিতে। সূর্যটা উঠি উঠি করছে, পুরো আকাশ তাই নীল হয়ে আছে। পৃথিবীর মাটির চেয়ে তিনগুণ ভারী শরীরটা আরো ভারী লাগছে এলিজার। শুধু বাবার মায়া ভরা মুখটা মনে পড়ছে। আর কোনোদিনই দেখা হওয়া সম্ভব না- এমনটাই ভেবেছিল। শেষ অক্সিজেনটুকুও যখন ফুরিয়ে যাচ্ছিল তখন এলিজা নিজেকে পৃথিবীর প্রতিটা পত্রিকার শিরোনামে দেখছিল যেন। ঠিক তখনই অসংখ্য ডানা নিয়ে দিগন্ত জুড়ে দেখা দেয় ওরা।

ফিসফিসিয়ে বলে, “নির্দেশ আছে! নির্দেশ আছে শুধু এলিজাকে সাহায্য করার!”

“মঙ্গলে মৃত্যু হলো ! অথচ জানলো না কেন পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল!”

জ্ঞান হারানোর আগে এলিজার মগজে গেঁথে গেলো কথাটা, “কেন পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল!”

ধবধবে সাদা বিছানায় শুয়ে আছে এলিজা কার্সন।
লাফ দিয়ে উঠতে বসতে চাইলেও মাথার ভারের জন্যে পারছে না। নার্স দৌড়ে এসে অভয় দিলো। পৃথিবীতে ফিরে এসেছে এলিজা! শেষ দুইদিন জ্ঞান ছিল না ওর। বাইরে দেশ বিদেশের সাংবাদিকরা অপেক্ষা করছে এলিজার খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু নাসার নিজস্ব প্রতিবেদকের আগে কারো পক্ষে ওর কাছে পৌছা সম্ভব না।

বাবাকে জড়িয়ে ধরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো এলিজা। বাবা হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। মা মরা মেয়েটাকে বাবা-মা দুইজনের স্নেহ দিয়ে বড় করার চেষ্টা করেছেন। মেয়ের মঙ্গলে যাওয়ার স্বপ্নকে সবসময় উৎসাহ দিয়ে গেছেন। কোনোদিন আর দেখবেন মেয়েকে সেই আশা ছিল না, তবু হাসিমুখে বিদায় দিয়েছিলেন মেয়েকে। আজ তার কলিজার টুকরা আবার ফিরে এসেছে। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানান জনাথন কার্সন।
সংবাদ সম্মেলনে এলিজাকে দেখেই স্লোগান দিতে থাকে তরুণরা, উই আর মার্স জেনেরেশন”। এলিজা মুচকি হাসে, পৃথিবীবাসীকে জানিয়ে দেয় তার ৮ সহযোদ্ধার মৃত্যু “মার্স ওয়ান” মিশনকে আরো মহান করেছে। এই বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু বরণ করাই তার জন্যে শ্রেয় ছিল। মার্সের মাটিতে এলিজার জীবাশ্ম তৈরি হবে আজ না হলেও কাল।

সাংবাদিকদের আঁকাবাঁকা প্রশ্নমালা শেষে উঠে পড়ে এলিজা। মার্স ওয়ানের লেগো দেয়া ব্লু টিশার্টে “ব্লু বেরি”কে উজ্জ্বল লাগে আরো। ব্লু বেরি এলিজার কোড নেইম।


ল্যাপটপ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে এলিজা। ” মার্স ওয়ান মিশন” নিয়ে আলোচনা সমালোচনা পড়ছে নিউজফীডে। অক্সিজেন সাপ্লাই শেষ হয়ে যাচ্ছিল কেন তার যথোপযুক্ত জবাব দিতে পারেনি নাসার বিজ্ঞানীরা। কোথাকার এক গবেষক দাবি করে বসেছে মঙ্গলে মাটিতে লাগানো পৃথিবীর গাছগুলোই বুমেরাং হিসেবে কাজ করেছে! যেখানে পৃথিবীর মাটিতে কার্বন ডাই অক্সাইড তাদের খাদ্য ছিল মংগলে উলটো অক্সিজেনই তাদের চালিকা শক্তি!

পুরোপুরি প্রস্তাবনাটা উড়িয়ে দিতে পারে না এলিজা। টিমমেইট খালিদ বরাবরই গাছগুলোকে ঘাতক বলেছে। সেই একমাত্র রুমে গাছ রাখেনি। কিন্তু উল্কাপিন্ডের আঘাতে হঠাৎ মৃত্যু হয়েছে তার। মৃত্যুকে মারাত্বক ভয় পেতো ছেলেটা, এলিজার চেয়ে দুই বছরের বড় সিরিয়ান বংশোদ্ভূত ধর্মত্যাগী ছিল খালিদ। গাছ নিয়ে ওর সন্দেহকে প্রত্যেকে মুসলিমের কুসংস্কার বলে মজা করতো! রেগে গিয়ে খালিদ বলতো তার একমাত্র ধর্ম এস্ট্রনমি। কথাটা খুব ভালো লাগতো এলিজার।

