রাতের ভুতের ভয়

ইভান ও ইহান দুই ভাই। ইভানের বয়স ১৩, ইহানের ১০। সারাক্ষণ দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট খাটো বিষয় নিয়ে খিটিমিটি লেগে থাকে।

ইভান ইহানের মা বছর ২ আগে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন।

ওদের বাবাকে নানা কাজে সারাদিন বাইরে থাকতে হয়। যোগাযোগের সুবিধার জন্য ইভানকে একটা সিম্পল মোবাইল দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ইভানের সব বন্ধুদের নাকি স্মার্টফোন আছে। স্মার্টফোন নাকি পড়াশোনার বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায়। এসব বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে ইভান একটা স্মার্টফোন বাগিয়ে নিয়েছে।

ইভানকে মোবাইল দেওয়ার পরেই বাধলো আরেক বিপত্তি। ইভান তার মোবাইলে গেমস খেলে, কার্টুন দেখে, ভিডিও দেখে। কিন্তু সেই মোবাইল ইহানের ধরা মানা। নিষেধ করার পরেও ধরায় উত্তম মধ্যমও খেতে হয়েছে ইহানকে। এরপর থেকেই ইহানের আবদার, ভাইয়ের মত তারও মোবাইল চাই। মোবাইল হয়ত কিনেই দিতেন বাবা, কিন্তু তার আগেই জাফর চাচ্চু বাইরে থেকে একটা আই-প্যাড পাঠিয়ে দিলেন ইহানের জন্য।

ট্যাবটা পাওয়ার পরে সারাদিন ইহানের সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। দাদী ভাত খেতে ডাকেন, বাবা বেড়াতে যেতে ডাকেন, টিউটর এসে পড়তে ডাকেন। ইহান সাড়া দেয় না। চোখের পলক না ফেলে ট্যাবের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ জোর করে ট্যাব নিয়ে গেলে শুরু হয় চিৎকার। বাসার কেউ জানেন না ইহান ডিজিটাল ড্রাগে এডিক্টেড হয়ে যাচ্ছে।

ইহান ট্যাবে একটা নতুন গেইম খুঁজে পেয়েছে। ভুতের গেইম। অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে এক পরিত্যক্ত বাসায় এক বৃদ্ধা মহিলার ভূত ঘুরে বেড়ায়। এই গেইম ইহান সারাদিন খেলে। রক্ত, ভায়োলেন্স, ভয়। ইহানের মাথা ব্যাথা করে। কিন্তু সে খেলা বন্ধ করে না।

আগে ইহান ভয় পেতো না। এখন সে হঠাৎ হঠাৎ চমকে চমকে ওঠে। রাতে তো বটেই দিনের বেলাতেও একা একা বাথরুমে যেতে ভয় পায়। বাসার কারেন্ট চলে গেলে দৌড়ে এসে দাদীকে জড়িয়ে ধরে।

ইহানের ভয় পাওয়া সবার আগে খেয়াল করে ইভান। বুঝতে পেরে সে আরো উত্তক্ত করা শুরু করে ছোট ভাইকে। বাথরুমে গেলে লাইট নিভিয়ে দেয়। হঠাৎ কানের কাছে এসে ভাউ বলে চমকে দেয়। উৎপাত চলছেই। বাবার বকুনি, চোখ রাংগানি, ভাইয়ের অভিমান কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।

শেষে বাবা একদিন ইভানের মোবাইল জব্দ করলেন। সারাদিনের জন্য মোবাইল আলমারিতে বন্দী। সাজা পেয়ে যেন মরিয়া হয়ে গেলো ইভান। রাগে, দুঃখে গজরাতে লাগলো। মোবাইল হারানোর শাস্তি ইহানকে দিবেই দিবে বলে সে ঠিক করলো।

মোবাইলটা পরের দিন বাবা দিয়ে দিলো। কিন্তু ইভান তার প্ল্যান এটে চলেছে ইহানকে জব্দ করার।

সেদিন ১ নভেম্বর। ফেইসবুক ভর্তি হ্যালোউইন প্র‍্যাংকের ভিডিও। কেউ ভুত সেজে শপিং মলে ভয় দেখাচ্ছে, কেউ বা রাস্তায় হাতে হেটে ঘাবড়ে দিচ্ছে মানুষকে। গলা ছোট বাচ্চা হাতে মাথা নিয়ে হেটে বেড়াচ্ছে আর বলছে ট্রিক ওর ট্রিট।

মাথায় আইডিয়া খেলে যায় ইভানের। রাতে ইহানকে শায়েস্তা করবে।

রাতে দুই ভাই একই রুমে দুই বিছানায় ঘুমায়। আগে ওরা বাবা মায়ের সাথে ঘুমাতো। কিন্তু দশ বছর থেকে বিছানা আলাদা করে দেওয়ার নিয়ম। তাই ওরা আলাদা রুম, আলাদা বিছানা পেয়েছে। আর মা মারা যাওয়ার পরে বাবা একাই ঘুমান।
……………

রাত দেড়টা বাজে।

হঠাৎ কান্নার শব্দে ঘুম ভেংগে যায় ইহানের।

কান্নার উৎস খোঁজার চেষ্টা করে। ঘরে একটা নীল রঙের ডিম লাইট মিটমিট করে জ্বলছে। বিছানা থেকে নামতেই চোখে পরে সাদা অবয়বটা। কান্নার সুরে কি এক অপার্থিব গান গাইছে। হাতে পায়ে হেটে সামনে, ওর দিকে এগুচ্ছে। ইহান ফুসফুসের সব জোর এক করে চিৎকার করে ওঠে। করতেই থাকে।

চিৎকার শুনে আধো ঘুম আধো জাগরণে দৌড়ে আসেন বাবা। ইহানের চিৎকার তার অর্ধ জাগরিত মস্তিষ্কে বিপদ সংকেত পৌঁছে দিয়েছে। বিছানার কাছে সাদা কাপড়ে পেঁচানো প্রাণীটি মানুষ না আর কিছু এসব ভাবার সময় নেই। প্রাণীটি এগিয়ে যাচ্ছে ইহানের দিকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় বাবা পর্দা ঝুলানোর রড নামিয়ে নেন জলদি। সেই রড দিয়ে সোজা প্রাণীটির মাথায় আঘাত করেন।

একটা “থ্যাপ” আওয়াজ। এরপরে সব চুপ।

এরপরের ঘটনা ইহান ঠিকমতো মনে করতে পারেনা। আবছা এলোমেলো সব ঘটনা। ঘরভর্তি অনেক মানুষ…… দাদীর মুখ ঢেকে কান্না…… কারা যেন বাবাকে জেরা করছে…….বাবা কোন জবাব দিচ্ছেন না……. মানসিক ভারসাম্যই হারিয়ে ফেলেছেন যেন…… ইভানের রক্তাক্ত লাশ……. কাপড়ে পেচিয়ে ইভানকে কারা যেন কোথায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

ইহানের মাথা কাজ করে না।

ভাইকে নিয়ে যেতে দেখে হঠাৎ ইহান হন্যে হয়ে ইভানের মোবাইলটা খুঁজতে থাকে। মোবাইল ছাড়া ভাই এক দন্ড থাকতে পারে না যে!

………………