মৃত্যু

১.
ঘর ভর্তি মানুষ। উঠোনেও মানুষের গাদাগাদি। এরই মধ্যে হাসান সাহেব আর তার স্ত্রী রুনা উপস্থিত হল, সাথে তাদের কলেজ পড়ুয়া মেয়ে তানিয়া। তখন প্রায় ১১টা বাজে। এখনো লাশের গোসল করানো হয়নি। রানী কেঁদেই চলেছে, সে তার মায়ের লাশ হাতছাড়া করছেইনা।

রানীর মা আলেয়া বেগম। এই বংশের সবচেয়ে বড় ছেলের স্ত্রী। বড় ছেলে বলতে হাসান সাহেবের বড় ভাই, হাসান সাহেবরা পাঁচ ভাই। হাসান সাহেব চতুর্থ, আর সবার ছোট এক ভাই বিদেশ থাকে, ওখানে সংসার করছে। হাসান সাহেবের বড় ভাবী আলেয়া বেগম বহুদিন ক্যান্সারে ভুগে ভুগে আজ সকালে মারা গেছেন। তাদের সংসারে চার মেয়ে, তিন ছেলে। সবাই ঢাকা থাকে হাসান সাহেবের মত। মা’র অবস্থার অবনতি দেখে প্রায় ৪-৫ দিন ধরে ছেলে মেয়েরা দেশের বাড়িতে রয়েছে শুধু ছোট ছেলে হীরা বাদে। ওর সবে বদলী হয়েছে দিনাজপুর। ওরা সবকটা খুব মা ভক্ত। তাই তো মায়ের চলে যাওয়াটা ওদের কাছে গভীর শোকের চেয়েও বেশি- রানী মায়ের লাশ ছাড়ছেই না। 

রানী সবচেয়ে ছোট মেয়ে আলেয়া বেগমের। রুনা কাকী আম্মাকে দেখে রানী আরো জোরে হাউমাউ করে উঠেছে। মা’র পর এই কাকী আম্মাকে সে অনেক সমীহ করে। রানীকে শান্ত করতে রুনা ছুটে এলো, বুকে জাপটে ধরেছে। তিন সন্তানের মা রানী- তাও সব সন্তান স্কুলে পড়ে, কিন্তু মা’র মৃত্যু তাকে যেন এক্কেবারে ছোট্ট রানী করে গিয়েছে।

আশপাশে মানুষের ভিড় কমছে না। সবাই মৃতের বাড়িতে এসেছে- কেউ লাশ দেখতে, কেউ কিচ্ছা গাইতে কিভাবে মারা গেল, যাবার বেলায় কিছু বলেছিল কিনা, কে কী করেছিল, কারা আসেনি লাশ দেখতে, কেন আসেনি, অসংখ্য গল্প চর্চা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। এগুলো সবই ঘুসঘুস ফুসফুস হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অবশ্য। রানীর কান্নায় আকাশ বাতাস একদিকে ভারী হচ্ছে, আরেকদিকে লোকের গপ্পে ভারী হচ্ছে মানুষের মন।

“আহা! কী ভালো ছিল আলেয়াবু। আমাদের খুব দরদ দিয়া খাওয়াইতো।”

“মরার আগে কাঠের মতন মানুষ রতনের (রানীর বড় ভাই) বাপটারে পর্যন্ত কান্দায় গেল!”

“ইশ! ছোট পোলাটা আইলোনা এই শেষ সময়। আজকালকার পোলারা বউ ছাড়া কিচ্ছু বুঝেনা!”

