শাশুড়িরাও মানুষ

১.
ফোন বেজে যাচ্ছে, দুপুর বেলা ভাত ঘুমের সময়টা কোনো ফোন রিসিভ করতে ইচ্ছা করে না সামিনার। শারমিন আপু ফোন দিচ্ছে। চাকরির খবরটা আপুকেই আগে এসএমএস করে জানিয়েছিল সে। আপু এত ব্যস্ত মানুষ, তাও ফোন দিচ্ছেন, না ধরলে ভালো দেখায় না। ফোনটা ধরে সামিনা।

– আসসালামু আলাইকুম আপু! সব খবর ভালো?
– ওয়ালাইকুম আসসলাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু
– আপু আমার চাকরিটা হয়ে গেছে। পার্টটাইম লেকচারার হিসেবে।
– মা শা আল্লাহ! কংগ্র্যাচুলেশন সামিনা। তুমি তো শুধু মিক্স প্লেইসে কাজ করবো না, করবো না করে গেছো এতদিন।
– আপু, এটাও মিক্স প্লেইস না। আমার শুধু মেয়েদের ক্লাস নিতে হবে।
– শোনো আমি তোমার ভার্সিটি সম্পর্কে জানি। ওটা কতটা ইসলামিক আমার জানা আছে! অবশ্য আমি তোমাদের এই মিক্স প্লেইস রুল মানি না। এটা বাংলাদেশ বুঝলে।এখানে মধ্য প্রাচ্যের আলেমদের কথায় ইসলাম চলবে? আমি হাদীসের উপর অনার্স মাস্টার্স করা, ইসলামী পরিবারে বড় হয়েছি…
– ভিন্নমত থাকতেই পারে আপু। সবার সাথে সবার মিলবে না আরকী। যার যার বুঝ।
– তোমরা হলে ডানপন্থী ইসলামিস্ট। যুক্তি না আবেগটাই বড় তোমাদের কাছে। চরমপন্থার দিকে ঝোঁকার সম্ভাবনা বেশি থাকে তোমাদের। মন খারাপ করো না সামিনা। হক্ব কথা তিতাই হয় আরকী।

কথা কিভাবে তাড়াতাড়ি শেষ করা যাবে তাই ভাবে সামিনা। এত যুক্তি তর্কের মার প্যাচ ওর ভালো লাগে না। নিজের মত প্রতিষ্ঠা করাও ওর ধাঁতে নেই।

– না আপু মন খারাপের কিছু নেই। আপনার খবর বলেন।
– এনজয়িং লাইফ আফটার এইজেস! ঝাঁড়া হাত পা একদম। ইউকের ফেলোশিপটা শেষ করার পর বসে আছি ঘরে। ছেলের সাথে প্লে-স্টেশনে খেলছি। তোমার ভাইয়ার সাথে সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখে আসলাম কালও।ওহহো! তোমাকে বলে দিলাম। তুমি আবার মুভি দেখার অপরাধে দোররা মারবে না তো। তোমরা তো আবার নতুন নতুন ইসলাম বুঝে সব কিছুতেই পাপ খুঁজে পাও। পাপের ভয়ে মরো আর মারো।
– হাহা। কি যে বলেন না আপু।
– যাই হোক। তোমার শাশুড়ি কেমন আছেন। তোমার চাকরির খবরে খুশি?
– জ্বী আপু। মা তো সবসময় চান আমার একটা ক্যারিয়ার হোক। আপনার সাথে মা এর এই জায়গায় অনেক মিল।
– এই তো ভুল করলে বোনটিইইইইই (সুর করে টেনে টেনে)! সবার সাথে আমাকে মিলালে হবে না। এই সহজ ইকুয়েশনটা বুঝলে না? তুমি চাকরি করলে তোমার শাশুড়ির সংসারে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব বলে কিছু থাকছে না। শেষ কবে চুলার ধারে গিয়েছ মনে আছে?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামিনা। এই মাসের শুরুতে কেবল একদিন রান্না করেছিল জমিয়ে। চাইনিজ আইটেম সব, রাকিবের প্রিয়। ওইদিনই কেবল শাশুড়িমা রান্না ঘরে ঢুকেননি।

– আপু, ইচ্ছা করেই যাইনি। পড়াশোনা থেকে এত দূরে ছিলাম। সব ভুলে গেছি। পাগলের মতো পড়েছি কয়েকদিন। মা তো খাবারটা পর্যন্ত টেবিলে এনে দিতেন। সত্যি এমন শাশুড়ি হয় না।