ছোটবেলার একটা কার্টুন সিরিয়াল থেকে মঙ্গলের প্রতি প্রেম তার। মঙ্গলে আসার জন্যে নিজের অনেক ধরনের বাসনা পানিতে ফেলেছে সে। নাসার সর্বকনিষ্ঠা শিক্ষানবিশ ছিল সে। ৩০ বছরের মিডলাইফ ক্রাইসিস হিসেবে আবির্ভূত হওয়া ভালোবাসাকে মাটি চাপা দিয়েছিল অবলীলায়, নাসার সাথে যে চুক্তি ছিল মার্স মিশনের আগে কোনো রকম ঘর সংসার নয়! প্রিয় বাবাকে ছেড়ে গিয়েছে চোখের পানি লুকিয়ে হাসিমুখে।
মঙ্গলের দিনগুলির স্মৃতি হাঁতড়ায় এলিজা। যেতেই লেগেছিল ৩০০ দিন। প্রথম স্ট্রবেরি (ইউকের ডেভিডের কোডনেইম) পা রাখে প্রিয় লাল গ্রহটায়।

একে একে একটা মঙ্গলীয় বছর কাঁটিয়ে দিয়েছিল সবাই ফূর্তিতে। মঙ্গলের মাটি দিয়ে পরিকল্পনামাফিক ইট তৈরি হচ্ছিল। স্পেসস্ক্রাফটের বাইরে বাড়ি তৈরির প্ল্যান চলছিল। হঠাৎ ই জ্যাকফ্রুটের মৃত্যু পালটে দেয় সব কিছু। তার রুমের ছোট্ট টবের কসমস গাছটা তড়তড়িয়ে বেড়ে ওঠে যেদিন সে এই কসমস ছাড়ে। একই রকম ঘটনা ছিল স্ট্রবেরির মৃত্যুর সময়। এই ঘটনাগুলোর মাঝে যোগসূত্র দেখছিল পাইনএপল ( খালিদ)। উল্কা ঝড়ের দিন মারা পড়লো ছেলেটা। আস্তে আস্তে মানবশূন্য হচ্ছিল মঙ্গল। এলিজা ভয় পায়নি একটুও। ইস্পাত কঠিন মন গড়েছিল অনেক দিনের সাধনায়। মার্সে যেভাবেই হোক টেকার সব চেষ্টা করেছিল, শেষমেশ পারেনি।নাসা কন্ট্রোল রুম থেকে সেদিন ভেসে আসা প্রশ্নগুলোর জবাব এলিজা দেয়নি। তবু নাসার দাবি এলিজা খুব দ্রুতই তাদের সাথে যোগাযোগ করে। ক্রাফট ব্যাক করানোর কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও বুদ্ধিমান তরুণী পৃথিবীতে ফিরে এসে তার জীবন বাঁচায়। সমীকরণ মেলে না এলিজার। জ্ঞান হারিয়েছিল এলিজার। কে তবে নাসার সাথে তার হয়ে যোগাযোগ করলো! দিগন্ত বিস্তৃত কিছু অস্তিত্বের ফিসফিসানি কানে বাঁজে যেন। এলিজা দ্রুত ফোন লাগায় নাসার মেন্টাল হেলথ সেন্টারে, সাইকিয়াট্রিস্টের এপয়েন্টমেন্ট দরকার!


হ্যালুসিনেশন বলে ঘটনাটাকে অগ্রাহ্য করতে পারছিল না এলিজা! যখন অস্বস্তি নিয়ে ফিরছিল হেলথ সেন্টার থেকে তখনই মাইক দম বন্ধ করা খবরটা দিল!

রাশানরা বরাবরের মতো তাদের চক্রান্ত শুরু করেছে। তাদের বিজ্ঞানীরা এলিজা কার্সনকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা শুরু করেছে। “দেবদূতের সান্নিধ্যে এলিজা” শিরোনামে নিউজফিড ভরে গেছে। এলিজার ফেরার সময়ের যে হিসাব দিয়েছে নাসা, তা নাকি পুরো মঙ্গলাভিযানকে হাস্যকর প্রমাণ করেছে। নাসার তথ্য মতে মাত্র দুইদিনে পৃথিবীতে ফিরেছে মার্স ওয়ান স্পেসক্রাফট। ৩০০ দিনের জার্নিতে পৌছে দুইদিনে ফিরে আসতে স্পেসক্রাফটকে আলোর গতির কাছাকাছি যেতে হয়েছে। এটা তত্ত্বীয়ভাবে সম্ভব হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। এলিজা কী তবে অতিপ্রাকৃত কিছুর সাহায্য পেয়েছে! এই নিয়ে রুশ মিডিয়া হাসি ঠাট্টা শুরু করে দিয়েছে! নাসা চাঁদে লোক পাঠায়নি বরঞ্চ বানানো ফটোসেশন করেছিল, এমন অভিযোগও এসেছিল।

