মিঃ ইউটিউব-মিসেস ফেসবুক

লেকচারগুলোতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল রূপা। ‘ফিক্‌হ ওব লাভ এন্ড ম্যারেজ’! দুই বছর আগেই কোর্সটা করা শেষ রুপার, বিয়ে সংক্রান্ত মাসলা মাসায়েল বিষয়ক কোর্স। বাস্তব জীবনে কাজে লাগানোর সময় এসে গেছে। হাতে এক মাসও সময় নেই বিয়ে। বিয়েতে কিভাবে সাজবে তার থেকে বিয়ের ফিক্‌হ জেনে প্রস্তুত হওয়াটাই ওর বেশি দরকার মনে হচ্ছে। এক শায়খের ১৩ টা লেকচার ডাউনলোড করে নিয়েছে মোবাইলে। কিন্তু শোনার সময় করে উঠতে পারছে না। রাত বাজে তিনটা। কফি খেয়ে আগেই চাংগা হয়ে আছে সে। রাতে না ঘুমানোর অভ্যাস ওর অনেক আগে থেকেই। আগে যখন ইসলামের বুঝ ছিল না, মুভি দেখতো রাত জেগে। এখন মুভির স্থান করে নিয়েছে ইসলামিক লেকচার। ফজর পরে একবারে ঘুমায় সে। রাত জেগে দিনে ঘুমানো সুন্নাহ না জেনেও জীবনে এপ্লাই করতে পারছে না এখনো। যে স্কুলে শিক্ষকতা করছে সেখানে ডে শিফটে কাজ করায় কোনো সমস্যাও হয় না। রাতে সময়টা সুন্দর কাঁটে ওর। ইসলামী জ্ঞান অর্জন তো আছেই, সেই সাথে সমমনা ভাই বোনদের ফেইসবুক প্রোফাইলে ঘুরে বেড়ায় সে। তাদের লেখাগুলো পড়ে, কখনো কখনো খুব অনুপ্রাণিত হয়। দ্বীনকে ভালোবেসে অচেনা মানুষেরা কিভাবে বন্ধু হয়ে যায় সেটা দেখে মাঝে মাঝে বিরক্তও লাগে। ভার্চুয়াল জগতে বন্ধুত্বটা ওর কাছে কেমন প্লাস্টিক প্লাস্টিক লাগে, সেই বন্ধুত্বের ভিত্তি দ্বীন হলেও। একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে একসাথে বাস্তব জীবনে চলতে হয়, ঠোকাঠুকিও লাগতে হয়। ফেইসবুক দেখে বাস্তব মানুষকে চেনা যায় না। যদিও রূপা নিজেই ফেইসবুকে ইসলামী লেখা পড়ে এক দ্বীনি ভাই এর সাথে সংসার করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিল। তখন ভার্চুয়াল জগত আর বাস্তব জীবনের তুলনার কথা অতটা মনে আসেনি। সেই ভাই এর বিয়ে হয়ে গেছে আর রূপা মনে মনে ভেবেছে “তুমি জানলেই না তুমি কি হারালে”। রুপার বিয়ে এক আপু ঠিক করেছে, রুপার লেখা আপু খুব পছন্দ করে। আপু সবসময়ই বলে, “রুপা! আমার যে কেন ভাই নেই।ভাই থাকলে তোমার সাথেই বিয়ে দিতাম।“ যদিও ভার্চুয়াল সম্পর্ক তেমন পছন্দ নয়, তবু আপুর সাথে ওর ফেইসবুকেই পরিচয়। ছেলের সাথে দেখা হয়েছে রুপার। অত অসাধারণ কিছু লাগেনি। মনে হয়েছে জীবন চলে যাবে। অত বাছবিচার করে বিয়ে করা সম্ভব না। ছেলের ফেইসবুক প্রোফাইল ঘাটাঘাটি শেষ। অত হাই প্রোফাইল দ্বীনদার না। কে কত দ্বীনদার তা তো আল্লাহ ভালো জানেন, কিন্তু ছেলে ফেইসবুকের ইসলামী সমাজের পরিচিত কেউ না আরকি। রুপার এতে কোনো আপত্তি নেই, বেশি জনপ্রিয়রা একটু খুঁতখুঁতে হতে পারে বলে ওর মনে হয়। বিয়ে নিয়ে কিছু একটা পোস্ট করতে হাত নিশপিশ করে ওর। কিন্তু বিয়ের আগে নিজের বিয়ে নিয়ে পোস্ট দিলে যদি নজর লাগে এই ভয়ে কিছু দিতে পারে না। ইসলামী বিয়ের নিয়ম কানুন নিয়েই দুই একটা পোস্ট দেয় সে, তাতেই ওর প্রোফাইলের গোয়েন্দারা সন্দেহ করে বসে। এইতো সেদিন সাদা আর লাল রঙ্গের পোশাক কেন মুসলিম নারীরা বিয়েতে এড়িয়ে যাবে এমন একটা পোস্ট শেয়ার করেছিল, আরিশা লিখে বসল, “কিরে বিয়ে কবে!” ছোট ভাই রুপম ইনবক্সে নক করে বলল, এসব মাসলা মাসায়েলের চেয়ে অনেক ইম্পর্টেন্ট ইস্যু রয়েছে। ছোটখাটো বিষয়ে হইচই না করাই ভালো। এক রুম থেকে আরেক রুমে প্রায়ই চ্যাট করে ওরা দুই ভাই বোন। রুপা একটু কনফিউজড হয়ে গেলেও পোস্টটা আর ডিলিট করা হয়নি।