– হাহা। সামিনা, তুমি না বোকাই রয়ে গেলে। বিয়ের একবছরও হয়নি তোমার। আরেকটু সময় নিয়ে না হয় মানুষ চিনো। শাশুড়ি ইজ অলয়েজ শাশুড়ি। যাই হোক! আমার শাশুড়িকে আবার অমনটা ভেবো না। তিনি খুব সরল মহিলা। আমার মতো পাপী বান্দা কি সুখই না ভোগ করছে এই দুনিয়ায়! ভয় হয় বুঝলে!
– আপু আপনি এনজিও তে আর যাচ্ছেন না? আপনার না ফেলোশিপের পর কোন এনজিও তে জয়েন করার কথা ছিল? (কথা ঘুরায় সামিনা)
– শুনো সামিনা। মানুষ না ক্যারিয়ার আর ফ্যামিলি লাইফ দুইটা গুলিয়ে ফেলে। দেখো আমার সন্তানের,স্বামীর কিন্তু আমাকে দরকার। আমি এখন ফুলটাইম হাউজ ওয়াইফ। অনেকেই ফোন দিয়ে হতাশা দেখায়, ফেইসবুক ইনবক্সে বলে আমি কিছুই করছি না কেন। হিউম্যান রাইটসের উপর এত অসাধারণ একটা ফেলোশিপ আমার ঝুলিতে। জব অফারও পাচ্ছি সেই রকম। কিন্তু জানো তো শুধু টাকা বা ক্যারিয়ারের জন্যে জীবন না। আর সংসার আমি খুব এঞ্জয় করি। এক বছর দেশের বাইরে থেকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত ছিলাম। এখন জব করে মরবো নাকি। মেয়েরা কেনো যেনো জব না করলে নিজেকে ছোট মনে করে। আসলে অন্যের চিন্তা দ্বারা এত বেশি তাড়িত হয় এই নারী জাতি! এই রে! পুচকুকে পটিতে বসিয়ে এসেছি। কর্ম সারা নিশ্চয়ই!

ফোন রেখে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে সামিনা। এই শারমিন আপুই ওকে সারাদিন বলতো বুয়েট পাশ মেয়ে তুমি সারাদিন ঘরে বসে থাকবে। কী লাভ হলো সরকারের এতগুলো টাকায় পড়ে। বিবেকের দংশন আপু অনেক দিয়েছে। মা বাবার স্বপ্নগুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। সে যেভাবে দ্বীন পালন করতে চায় তার সাথে কম্প্রোমাইজ করেনি সামিনা। শুধু একটা ইউনিভার্সিটিতেই এপ্লাই করেছে। হয়ে গেছে লেকচারারের জবটা। কিন্তু আপু এখন সংসার উপভোগের কথা আনায় সব কেমন এলোমেলো লাগছে। রাকিব জব নিয়ে বাঁধা দেয়নি, কিন্তু এতদূর যাতায়াতটা ও মেনে নিতে পারছে না। বাসা থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার যে কোনো দূরত্বই না এটা বারবার করে বুঝায় সামিনা। এর চেয়েও কত দূরে ছিল বাসা থেকে বুয়েট।শাশুড়ি খুশি হলেও বাচ্চা নেয়ার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে। ব্যক্তিগত ব্যাপারে এতো নাক গলানো সামিনার ভালো লাগে না।

শারমিন আপুর সেই পোস্টটার কথা মনে পড়ে যায়। শাশুড়ীরা পারলে ছেলে আর ছেলে বউ এর সব কিছুই নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। শেয়ার করতে চেয়েও পারেনি। অনেক খোলাখুলি কথা ছিল ওই স্টেটাসটায়, ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব টাইপ। কিছু শেয়ার দিলেই সবাই আবার ভাবে এটা তারই জীবনের বেপার, তাই আর শেয়ার দেয়া হয়নি।

২.
কাক ভোরে ঘুম ভাঙ্গে আমেনা বেগমের। এখনো সূর্য উঠেনি। নামাযের ওয়াক্ত এখনো আছে। স্বামীকে ঠেলে দেন, ছেলের ঘরে টোকা দিয়ে ওযু করতে ঢুকেন বাথরুমে। নামায শেষে রান্নাঘরে যান। ৩৭ বছরের সংসারে কোনোদিন নড়চড় হয়নি সকালে উঠে রান্নার কাজ শুরু করে দেয়াটা। নিয়ম করে চলতে ভালোবাসেন তিনি। অনিয়মটা একদমই সহ্য হয় না।

