রক্তাক্ত গোধূলি -১

রাহেলা তার ফুলে ওঠা পেটের উপর হাত রাখলো। সকাল থেকে শরীরটা ভালো লাগছে না, মনে হচ্ছে সময় এগিয়ে এসেছে। নতুন প্রাণ নিজ অস্তিত্ব প্রমাণের আকাঙ্ক্ষায় প্রবল উচ্ছাসে যেন ফেটে পড়ছে। মাতৃগহ্বরের নিকষ আধাঁর থেকে আলোকিত পৃথিবীতে আসার সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত এখন সে।

ভারী শরীর নিয়ে বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে আকাশের পানে তাকালো রাহেলা। গোধূলির লালিমাকে আজ কেমন রক্তাভ মনে হচ্ছে। যেন এক বালতি রক্ত ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে সাদা মেঘের মাঝে।

ওর মা সব সময় বলতো, যেদিন আকাশে রক্তিম সূর্য দেখা যাবে, রক্তের বণ্যায় সেদিন সব কিছু ভেসে যাবে।
মনটাই খারাপ হয়ে গেল, আসলেই তো আকাশে বাতাসে আজ শুধু রক্তের গল্প, ঘৃণার গল্প, হত্যার গল্প।
তার সন্তান কি জানে, আলোর রাজ্যে নয়, বরং জঘন্য অন্ধকারে আবৃত এক পৃথিবীতে জন্ম নেবে সে!!

দেশের অবস্থা বোধ হয় বেশ খারাপ। যদিও চট্টগ্রাম শহরে এখনো হানাদার বাহিনী প্রবেশ করে নি। কিন্তু রেডিও আর লোক মুখে পাওয়া খবর শুনে মনে হচ্ছে, চাটগাঁতে ওদের আসা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র!!

তিন বছরের ছোট্ট আদিব লাল খেলনা গাড়িটি নিয়ে, দৌড়ে এলো রাহেলার কাছে। “মা, গাড়ির তাক্কা বেংগে গেতে”। বিনা কারণেই চোখে পানি চলে এলো রাহেলার। সত্যিই যদি পাকি সেনারা চলে আসে, কি হবে তখন, সন্তানদের কি রক্ষা করতে পারবে!

অবশ্য সরকারি চাকরি করে তার স্বামী শফিক, চট্টগ্রাম বন্দরের হারবার মাস্টার সে। সততার জন্য অফিসে সবাই ওকে বিশেষ সম্মানের চোখে দেখে। নিজেই নিজেকে প্রবোধ দেয় রাহেলা, তারা সরকারি বাংলো তে থাকে, স্বামী এতো বড় অফিসার। নিশ্চয় নিরাপদেই থাকবে ওর পরিবার।

প্রতিদিন বিকেলেই বাসায় ফিরে শফিক, আজ সন্ধ্যা নামছে প্রায়, এখনো এলো না! স্ত্রী কে এই শরীরে কেও এতোক্ষন একা রাখে! সারাদিন একটা ফোন ও দেয় নি!! বড্ড অভিমান হয় রাহেলার। আজকাল কারণে অকারণে মন অস্থির হয়ে থাকে।

হঠাত পেটের কোনে কেমন যেন ব্যাথা করে উঠলো। দুপুর থেকেই বেশ কয়েক বার এই ব্যাথাটা আসছে আর যাচ্ছে, যেন ছুড়ির ফলা দিয়ে ঘাই দিচ্ছে কেউ!

এমন সময় শফিক এলো, ওর মুখ অসম্ভব থমথমে হয়ে আছে। অবশ্য দেশের যে অবস্থা এখন, মন ভালো রাখাটাই যেন কষ্ট সাধ্য ব্যাপার। মাথার ক্যাপ খুলে আনমনে ছেলের মাথায় পড়িয়ে দিলো, বাবার ক্যাপ হাতে নিয়ে দৌড়ে বারান্দার এ মাথা ও মাথা করতে লাগলো আদিব।

বুকের ভেতর যেন পাহাড় সম বোঝা জমে আছে শফিকের। কিভাবে সে সব কিছু বলবে রাহেলা কে! কোথায় যাবে এখন তারা, হাতে বেশি সময় নেই। আজ রাতের ভেতরেই পালাতে হবে!!

আজ সে বিশাল অপরাধ করেছে। সরকারের চাকরি করে, সরকারের বিরোধে গেছে! বিশাল অস্ত্র বোঝাই জাহাজটি ঢোকার অনুমতি দেয় নি বন্দরে। জানে, শেষ পর্যন্ত বাঁধা দেয়ার ক্ষমতা তার নেই, কিন্তু নিজের দেশের নিরীহ মানুষ মারার জন্য অস্ত্রের জাহাজ প্রবেশ করানোর অনুমতি দেয়াও তার দ্বারা সম্ভব নয়!

এর জন্য যদি প্রাণও চলে যায় কিছু করার নেই। এখন যা হবার হয়ে গিয়েছে, জাহাজের নোঙর করার কালক্ষেপণ করা গেছে মাত্র!

নোঙর ফেলার আগেই পালাতে হবে ওদের! আস্তে করে রাহেলার হাত ধরলো, এরপর হাঁটু গেড়ে বসে কান্নায় ভেংগে পড়লো।

রাহেলা অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আছে, তার সিংহ পুরুষকে কখনো এমন অবস্থায় দেখেনি সে।

পাগলের মতো শফিক বার বার বলতে লাগলো, ” তোমাদের বাঁচাতে পারবো না কি জানি না, আমি পারলাম না আমার নীতির বিরুদ্ধে যেতে। আমাদের এক্ষুনি পালাতে হবে। ওরা চলে এলে আমাকে ছাড়বে না, তোমাদেরও ছাড়বে না!”

রাহেলার মুখ বিকৃত হয়ে গেলো। আবার সেই তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা, এবার নিশ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। কোনমতে শফিককে বললো,
“সময় হয়ে গেছে, খুব কষ্ট হচ্ছে, ভোর পর্যন্তও মনে হয় ঠেকিয়ে রাখতে পারবো না!”

শফিক আতংকে জমে গেলো ! আজ রাতের মাঝেই যে করেই হোক বাড়ি ছাড়তে হবে, নাহয় ওরা কেও বাঁচবে না!! (চলবে)