“বড় আঘাত পাইয়া মরসে আলেয়া ভাবী।”

ইত্যাদি নানা কষ্টে আলেয়া বেগমের চেয়ে প্রতিবেশীদের বেশি ব্যথিত হতে দেখা গেল। 

২.
লাশের গোসল শেষ। জানাজার কিছু বাকি। রানীর বড় বোনেরা আর ভাইয়েরা-ভাবীরা সবাই কাঁদছে। রানী আফসোস করছে তার ভাই হীরার জন্য। বেচারা ছুটি নিতে পারলোনা। কিন্তু তার বউ তো আসতে পারতো। শাশুড়িটা কতদিন ধরে অসুস্থ ছিল, তাকে দেখা বুঝি তার কর্তব্য না?(হীরার স্ত্রীও হীরার সাথে দিনাজপুরেই)

হাসান সাহেবের স্ত্রী রুনা বরাবর চুপচাপ থাকেন। তিনি আসলে বেশি অশান্তি পছন্দ করেন না। বিয়ে করে যখন এ বাড়িতে পা দিলেন- প্রায় ৩৫ বছর আগের কথা, তখনকার স্মৃতিগুলো আজও তাকে ভীত করে। নতুন বউ, একান্নবর্তী পরিবার, তার উপর ছোট ভাই/ছোট দেবরের উপর অধিকারবোধ থেকেই হয়ত রুনার উপর অবহেলার প্রকাশটা বেশি ছিল। হাজার অশান্তি আর গঞ্জনার রুনাকে ভালো করে শিখিয়ে দেয় চুপ করে থাকা। প্রতিবাদ করার জো ছিলওনা, হাসান সাহেব ভাই ভাবী বলতে অজ্ঞান। এসব কিছুর মধ্যে রানীকে লালন পালন করতে পারার স্বাধীনতাটাই ছিল রুনার পরম প্রাপ্তি। সারাটা জীবন দাপিয়ে বেড়ানো মানুষটার দেহটা কী নিথর হয়ে পড়ে আছে- অবাক হয়ে দেখছে রুনা।
রুনার সব জায়েরাই এখানে উপস্থিত, শুধু তার মেজো জা বাদে- রওশন নাম ওনার। স্বামী হারিয়েছেন বিয়ের বারো বছরের মাথায়। বাচ্চারা সব ছোট ছিল তখন। কেবল রওশনের স্বামীই একটা ছোট বাড়ি করে গিয়েছিল মৃত্যুর আগে, বাকিরা সবাই বড় ভাই এর সাথে থাকতো একসাথে। আর তাই, রওশনকে অনেক কথা শুনতে হত- অহংকারী, দেমাগী, স্বামীর দুলারী ইত্যাদি।

রুনা খোঁজ করলো রওশনের- হাসান সাহেব জানালেন ওরা আসেনি কেউ। রুনা হাসান সাহেবকে অনুরোধ করলো রওশন ভাবীর ছেলে মেয়েদের ফোন দিতে, না আসলে খারাপ দেখায়- মৃতের সাথে কী রাগ পুষে কেউ?

হাসান সাহেব ফোন দিলেন না।

৩.
জানাজা শেষ। আরেক দফা কান্নাকাটি, আর মানুষের ভিড়, লাশ দাফনের সময় চলে এলো। একে তো গ্রামের অভিজাত পরিবার, তার উপর বহু বছরের ইতিহাস রয়েছে এই পরিবারের এখানে। মানুষ আজ বুঝি কেউ ঘরে নেই। 
হাসান সাহেব তার বড় ভাই এর সাথে দাঁড়িয়ে আছেন, বেচারার এই চেহারা প্রথম দেখলো হাসান। সারাটা জীবন ভাই-ভাবী সংসারটাকে আগলে রেখেছেন, ছোট ভাইদের পড়াশুনা করিয়েছেন, বিয়ে দিয়েছেন, মা-বাবা বলতে তো এই দু’জন তাদের জন্য। আজ বড় ভাইটা কী অসহায় দেখাচ্ছে। 

.
হঠাৎ হট্টগোল শুনে বাইরে উঁকি দিল রুনা। লাশ নেয়ার প্রাক্কালে আবার কী হল? ওহ, রওশন ভাবীর বড় ছেলে এসেছে। রুনা যেই না যাবে ছেলেটার কাছে, বুঝলো পরিস্থিতি ভালো না। রওশন ভাবীর ছেলেটা বড় কাকীর (আলেয়া বেগম) লাশ দেখতে চেয়েছে। কিন্তু আলেয়া বেগমের ছেলেরা লাশ দেখতে বাধা দিচ্ছে। রুনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আজকের দিনেও…?

