লাল সোয়েটার

১.
দুপুরের রোদে বসেও ঠকঠক করে কাঁপছে ছোট্ট ইয়াসমিন। কারণ – একেতো শীতের আগমনী বার্তা হিসেবে কনকনে ঠান্ডা বাতাস বইছে, আবার গতকাল থেকেই ওর শরীরে জ্বর আসি আসি করছে। শুধু তাই না, পেটেও ভীষণ ক্ষুধা, মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।

ইয়াসমিনের মা আনোয়ারা চুলায় রান্না চড়িয়েছে। শুধুই ভাত। লবন দিয়ে খাওয়া হবে। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়ার আগে তাদের অবস্থা এমন ছিল না। ইয়াসমিনের বাবা ছিলেন একটি মসজিদের ইমাম, খেয়ে পড়ে ভালই ছিল তারা। প্রয়াত স্বামীর কথা মনে হতেই চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেল আনোয়ারার। পুড়ে যাওয়া খড়ি গুলোর মত পরিণতি হয়েছিল তার। সেকথা মনে পড়তেই দুহাতে মুখ গুজে কান্নায় ভেঙে পড়লো। স্বামীর শোকে আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে আশংকায়, আনোয়ারার কান্না সহসাই থামলো না।

এদিকে শীতে কম্পমান ইয়াসমিনের চিন্তায় এখন তার প্রিয় লাল সোয়েটার। গত বছর অনেক শখ করে কিনেছিল। সোয়েটারটা তাদের দেশে রয়ে গেছে। ইশ, কি সুন্দরই না ছিল সোয়েটারটা! বাড়িতে ফিরে গেলে সোয়েটারটা খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু এতদিন পর যদি না পাওয়া যায়? ভাবতেই ওর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

অনেকক্ষণ পর মায়ের ডাকে একটু মনটা চনমনে হয়ে উঠলো ইয়াসমিনের। যাক, পেটের ইঁদুরগুলোকে এখন তাড়ানো যাবে। দূর্বল শরীর নিয়ে কোনমতে টলতে টলতে নিজেদের ছাউনির দিকে এগিয়ে গেল। আনোয়ারা তার জন্য গরম ভাত বেড়ে রেখেছে। থালাটা হাতে নিয়েই আবার রোদে এসে বসলো ইয়াসমিন। কিন্তু এক লোকমা খেয়ে দ্বিতীয় বার মুখে দেয়ার আগেই পাশের ছাউনির শিশু রফিক এসে সামনে দাড়ালো। ওর মা বাবা কেউ নেই, নানীর সাথে এসে আশ্রয় নিয়েছে। নানীর অবস্থাও ভাল না, খুব অসুখ। অযত্ন আর ক্ষুধায় ছেলেটার মুখ এতটুকু হয়ে গেছে।

ইয়াসমিনের খুব মায়া হলো। নিজের থালাটা রফিককে দিয়ে দিলো। রফিক খুশি মনে সেটা নিয়ে এক দৌড়ে নিজেদের ছাউনিতে চলে গেল। নিশ্চয়ই নানীর সাথে ভাগ করে খাবে। পেটে রয়ে যাওয়া ক্ষুধা সত্ত্বেও মনে মনে তৃপ্ত হলো ইয়াসমিন। তার বাবা তাকে সবসময় বলতেন – কাউকে কিছু দিয়ে উপকার করলে আল্লাহ তার থেকেও ভালো জিনিস দিয়ে পুরস্কৃত করবেন, হয় এই দুনিয়াতে আর না হয় আখিরাতে। এই ভাতের বদলে আল্লাহ তাকে কি দিবে ভাবতে থাকলো। এসব ভাবতে ভাবতেই মুখে হাসি ফুটলো ইয়াসমিনের, আর দূর থেকে তা দেখে মনটা হালকা হলো আনোয়ারারও। নাহ, আল্লাহ আছেন তাদের সাথে। সবার ভবিষ্যৎ তো তাঁরই হাতে।

২.
আলমারি থেকে বের করে শীতের কাপড়গুলো বিছানার উপর রাখছে ফারিয়া। কিন্তু ছোট হাত দুটো হ্যাংগারে ঝোলানো কাপড়গুলোর নাগাল পাচ্ছে না। অনেক চিন্তা করে পাশের রুম থেকে টুল এনে সেটার উপর উঠে তার পরে নাগাল পেল। সেখান থেকে নিজের সোয়েটারউফ। গুলো এনে বিছানায় জড়ো করলো। এবার বাছাই এর পালা। অসহায় মানুষদের শীতের কাপড় দান করবে, সেজন্য এত কিছু।