রুটি কাই করার পানিটা গরম হতে দিয়ে কান পেতে থাকেন। রাকিবের এইসময় মাসজিদ থেকে ফিরে বেল দেয়ার কথা। আজও কি তবে ফযর ওয়াক্ত মতো পড়তে পারলো না! দেখে শুনে দ্বীনদার একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে রাকিব। এই নিয়ে কারো কোনো কথাই শুনেনি। মেয়ের পর্দা এমন কড়া বয়স্ক চাচা শশুড়কেও মুখ দেখায় না। আমেনার ভালোই লাগে। গর্ব করে সবাইকে বলে ছেলের বউ এর পর্দার কথা। কিন্তু ইসলাম কি শুধুই পর্দার কথা বলে! বেশিরভাগ দিনই ছেলেটা ফযরে মাসজিদে যাচ্ছে না। বিয়ের পর যেন ফযর ধরাই কঠিন হয়ে গেছে। নিজেই হাজারটা জিনিস মানেন না, তাই আর কিছু বলা হয় না সামিনাকে। তার আগে থেকেই ইচ্ছা নিজের মেয়ের মতো দেখবেন ছেলের বউকে। কিন্তু পর কি কোনোদিন আপন হয়?

নিজের সরলতার জন্যে এটা ওটা বলে ফেলেন আবার সামিনার স্পষ্ট জবাবে নিজেকে গুটিয়ে নেন। বিয়ের ৯ মাস হতে চললো, বাচ্চা নেয়ার ব্যাপারে কী ভাবছে ওরা বুঝতে পারছেন না তিনি। মেয়েটা এমনিতে মিশুক-ভালো মানুষ হলেও, জায়গামতো চাপা আছে। লজ্জা শরম সব বাদ দিয়ে কয়েকবার সামিনাকে বলেছেন যে বিয়ের প্রথমে বাচ্চা নেয়াই ভালো। প্রথমে বাচ্চা নিয়ে পরেরটা যতদিন পরে ইচ্ছা নেক।

আমেনার বোনের মেয়েটাতো এই জন্যে কতো ভুগছে। একদিন তো খালাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই দিলো,“ সবাই বলেছে নতুন বিয়ে হয়েছে, এই সময়টা উপভোগ করো। এখনি বাচ্চাকাচ্চার ভেজালে যেয়ো না। কই কেউ তো একবারও বললো না আগে বাচ্চা নিয়ে নেয়াই ভালো।“ রুমকিকে কত কিছু বলে শান্তনা দিলো সেদিন আমেনা। ৮ বছরের সংসার এখনো বাচ্চা নেই। বয়স ৩৫ পেরিয়ে গেছে। সামিনাকে এসব নিয়ে প্রথমে দুইবার বলেছিল। মেয়েটা মৃদু হেসেছে, কিছু বলেনি। তিনবারের সময় কেমন চটে গেল। “মা এসব আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। আল্লাহ ভাগ্যে রাখলে আপনি দ্রুতই নাতি নাতনী পাবেন। অধৈর্য হবেন না প্লিজ।“

একথার পর তো আর কিছু বলা যায় না। এখন চাকরি পেয়েছে নতুন। বাচ্চার কথা কি আর চিন্তা করবে! তা করুক না চাকরি। আমেনা নিজে আজীবন হেঁশেল ঠেলেছেন। বোন-ভাবিদের মধ্যে যারা চাকরি করেছেন, তাদের দাপটই আলাদা মনে হয়েছে। তিনিও চান মেয়েরা চাকরি করুক। ভালো-মন্দের চুলচেরা বিশ্লেষণটা বুঝেন না তিনি। কিন্তু একটা চাকরিজীবীকে সমাজ আলাদা মর্যাদা দেয়, এত বছরের জীবনে তিনি তাই দেখেছেন। করুক সামিনা চাকরি, কিন্তু এখনি একটা বাচ্চা না নিলে পরে যদি আর না হয়। দুশ্চিন্তায় মাঝে মাঝে রাগও উঠে যায়, সামিনার আরও দোষগুলো চোখের সামনে চলে আসে।