অচেনা একজনের সাথে সংসারো করা নিয়ে একটু চিন্তা হয় মাঝে মাঝে। কিন্তু সূরা রুমের আয়াতটা মনে পড়ায় মন শান্ত হয়ে যায়।

“আর তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।“ (৩০: ২১)

শাওনের ঘুম নেই চোখে। বিয়ের উত্তেজনা। সব কিছু ঠিকঠাক হবে তো? মেয়েটার সাথে মাত্র ১৫ মিনিটের দেখা, কথাবার্তা। ফ্রেন্ডরা বারবার করে হুশিয়ারি দিয়েছে। আন্দাজে কাকে না কাকে বিয়ে করছে শাওন। এখন তো জঙ্গির ভয় আছেই। প্রথম দেখাতে প্রেমে না পড়লেও চেহারা ভালোই লেগেছে ওর কাছে। আসলে চোখের পর্দা শুরুর পর যতগুলো মেয়ে দেখতে গেছে সে সবাইকেই ভালো লেগেছে। ক্যাটরিনার মতো সুন্দর হতে হবে তার বউকে এমনটা সে কোনোদিন ভাবেনি। একটা মেয়েকে দেখে একটাই বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু ব্যাটে বলে মিলেনি। ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে ও। ৪র্থ পাত্রী রুপা। সবচেয়ে যেটা ভালো লেগেছে রুপাকে ওর ‘ইন্টেলেকচুয়ালি সাউন্ড’ মনে হয়েছে। কথা বলে ভালো লেগেছে। পরিচিত দ্বীনী ভাই ঘটকালি করেছে। হ্যা হওয়ার পর মোহরানা নিয়ে মিটিং হয়েছে শাওনের বাসায়। এর আগে একটা বিয়ে মোহরানার জন্যে আগায়নি। মেয়েপক্ষ ৭ লাখ সমমূল্যের গয়না বা টাকা এই মূহুর্তে উসুল চায়। নিজের জমানো টাকায় এমন বিয়ে শাওনের পক্ষে সম্ভব না । আসলে মেয়েদের দ্বীনের বুঝই যথেষ্ট না, গার্জিয়ানদেরও দরকার। রুপার ব্যাপারটা আড়াই লাখ টাকার গয়নায় ফয়সালা হয়ে গেছে। রুপা বলে দিয়েছে ছেলের সামর্থ্য আর ইচ্ছাকেই সে গুরুত্ব দিবে, বিয়ের শুরুতেই ঋণের বোঝা টানুক স্বামী এটা ওর ইচ্ছা নয়। রুপার বাবাও মেয়েকে খুব গুরুত্ব দেন। আরো কমেই হয়তো রাজি হতো মেয়ে পক্ষ কিন্তু শাওন কম দিবে কেন! সাধ্যের মধ্যে সেরা সব দিয়েই ঘরে বউ আনতে চায় ও। আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি, দিনগুলো সব কেনাকাটাতেই যাচ্ছে। বড় বোনকে নিয়ে শপিং করে শাওন রোজই। মেয়ের ব্যাগ গুছানো শেষ। বড় আপার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক শাওনের। ভাগ্নে দুটো স্কুলে পড়ে, ওদেরকে শাশুড়ির কাছে দিয়ে তারপর আসেন শপিং এ। বড় আপার শাশুড়ির সাথে সারাক্ষণই খুটখাট লাগেই। বড় আপা শাওনকে বলে,” তোর বউ এর তো রাজ কপাল! শাশুড়ির সাথে থাকবে না। আব্বা আম্মাকে তো বললেও আসবে না ঢাকায়। বাড়িতে কী মজা পায় কে জানে। বিয়ে করে ওদেরকে আসতে বল ঢাকায়। বুড়াবুড়ির একটা যত্নআত্তিরও তো ব্যাপার আছে।