আম্মু বলেছে এই বছর ‘মুহাজির’ দের শীতের কাপড় পাঠাবে। মুহাজির কথাটার অর্থ ফারিয়া গতকাল শিখেছে। রাসুল (সাঃ) এর মত যারা ইসলাম পালনের কারণে নির্যাতিত হয়ে দেশত্যাগ বা হিজরত করেছে, তারাই মুহাজির। আর মুহাজিরদের যারা সাহায্য করে তারা হল আনসার। আল্লাহ মুহাজির আর আনসার উভয়কেই অনেক ভালোবাসেন আর তাদের জন্য জান্নাত প্রস্তুত করে রেখেছেন।

ফারিয়া চায় আনসারদের মত হতে, জান্নাতে যেতে। তাই সে তার কষ্ট হলেও তার প্রিয় সোয়েটারগুলো থেকে এক এক করে বাছাই করে ভাঁজ করতে লাগলো। এমন সময় ফারিয়ার মা রাদিয়া রুমে ঢুকলেন মেয়ের কাজ দেখতে। অবাক হয়ে দেখলেন প্রায় অর্ধেক কাপড়ই ফারিয়া দান করার জন্য গুছিয়ে রেখেছে।

রাদিয়া বাছাই করে রাখা সোয়েটারগুলোর মধ্য থেকে একটা হাতে নিলেন। লাল রং এর একটা সোয়েটার, বুকের উপর ডানদিকে আবার একটা হলুদ এমব্রয়ডারি করা ফুল। বিদেশ থেকে ফারিয়ার চাচা এনে দিয়েছিলেন। ওর খুব প্রিয় এটা। 

– তুমি কি এই লাল সোয়েটারটাও দিয়ে দিতে চাও, ফারিয়া?
– হ্যাঁ, আম্মু!
– কিন্তু এটা তো দামী অনেক। এখনো ভালো আছে। আর…
– তার মানে এটা দান করলে বেশি সাওয়াব হবে, তাই না?

রাদিয়া কোন উত্তর দিতে পারলেননা। ঠিকই তো। দান করলে ভালো জিনিসই তো দান করা উচিত। যা নিজের জন্য অপছন্দ, তা অপরকে দিলে আর যাই হোক, সাওয়াবের আশা করা যাবে না।

আল্লাহর কাছে মনে মনে শুকরিয়া জানালেন রাদিয়া – উত্তম সন্তানের জন্য, উত্তম রিজিকের জন্য। মনে মনে দোয়া করলেন, যেন আল্লাহ তায়ালা সবাইকেই তার নিয়ামত উপলব্ধি করার তৌফিক দেন।

৩.
কয়দিন আগে জ্বর ছাড়লেও শরীরটা এখনো নাজুক ইয়াসমিনের। তাই আজকে শীতের কাপড় বিতরণ হচ্ছে শুনেও যেতে পারেনি। অবশ্য ওর মা গিয়েছে, একটা কিছু নিশ্চয়ই আনবে।

অনেকক্ষণ হয়ে গেল কিন্তু আনোয়ারা ফিরলো না। ইয়াসমিনের এখন চিন্তা হচ্ছে। লাগবেনা শীতের কাপড়, মা ফিরে আসুক। বাবার মত মাও যদি হারিয়ে যায়, ও কি করে একা থাকবে? 

সব দুশ্চিন্তার অবসান হল ইয়াসমিনের, ওর মা ঢোকার সাথে সাথেই। খুশিতে শোয়া ছেড়ে উঠে বসলো। ওর খুশি বহু গুণে বেড়ে গেলো মায়ের হাতের সোয়েটারটা দেখে।

একটা টুকটুকে লাল সোয়েটার। ওর যেমনটা ছিল, তার থেকেও বেশি সুন্দর। কারণ এটার বুকের উপর ডান দিকে একটা ফুলও আছে, একটা হলুদ রঙের ফুল।

লাল সোয়েটার

বিনতে আব্দুল্লাহ
(২৮ ডিসেম্বর ২০১৭)