রাকিব চায় সামিনার সাথে নাস্তা করে অফিসে বের হতে। সামিনা দেরি করে ঘুম থেকে উঠে। ছেলে তো আর চায়নি যে প্রতিদিন নাস্তাটা সামিনা তৈরি করুক। রাকিবের মা যতদিন সুস্থ সবল আছেন ছেলের বউকে রান্নাটা চাপিয়ে দিতে চান না। আর সামিনা যাই তৈরি করুক এতো আস্তে আস্তে করে যে রান্নাবান্নায় সুদক্ষ আমেনার বিরক্ত লাগে। তার উপর ছেলেটার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা লেগেই থাকে। সামিনার সবটাতে তেল বেশি দেয়া লাগবেই। ও নাস্তা তৈরি করলে বরং সমস্যা বেশি। ছেলেটাকে খুশি করার জন্য খুব কম দিনই সকালে উঠে ও। দুইদিন রাকিব উঠার পর ডাকতে গিয়েছিলেন আমেনা। ঘুমন্ত অবস্থায় এতো ক্লান্ত-শ্রান্ত লাগে মেয়েটাকে, মায়ার চোটেই আর উঠাতে পারলেন না। কিন্তু এখন চাকরির জন্যে কি ভোর সকালে উঠবেনা সামিনা! স্বামীর থেকে কি চাকরি বড় হয়ে গেলো? দজ্জাল শাশুড়িদের মতো মুখ খোলেন না বলে অনেক কথাই বলা হয়ে উঠে না আমেনার। থাক দিন যাক, একদিন ঠেকে শিখবে। সব কি আর বলে কয়ে শেখানো যায়!


সকালটা আজ আনন্দের। ৪-৫ দিনের জন্যে বাবার বাড়ি যাবে সামিনা। এক সপ্তাহ পর ভার্সিটিতে জয়েনিং। চাইলেও আর মা’র কাছে গিয়ে পড়ে থাকা সম্ভব না। এতদিনের বোরিং অখন্ড অবসর শেষ হতে চললো বলে। বাসায় যাওয়ার কথা শুনলেই শাশুড়ি মা অলৌকিক ভাবে নানা জরুরি বিষয় নিয়ে আসেন সামনে। তারপরও রাকিবের সাহায্যে ঠিকই ওসব ছুতো কাঁটিয়ে বের হতে পারে সামিনা।

“অমুক আসবে ঢাকায়! নতুন বউ দেখেনি। এবার নাহয় দুদিন পরেই যাও। না করছি না তোমাকে। যতদিন মন চায় থাকো। আমার বাবা ওতো বাধ্যবাধকতা নেই। অনেকেই ছেলের বউকে একদম যেতে দেয় না বাপের বাড়ি! এ কেমন নিষ্ঠুরতা।“ যত যাই মুখে বলুক না কেন। শাশুড়ির মুখটা ওইদিন বেশিই শুকনো লাগে সামিনার কাছে। টিপিক্যাল শাশুড়িদের মতো কথায় কথায় খোটা না দিলেও সম্পর্কের একটা দূরত্ব আছেই। বউ-শাশুড়ি দ্বন্দ্ব তো আর আজকালের সমস্যা নয়।

অন্যান্য দিন নাস্তা বানাতে না গেলেও আজ খুব নুডল্‌স করতে ইচ্ছে করছে সামিনার। সকালে উঠে নাস্তা বানাবে, স্বামী সেই নাস্তা খেয়ে যাবে; বিয়ের আগে এমনটাই ভাবতো। বিয়ের পর বুঝতে পারলো শাশুড়ি মা যখন তখন রান্নাঘর ঘেষতে দিতে চান না। ওটা যেন তার একচ্ছত্র আধিপত্যের জায়গা। সকালে উঠে করবে কী সামিনা বুঝতে পারে না। তাই বেশিরভাগ দিনই দেরি করে ওঠে। রাকিব এতে মন খারাপ করলেও, নিজের মতো কিছু করতে না পারার বিষন্নতা কাটিয়ে উঠতে পারে না সামিনা। কোনো কোনোদিন রাকিব চলে গেলে একা নাস্তা করে নেয়। ততক্ষণে শাশুড়ি মা হয়তো দুপুরের রান্না প্রায় শেষ করে ফেলেছেন। চাকরিটা হয়ে যাওয়ায় সকালবেলার এই অনাকাংক্ষিত বিষন্নতাকে ড্রেইন করার একটা রাস্তা পেয়ে গেলো সামিনা।