“ মিটিমিটি হাসে শাওন। মা বাবাকে ঢাকায় ওইও আনতে চায়। তার স্ত্রী মা বাবার সেবা করবে এমনটা আশা করে না সে। কিন্তু বিয়ে করে বাবা মাকে এবার আসতে বলবেই। দুই বেডের বাসা নিয়েছে সে। মেস ছেড়ে দিয়েছে। বিয়ে উপলক্ষ্যে ঢাকা আসলেও গ্রামের টানে বেশিদিন থাকতে পারবেন বলে মনে হয় না। শপিং শেষে রাত কাটে ইউটিউবে লেকচার শুনে। মেসেও ওয়াইফাই কানেকশান ছিল। অফিস থেকে ফিরে রাত ১২টা পর্যন্ত চলতো ইউটিউব লেকচার।লাউডস্পিকারে শোনার অভ্যাস ওর, মেসের সবার অভ্যাসই এমনই ছিল। যা শুনবে সবাইকে শুনিয়ে শুনবে। লেকচার শোনা নেশার মত ওর। প্রিয় শায়খের মতো হেয়ার স্টাইলও করে শাওন। বেশি রাত জাগে না। ফযর ধরার তাড়া থাকে, ফযর মিস হলে অনুশোচনায় মরে যায় সে। আগে আগে উঠতে পারলে তাহাজ্জুদও পড়ে নেয়। বেশি একটা পড়ার অভ্যাস নেই ওর। দুই একটা ইসলামী বই কিনলেও পড়া হয়ে উঠে না। যা শিখে তার বেশিরভাগই আসে ইউটিউব লেকচার থেকে। ঢাকার কিছু আলেমদের ক্লাসে সরাসরি বসার চেষ্টাও করে। সময় সুযোগ না হলেও চেষ্টাটা আছে। বিয়ে দিন তারিখ ঠিক হওয়ার পর থেকে রাতের ঘুম কমে গেছে। মেয়েটা বউ হিসেবে কেমন হবে, দজ্জাল হবে না তো! নানা চিন্তা দুশ্চিন্তা আসে মাথায়। অতীতের অনেক ঘটনা মনে পড়ে যায়। মিলির কথাও মনে পড়ে। তাদের ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে, সিনিয়র জুনিয়র সবার ক্রাশ । শাওনের জীবনের প্রথম এবং একমাত্র ভালোবাসা যাকে বলে। মিলিকে কোনোদিন ভালো লাগার কথা বলেনি শাওন। কিন্তু সেই মিলিই কিভাবে ওর পিছে লেগে গেলো আঠার মতো। শাওনও হয়তো রাজি হয়ে যেত কিন্তু একদিন ইউটিউবে বিচরণ করতে করতে সূরা ইউসুফের তাফসীর শোনা আর নিজেকে সংযত করা। নিজেকে মিলির মায়া থেকে ছুটাতে কষ্টই হয়েছিল ওর। সূরা ইউসুফ এমনই এক সূরা সবার জীবনের সাথেই হয়তো ইউসুফ (আঃ) এর জীবনের কোনো না কোনো কাহিনী মিলে যাবে। মিলিকে এড়ানো থেকে শুরু। তারপর যে কত লেকচার শোনা হয়েছে শেষ নেই। মিলির ঘটনা রুপাকে বলবে এমনটাই ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আরেক শায়খের লেকচারে পেল অতীত পাপের কথা নাকি গোপন রাখতে হয়। তাই মিলির কথা মনে পড়লেই আল্লাহ্‌র কাছে মাফ চেয়ে নেয় শাওন, স্মৃতি মুছার অপশান যদি থাকতো!