তেমনি মঙ্গলের মিশন নিয়েও হচ্ছে, হলিউড এর একটা স্টেজই নাকি যথেষ্ট মঙ্গলাভিযানের ড্রামা ধারণের জন্যে। একবিন্দু মন খারাপ নয় বরং দেবদূতের বিষয়টায় বুক ধরফর শুরু করে ধর্ম নিয়ে মাথা না ঘামানো এলিজার। এলিয়েন এসে তাকে উদ্ধার করেছে এটা সে স্বপ্নেও ভাবে না। মহাবিশ্বে অন্য কোনো প্রানী থাকলেও তা বড়জোর অনুজীব পর্যায়ের। কত রকমের টেস্ট দিয়ে তারপর সে মার্স ওয়ান মিশনের জন্যে নির্বাচিত হয়েছে। অক্সিজেনের পর্যাপ্ততা না থাকলেও হ্যালুসিনেশনের বিষয়টায় সে একমত হতে রাজি না। মাইক সান্তনা দেয় রুশ মিডিয়ার প্রোপাগাণ্ডার ব্যাপারে।

কিন্তু এলিজা ওর কথায় মাথা না ঘামিয়ে দ্রুত বাসায় চলে আসে। ট্যাব খুলে ডাউনলোড করে নেয় কিছু ধর্মগ্রন্থ। বইপাগল এলিজার জন্যে এই বিষয়টা একদম নতুন। বিভিন্ন বই এর পাতা স্ক্রল করতে করতে একটা বই এর পাতায় আটকে গেলো সে। যে কথাগুলো তাকে থমকে দিয়েছিল তা কিছুটা এমন-

“এরপরও তোমাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেল, যেন পাথর কিংবা তার তার চেয়েও কঠিন। অথচ কোন কোন পাথর তো এমন যা থেকে নদী-নালা প্রবাহিত হয়, আর কিছু এরুপ যে, বিদীর্ণ হওয়ার পর তা হতে পানি নির্গত হয়, আবার কিছু এমন যা আল্লাহ্‌র ভয়ে ধ্বসে পড়ে, আর তোমরা যা কর আল্লাহ্‌ সে সম্পর্কে গাফিল নন। “

অক্সিজেন সাপ্লাই ঠিক থাকলেও এলিজার একটু কষ্ট হচ্ছে শ্বাস নিতে। না! স্পেসস্যুট নয়,এলিজা আমাতুল্লাহ আপাদমস্তক বোরকা পরে নিয়েছে। নিকাবের জন্যে কষ্টই হচ্ছে তার, আল্লাহর জন্যে এতটুকু কষ্ট করতে সে রাজি। মাসজিদের নিকাবি বোনেরা বলেছে প্রথম দিকেই যা একটু কষ্ট হয়। এলিজা কার্সন থেকে আমাতুল্লাহ হওয়ার পর সহকর্মী ও বন্ধুদের অনেকেই পাগল ঠাউরেছে তাকে।

তার সাইকিয়াট্রিস্টও একজন চিকিৎসকের নীতি থেকে সরে এসেছে। ইসলাম বিদ্বেষীর মতো এলিজার ব্যক্তিগত তথ্য তুলে ধরেছে সবার কাছে। তার মতে, মঙ্গলে শেষ মূহুর্তে এলিজার মানসিক বিকৃতির বীজ রোপন হয়েছিল আর বীজ থেকে মহীরুহ হয়েছে ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে। এলিজা সুপারস্টারের জীবন ছেড়ে একজন সাধারণ মুসলিমাতে পরিণত হয়েছে। মুসলিম মেয়েদের জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর একটা কর্মশালা করাচ্ছে সে।

“উই আর মার্স জেনেরেশন” বদলে এখন তাকে দেখলে স্লোগান চলে, “উই আর ওয়ান ন্যাশন”। মুসলিম উম্মাহর একজন নাগরিক এখন এলিজা। ওয়ার্কশপ থেকেই ফিরছিল আর সম্পূর্ণ কালোতে মোড়া মুসলিমাকে দেখে যারা ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিল তাদের অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছিল। রাতের আকাশে মঙ্গলকে খুঁজে পেল এলিজা।

মঙ্গলের বাসিন্দা হতে চেয়েছিল সে। মঙ্গলেই তো আছে সে, এর চেয়ে বেশি মঙ্গল এই দুনিয়ায় আর কীসে আছে। এলিজা তো ছিল পথহারা, এখন পথ খুঁজে পেয়েছে। সেদিনের সেই ডানা মেলা অস্তিত্ব ফেরেশতাদের ছিল নাকি চোখের ভ্রম ছিল তা জানে না সে। তবু সেই ফিশফিশানি থেকেই সে নতুন পথ খুঁজে পেয়েছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ’লার অপার মহিমায়।

মঙ্গলে আবাস
– উম্মে লিলি

(০১/০৪/২০১৯)