“আম্মা তোমাদের কারো মুখ দেখতে চান নাই, তোমাদেরও আম্মার মুখ দেখা লাগবেনা।“- আলেয়া বেগম এর বড় ছেলের গলা শোনা যাচ্ছে।

হাসান সাহেব কিছু বলছেন না, তবে রওশন ভাবীর ছেলেকে ইশারা দিলেন ঘরের দিকে। ছেলেটা নিথর দাঁড়িয়ে আছে। 

রুনার মনে পড়ে গেল সে সময়গুলো। রওশন ভাবী খুব কেঁদেছিল তাদের বাড়ীটা যেন বড় ভাসুর লিখে না নেন। কিন্তু বিধবা মহিলার আর্তনার কেউ শুনেনি। আলেয়া ভাবিকে সেদিন পাশে পায়নি রওশন ভাবী। বরং, তাদের ভিটেমাটিহীন করতে আলেয়া ভাবীর ভূমিকা গ্রামের কারো অজানা নয়। 
বিধবা হয়েও রওশন ভাবী কাউকে পাশে না নিয়ে ছেলে-মেয়ে দুটোকে শিক্ষিত করেছেন। গ্রামে ফিরে তাকাননি বহু বছর। তাদের খোঁজ-খবর নিয়েও তো অন্য ভাইদের কোন মাথা ব্যথা ছিল না। শুধু ছিল রুনার। কিন্তু সে তো আফসোস এর বেশি কিছু করতে শেখেনি। 

রুনার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ছেলে-মেয়ের জোড়াজুড়িতে দু বছর আগে রওশন আবার নিয়ে করে বিপত্মীক একজন ডাক্তারকে। আর সে জের ধরেই আজকের ঘটনার অবতারণা। “বুড়ো বয়সে প্রেম” অপবাদে জর্জরিত করলো যারা রওশনকে, তারা তো এতদিন খোঁজ নেয়নি ভাই এর বৌটার, তার সন্তানদের! রুনা ঝরঝরিয়ে কেঁদে চলেছে। জীবনের এতগুলো বছরে তার যেন কোন অধিকারবোধ জন্মায়নি কাউকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে কিছু বুঝিয়ে বলার, কাউকে সময়-অসময় শিক্ষা দেয়ার, আজ রুনার নিজেকে খুব অসহায় লাগছে।

৪.
মৃত্যুটা কত সহজে এসে যায় মানুষের জীবনে। মৃত্যু মানুষকে কত অসহায় করে দেয়- হোক না সে মৃত্যু রাজার কী প্রজার। মৃত্যু এতটা নির্মম যে সেকেন্ডে মানুষের নাম পালটে ‘লাশ’ বানিয়ে দেয়। মানুষ যতই প্রতাপে জীবন যাপন করুক না কেন, মৃত্যুর কাছে হার যে মানতেই হয়। এই মৃতকে নিয়ে কত গল্প, গুঞ্জন, কত ঘটনা, কত ভালোবাসা আর কত ঘৃণা- অথচ এসব কিছুতে মৃতের আর কিচ্ছু এসে যায় না। জীবনের বাকে বাকে এত স্বার্থের খেলা, এত প্রতিযোগিতা – কিচ্ছু নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই জেনেও মানুষ যে মত্ত দুনিয়ার ভ্রমে। আর সেই মৃতকে ঘিরেও কত রাজনীতি- মানুষ লাশ দেখেও যে মৃত্যুকে ভুলে থাকে স্বার্থের খাতিরে! ভুলে থাকে ওপারের হিসেব নিকেশগুলো।

মৃত্যু
উম্ম হুরায়রা
(১৯ ডিসেম্বর ২০১৭)