শাওনের ধাক্কায় ধড়মড় করে উঠে বসে রুপা। এতো জোরে কেন ঘুমের মাঝে ধাক্কায় বুঝে না ও। অলরেডি ফজর মিস, চারদিকে আলো ফুঁটে গেছে। নতুন বিয়ে বলেই কি ফজর পড়া নিয়ে এতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে দুজনের, বুঝতে পারছে না। এখন তো আর একার জীবন না তাই সারারাত জেগে ফজরে উঠতে পারে না সে। রাতে আগে আগে শুয়ে পড়লেও ঘুম এতো আগে আসে না, তখন ফেইসবুকে ঈমানদীপ্ত লেখা পড়ে সময় কাটায়। উঠতে উঠতে ঠিকই ১০টা বাজে। মনে পড়ে আজ শাওনের কিছু বন্ধুবান্ধব আসার কথা। দেখতে দেখতে বিয়ের এক মাস কেটে গেছে। বিয়ের এক সপ্তাহ পরই শশুড় শাশুড়ি গ্রামে ফিরে গেছেন। ঐ এক সপ্তাহ রুপাকে চুলার ধার ঘেষতে হয়নি, যদিও রুপা চেয়েছিল কিছু রান্না করতে। একমাত্র ছেলের বউ রুপা, কয়দিন পর তো ঠিকই হেশেল ঠেলতে হবে এই অজুহাতে শাওনের মা বউটাকে নতুন জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে কিছুদিন সময় দিয়েছেন। মা বাবা চলে যাওয়ার পর সকালবেলা নাস্তা না করেই অফিসে যেতে হত শাওনকে। রুপা সকালে উঠে রুটি বেলবে এমন স্বপ্ন ওর ছিল না। কিন্তু আশা ছিল অন্তত অফিস যাওয়ার সময় সজাগ থাকবে। এই নিয়ে অসন্তোষ এড়াতে চাইলেও ঠিকই একদিন রুপাকে কথায় কথায় খোঁটা দিয়ে ফেলে শাওন। রুপাও জেদ করে পরদিন ফজরে অনেক এলার্ম দিয়ে রাখে। ফজর পড়ে আর না ঘুমিয়ে অ্যামিবা শেইপের কিছু রুটি বানায় সে, সাথে আলু ভাজি। শাওন রুটির আকৃতি দেখে কিছু বলে না, বউকে খোঁটা দেয়ার পর থেকে নিজের কাছে নিজেকে ছোট লাগে। খুব করে রুপাকে বুঝায় যে ওর জন্যে নাস্তা তৈরী করাটা বড় বিষয় না, সুন্নাহ সম্মত জীবনের জন্যেই উচিত সকালে উঠা। ওই একদিনই, রুপাও তার আগের জীবনধারায় ফিরে যায়। বেশিদিন জিদ ধরে রাখা ওর পক্ষে সম্ভব হয় না। সকালের নাস্তাটা শাওন বাইরে কোথাও সেরে নেয়, একবেলা খাবার এদিক সেদিক হতেই পারে। এক মাসের মাঝে দুইবার মন কষাকষি হলো ওদের। আরেকদিন রুপার প্রচন্ড মাথাব্যাথা, জানার পরও শাওন ইউটিউব লেকচার শুনছেই। শায়খের কথাগুলো রুপার মাথায় জোরে জোরে বাড়ি দিচ্ছে যেন। কয়েকবার থামতে বলার পরও শাওন থামেনি। ইচ্ছা করে থামেনি তা নয়, এতই মনোযোগ দিয়ে শুনছিল যে রুপার কথা কানেই ঢুকেনি। সহ্য করতে না পেরে রুপা রুম থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। জোরে দরজা বাড়ি লাগায় শাওন বুঝেছে একটু বেশিই হয়ে গেছে আজ ইউটিউব শোনাটা।