বাড়ি যাওয়ার দিন অদ্ভুত উচ্ছলতা পেয়ে বসে সামিনাকে। সবকিছু ভালো লাগে। শাশুড়ির কোনো বাঁধাই তেমন কানে না নিয়ে বেশি করে ঝাল দিয়ে নুডল্‌স করে সামিনা। শশুড়ের জন্যে করে কড়া লিকারের দুধ চা। সামিনা ব্ল্যাক কফি করে নেয় ওর আর রাকিবের জন্যে। রাকিব খোঁচায় ওকে। “তোমাকে তো প্রতিদিন বাপের বাড়ি পাঠানো উচিৎ! খুশি উপচে পড়ছে।“

পাত্তা দেয় না সামিনা। কাঁটা চামচে নুডল্‌স তুলতে তুলতে মুখ চেপে হাসে। “মা! একটু নুডল্‌স খেয়ে দেখেন না। ভালো লাগবে ইন শা আল্লাহ!”
“নারে মা! আমার এতো ঝাল সয় না! তোমরাই খাও!”
একটু মন খারাপ করতে যেয়েও সামলে নেয় সামিনা। মাঝে মাঝে মনে হয়, মা ইচ্ছা করেই ওর রান্না কিছু খেতে চায় না। খাওয়া শেষে ঝটপট তৈরী হয়ে নেয় সামিনা। ব্যাগ আগে থেকেই গোছানো ছিল। কোনোমতে বোরকাটা গায়ে চাপিয়ে শশুড়-শাশুড়ির থেকে বিদায় নিয়ে রাকিবের সাথে বের হয়ে আসল। সিএনজি নিলো একটা, রাকিব মাঝ রাস্তায় অফিসের জন্যে নেমে যাবে।

রাকিব নাটকীয় ভঙ্গিতে “ভুলোনা আমায়” বলে নেমে গেল। সামিনা আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। বাসার কাছে এসে দোটানায় পড়ে গেল, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে ভাতিজা আয়মানের জন্যে কী নিবে! আইসক্রীম নিলে ভাবি ঠান্ডার ভয়ে খাওয়াবে না। চিপ্স নিলে খাওয়াবেনা টেস্টিং সল্টের জন্যে। খেলনা কিনে দেওয়া যাবে না, কারণ ওর অনেক খেলনা! ফ্রুট কেক কিনলো এক প্যাকেট। নিজের ছোটবেলার সাথে আয়মানেরটা তুলনা করলে খুব নীরস মনে হয় সামিনার কাছে। কিন্তু ভাবীকে কিছু বলতেও পারেনা সরাসরি।

বাবার বাড়ি আসলেই মনে হয় নিজের ডেরায় চলে এসেছে যেন। বিয়ের আগের থেকেও মা-বাবার সাথে সম্পর্ক এখন আরো দৃঢ় মনে হয়। আদর বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। সামিনা সবার জন্যে ফুলকপির বড়া করেছে সন্ধ্যায়। চা দিয়ে খাচ্ছে সবাই যে যার ঘরে। মা যেখানে আগে পড়াশোনার চাপের কথা বলে রান্নাঘরে ঢুকতেই দিতেন না, এখন সব ছেড়ে দেন সামিনার হাতে। সামিনাও প্রতিদিন রান্না ঘরে ঢুকে না, শখে শখে মাঝেমাঝে। আয়মান ওর মা’র সাথে রুমে। সামিনার মা চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে আসেন। মেয়ের পাশে বসে আরাম করে চপ মুখে দেন।

“মা রিমিরে নিয়ে কি করি বলতো! কিছুই তো বলতে পারি না। যাই বলি মুখ কালা কইরা ফালায়।“
“কেন! ভাবীকে নিয়ে আবার কি হইলো?”
“যে বেভুলা! সব ভুইলা যায়। আটা নিলে আর মুখটা ঠিক কইরা লাগায় না। ভেতরে তেলাপোকা যায়। যদি কই, বলে ওই নাকি লাস্ট আটা নেয় নাই, আমি নিছি। বেভুলা দেইখা আমি নিজেই ও কিছু করার পর আবার যায়া করি। ওইটা নিয়াও মন খারাপ করে।“
“আহা! মা একটু স্পেইস দাও। তুমি আবার যায়া করলে ভাবীর গায়ে লাগবে না?”
“কিছুই তো বুঝেনা সংসারের। ছেলেটার দুই বছর হইছে। সকালে দেরী কইরা উঠে। ছেলেটাও দেরি কইরা খায়। শুকনা কাঠির মতো ছেলেটা। কিছু কইলে কয় ঠিকই নাকি আছে। এই বয়সে নাকি এই হাইট ওয়েটই থাকার কথা। কীসব বেবিসেন্টার না কিসের কথা কয়…ইন্টারনেট দেইখা বাচ্চা পালে… আমরা কি পালি নাই, কিছুই জানিনা?”