আজ শনিবার, দুইজনেরই কর্মক্ষেত্র বন্ধ। কালই শাওন একগাদা বাজার করে রেখেছে। রুপা খুব ভালো চাইনিজ পারে, ইউটিউব চ্যানেল থেকে শেখা। ৪ জন স্কুল ফ্রেন্ড আসবে শাওনের, রুপা যে আস্তে ধীরে রান্না করে, আগে আগে শুরু না করলে সম্ভব না। জলদি করে নামাযটা পড়ে নেয় রুপা। রান্না শুরুর আগে একটু ফেইসবুকে ঢু মারে। হঠাৎ কিছু একটা পোস্ট দিতে ইচ্ছে করে। উম্মুল মু’মিনীনরা যে স্বামীর খাবার নিজেরা সার্ভ করতেন এই রিলেটেড ছোট্ট একটা লেখা লিখে পোস্ট করে দিলো সে। কাঁটা বাঁছা শেষ করে ওর পোস্টে কত রিয়েকশান আসলো এক ফাঁকে দেখে নেয়। ওর এই অভ্যাসকে শাওন বলে, “পাগলের সুখ মনে মনে, স্টেটাস দিয়ে লাইক গোনে।“ আসলে লাইকের জন্যে পোস্ট দেয় না রুপা। দাওয়াহ্‌র জন্যেই দেয়, তবু কোনো পোস্টে লাইক কম আসলে মনটা একটু খচখচ করে। শাওন বলে “লাইক” নাকি ডোপামিন নিঃস্বরনের কারণ। যত লাইক পাওয়া যায় মস্তিষ্কে তত ডোপামিন নামক রাসায়নিকের নিঃসরণ হয় আর সুখানুভুতি হয়। লাইক পাওয়ার নেশা কোনো ড্রাগের চেয়ে কম খারাপ না।

১২টার আগেই মোটামুটি রান্না শেষ হয়ে যায় রূপার। দুপুরের খাবার শেষে কিছুক্ষণ পর কফি করে দিলেই ওর দায়িত্ব শেষ। পুরা রান্নার সময়টাই ইউটিউব লেকচারের আওয়াজ শুনেছে সে। শাওন বেডরুমে বিছানায় গা এলিয়ে শুনলেও ঠিকই আওয়াজ পাওয়া গেছে রান্নাঘরে। রান্নার সময় খুব ফূর্তিতে থাকে রুপা, তাই খুব একটা পাত্তা দেয়নি।

সন্ধ্যার যিকরগুলো মিস করায় কি ঝগড়াটা এড়ানো গেলো না। মন খচখচ করে রুপার। মাগরিবের পর রান্নাঘরে গিয়ে মেজাজ বিগড়ে গেছে ওর। গেস্টসহ ৬ জন মাত্র ছিল ওরা, তাই এতো হাড়িপাতিল জমলো কিভাবে। এখনো ছুটা বুয়া পায়নি। অন্যের খাওয়া প্লেট মাজতে এমনিতেই ওর খুব ঘেন্না লাগে। শাওন তো একটু হেল্প করলেই পারে। আজই ফেইসবুকে পোস্ট করবে যে এখনকার স্বামীরা ভুলে গেছে রাসূলের সুন্নাহ। তিনি ঘরের কাজে সবসময় হাত লাগাতেন। সবগুলো বাসন মাজতে গিয়ে পিঠে ব্যাথা করছে। রুমে আসতেই ‘মিঃ ইউটিউব’ শাওনের আবদার এক কাপ কফি হবে? রাগে ফেটে পড়ে রুপা। সামান্য কফিটাও কি নিয়ে খেতে পারে না! বিবেক বলেও কি কিছু নেই! সামান্যতেই এতো চটাং চটাং কথায় শাওনও ক্ষেপে যায়। ওর মা খালারাও কাজ করেছে অনেক। কোনোদিন বাবা খালুদের সাথে গলা তুলে কথা বলেনি! এখনকার মেয়েরা ২৫ বছর হলেও বার্বিডল নিয়ে ঘুমায়। বিয়ের ম্যাচুরিটিই আসেনি তবু বিয়ে করে বসে আছে। উম্মুল মু’মিনীনরা কোনোদিন রাসূলকে অসম্মান করে কথা বলেছে! রুপাও বলে বসে, আমি আল্লাহ্‌র নবীকে বিয়ে করিনি আর আমি জান্নাতী নারীও নই। কাঁদতে কাঁদতে অন্ধকার বারান্দায় গিয়ে বসে ও। এতো খারাপ লাগছে যে স্মার্টফোনটা বারান্দায় আনতেও ইচ্ছে করে না।

এশার আযান পড়ে, শাওন বারান্দায় এসে বসে। দুই হাতে দুই কফির মগ। খুব যত্ন করে বানানো কফি, দেখেই বুঝা যাচ্ছে ব্লেন্ডারে বানানো। কফির ফেনাতে একটা ভালোবাসার চিহ্ন আঁকার অনেক চেষ্টা করেও সফল হয়নি সে। রুপার হাতটা নিজের হাতে নেয়। চোখ মুছে দিয়ে কাছে টেনে বলে,” রুপা, তুমি আমি কেউই সত্যিকার ইসলাম বুঝে বড় হইনি। আমাদের ডিজিটাল জীবনে যখন ইসলাম এসেছে আমরা সেটাকেও ডিজিটাল বানিয়ে ফেলেছি।বাড়ির একমাত্র ছেলে হওয়ার আর মেসে থাকায় পরিবারের মেয়েদের কাজে সাহায্য করার মানসিকতাটা তৈরি হয়নি। “

নিজেকে সামলে নেয় রুপা। “ভুল আমারো আছে শাওন। আম্মু দিনের পর দিন একা মেহমান সামলিয়েছে। সেইভাবে রান্নাঘরে দায়িত্ব নিয়ে কিছু করিনি। এখন অল্প দায়িত্বেই চোখে সর্ষে ফুল দেখি।“

“বাস্তব জীবনে ইসলাম আনতে গেলে আমাদের বাস্তবে ফিরতে হবে ভার্চুয়াল জগত থেকে। “

“আমি কি ফেইসবুক আইডি ডিলিট করে দিবো? আর তুমি ইউটিউব এপ?”

“ডিলিট কোনো সমাধান নয় রুপা। মূল বিষয় হল আত্মনিয়ন্ত্রণ। এক কাজ করি চলো আমরা যখন একসাথে থাকবো আমাদের ফোন দুটো আর চালাবো না। দুইজন একসাথে বসে দুই ফোন নিয়ে দুই জগতের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছি। আমাদের মা বাবারা মনে হয়না বিয়ের একমাসে এতো ঝগড়া করেছে।“

একমত হয় রুপা। কিভাবে স্মার্টফোন আমাদের সংসারগুলোতে শয়তানের ওয়াসওয়াসা হয়ে আসছে এটা নিয়ে একটা পোস্ট দিবে ভাবতে গিয়ে হেসে ফেলল রুপা। নিজেকে মি: ইউটিউবের বউ মিসেস ফেইসবুক মনে হচ্ছে।

মিঃ ইউটিউব-মিসেস ফেসবুক
উম্মে লিলি