“আচ্ছা মা! বাদ দাও! আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে! আল্লাহ্‌র কাছে দুআ করো। যাতে ভাবীর বুঝ আসে!”
“হ! তুমি তো আবার ঐ দলের লোক। মনেই থাকেনা!”
মা টিপ্পনী কাটেন। সামিনা হাসে। ভাবীকে ঐ পছন্দ করেছিল ভাইয়ার জন্যে। ইসলামীমনা আপুদের একটা গেটটুগেদারে রিমি আপুর সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছিল। হাসিখুশি প্রাণবন্ত একটা মেয়ে। এতো উচ্ছল মেয়েটাকে যে কেউ চাইবে পরিবারের একজন করে নিতে। বিয়ের প্রথমদিকে ভাবীর উচ্ছলতা তেমনই ছিল। তারপর কয়েকমাস পরই আয়মান পেটে আসলো। তখন থেকেই হাসিখুশি মেয়েটা বদলে গেলো কিনা অতটা মনে নেই সামিনার। তবে প্রিয় আপুরা প্রিয় ভাবি হবে এমন গ্যারান্টি নেই, এটা ঠিক বুঝেছে।

এখন তো কত রকম ডিপ্রেশনের কথা শুনে। বাচ্চা হওয়ার পর আসলো পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন। কিছু এদিক সেদিক হলেই আকারে ইঙ্গিতে ভাবী ফেইসবুকে পোস্ট দিতো মায়ের নামে। ভাইয়াকে একদিন সরাসরি ধরেছে সামিনা। ভাই উলটো বলে দিলো ভাবীকে নাকি এখন বেশি করে ‘সাপোর্ট’ দেয়া দরকার। ভাইয়ের বদলে যাওয়া দেখে অনেক কষ্ট পেয়েও সামিনা কিছু বলেনি। সপ্তাহে অন্তত একদিন আজব পোস্ট দিবেই ভাবী। সেদিনও দিলো একটা ফতোয়া সাইটের লিংক, যেটায় বলা আছে যে শশুড়-শাশুড়ীর সাথে একসাথে থাকা সুন্নাহ নয়। মেজাজ বিগড়ে গেলেও সৌজন্যতার লাইক দিতে ভুলেনি সামিনা। তার মা-বাবা কী এতোটাই বিরক্তির কারণ হয়ে গেছে ভাবীর কাছে!

প্রতিবার বিদায় নেয়ার সময় মায়ের চোখে পানি চিকচিক করে। সবার থেকে বিদায় নিয়ে সিএনজিতে উঠে সামিনা। ভাবির শুকনো হাসিটাকে একটা মুখোশ মনে হয়। যে মুখোশটা কোনো এক ভুলে সে পরে ফেলেছে। একটান দিয়ে যদি একদিন খুলে ফেলে সেই আগের মেয়েটাকে পাওয়া যেতো! চিন্তার গভীরে ডুবে যায় সামিনা। সেও একটা বাড়ির বউ। সে এখন অনেকটাই বুঝে যে, মা যেমনটা ভাবেন ভাবী সংসারের ব্যাপারে ততটা অবুঝ নন। হয়তো অল্প কিছু কৌশলেই এই সম্পর্কগুলো সুন্দর হতে পারে। সংসার মানে শুধু বউ-শাশুড়ি না হলেও মনের রসায়নের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় এই দুইজনকেই প্রধান মনে হয়।

নিজের মাকে সরল সোজা আর ভাবী-শাশুড়িকে কুচুটে ভাবার এই যে চক্র এটা তো কাউকে না কাউকে ভাংতে হবে।আলাদা সংসার হলে স্বাধীনতা আছে হয়তো,কিন্তু মিলে মিশে থেকে মানুষের অত্যাচার সহ্য করার সওয়াবটা কোথায়! খুব বেশি অত্যাচারী কেউ হলে, আলাদা থাকা অবশ্যই উচিত। কিন্তু ছোটখাটো মনের লড়াই হেরে যাবে কেন সামিনা?

তার শাশুড়ি তো বাবা মা তুলেও খোটা দেন না, যৌতুকের দাবিও করেন না। সবকিছু কী এই দুনিয়ায় পাওয়ার কথা ছিল? অফিসের বস ডোমিনেটিং হলে কি সামিনা চাকরি ছেড়ে দিবে! বড় ভাই-বোনের খবরদারিতেও তো কতজনের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। তাই বলে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা যায়! আজ শাশুড়ি আর ভাবীর মুখ শুকনো শুকনো লাগে, কাল কারণে অকারণে ছেলের বউয়ের মুখ শুকনো মনে হবে না তো ! কে যেন একবার বলেছিল, ‘শাশুড়িরা হাসলেও দোষ, না হাসলেও!’ জ্যামে আটকা পড়া সিএনজিতে এক মনে ভাবতে থাকে সামিনা।

সিএনজি বিরক্তিকরভাবে কাঁপছে, চিন্তারাও অনুরণিত হচ্ছে। সবকিছু নতুন করে চেষ্টা করতে ইচ্ছা করে কোনো কোনো দিন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে যায়নি কোনোদিন সামিনা। প্রতিটা সম্পর্কেই চড়াই উতরাই থাকে। নিজের মা ভালো শাশুড়ি নন, অথচ কী ভালো মানুষটা। রাকিবের চোখে হয়তো রাকিবের মা-ই সেরা …ভাবনায় ছেদ পরে ফেইসবুক নোটিফিকেশনে। শারমিন আপুর সব পোস্টের নোটিফিকেশন আসে ওর। আপু নতুন কিছু লিখেছে। পুরুষ সমাজকে একদম ধুয়ে দিয়েছেন পুরো লেখাটায়। লেখার নিচে ডিসক্লেইমারে বলে দেয়া আছে যে তার স্বামী এমন নয়!

আচ্ছা সবার শাশুড়ি খারাপ, শুধু তারটা ভালো; সবার স্বামী খারাপ, তারটা ভিন্ন; সবার ইসলামী দৃষ্টিভংগিতে সমস্যা, শুধু তার মতাদর্শীরা ঠিক; নিজে চাকরি করলে কর্মজীবী মেয়েরা সেরা, নিজে ঘরে বসে থাকলে গৃহিনীরা অতুলনীয়-কেমন যেন লাগে এই বৈপরীত্যগুলো। সবার থেকে শেখার একটা মানসিকতা থেকেই তার পোস্টগুলো পড়া হয়। কিন্তু কোনো একটা লেখা যদি নেগেটিভ চিন্তাকে আরও বাড়িয়ে তোলে, অন্যদের মাঝে হতাশা জাগিয়ে বলা হয়, ‘মেয়ে তুমি ভালো নেই, শুধু আমি আমার অবস্থানে ঠিক’; এধরনের কিছু পড়লে লাভ কোথায়। আজ সকালেই প্রথম আয়োডিনযুক্ত লবণ সামিনার বুদ্ধির বিকাশে সহায়তা করলো কিনা ও ঠিক জানে না, নোটিফিকেশন সেটিংসে চেইঞ্জ আনলো সে।

সিএনজি থামলো শশুড়বাড়িতে। কাছের হোটেল থেকে মচমচে গরম জিলাপি কিনে নেয় সে। শাশুড়ির খুব পছন্দের, যদিও সামিনা কিনেছে বলে নাও খেতে পারেন তিনি।

“বেশি মিষ্টি আমার সবসময় সয় নারে মা!” ভাবতে ভাবতে হেসে ফেলে সামিনা।

বেল দিতে দিতে ভাবে,” ‘খেলা হবে!’ ইন শা আল্লাহ, যতক্ষণ না সাধ্যের অতিরিক্ত হয়ে যায়!”

কঠিন কাজ সহজ করার দুআ আর বিপদে পড়ার দুআটা পড়ে নেয় মনের যুদ্ধ শুরুর আগে। কচ্ছপের কামড় দিয়ে ধরে রাখার স্বভাবটা থেকে মুসলিমদের অনেক শেখার আছে।

…………………………..

শাশুড়িরাও মানুষ
উম্মে লিলি
২৬ অক্টোবর ২০১৮