সুখটান

(১)

ভার্সিটি এলাকার স্থানীয় ছেলে হুমায়ূন। এলাকার ছেলে হলেও সিট সংকটের কারণে হলে সিট পাচ্ছিল না সে। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে বছর খানেক আগে হলে সিট পেয়েছে হুমায়ূন। হুমায়ূনের নতুন রুম-মেট নাসির। নাসির ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। ভার্সিটিতে আসার পর থেকে যেন খাঁচার বাঁধা পাখি হঠাৎ ছাড়া পেয়েছে। সারাদিন নতুন বাছুর ছানার মত যেখানে পারছে ছুটে বেড়াচ্ছে, সারাক্ষন মুখে হাসি, কানে হেডফোন, হাতে মোবাইল।

ভার্সিটির বড় ভাইদের দায়িত্ব ছোটগুলাকে ছলে-বলে-কৌশলে একটু মানুষ করা। হুমায়ূনের রুমের বড় ভাইও করে গেছেন, হুমায়ূনও নাসিরের ক্ষেত্রে চেষ্টা করেছে তবে খুব বেশী একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হলো না। ফার্স্ট ক্লাস টেস্টের পর সব ছন্নছাড়ার দল নিজ থেকেই ট্রেনের লাইনের মত অনেকটা সিধা হয়ে গেল।

(২)

নাসির এখন সেকেন্ড ইয়ারে। দিন-রাতের বেশীরভাগ সময় নিজের রুমে সে থাকে না বললেই চলে। ক্লাস শেষে হলের পুকুর পাড়ে বসে থাকে। গভীর রাতে রুমে এসে ঘুমায়। বন্ধুদের নিয়ে পুকুর পাড়ে বসে সারা দিন-রাত সিগারেট টানে, গল্প করে, গান গায়। খাওয়া, গোসল, পড়া কিছুরই খবর নাই তাদের। পরীক্ষার রুটিন দেয়ার আগ পর্যন্ত একই অবস্থা চলবে বলে মনে হচ্ছে।

(৩)

নাসিরের প্রচন্ড্র জর আর কাশি। “ভাই, যক্ষা হইছে মনে হচ্ছে, আর বাঁচবো না। ভুল-ভাল যা করেছি মাফ করে দিয়েন।” নাসির হুমায়ূনকে বলে।

নাসিরের কাশির চোটে ঘুম হয় না হুমায়ূনের। “হুম। তুমিও মাফ করে দিও।অ্যাান্টিবায়োটিকগুলা সময়মত খাও। আর বেশী করে আসতাগফিরুল্লাহ পড়। মরার আগে বেশী করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়া উচিত।” নাসির হেসে উঠতে যেয়েও হাসে না। মৃত্যু এমন এক বাস্তবতা যা অবিশ্যম্ভাবী জেনেও মানুষ এমন ভাব করে যেন সে কোনদিনও মরবে না।

(৪)

হুমায়ূন তার খুব কাছের কিছু মানুষকে ওদের বাসায় দাওয়াত দিয়েছে। রুম-মেট হিসেবে নাসিরও আছে তাদের মাঝে। খাওয়া-দাওয়া শেষে সব ছেলেরা বারান্দায় বসে আছে। কেউ কেউ বাগান ঘুরে দেখছে। ব্যালকনি আর বাগান পেরিয়ে গেইটের কাছে গিয়ে সাদিব, জাকির, অজয়, সাকিব আর নাসির সিগারেট ধরিয়েছে।

অল্পক্ষণেই জায়গাটা সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরে যায়। এমন সময়ই ২ জন বয়স্ক মানুষ গেইট দিয়ে ঢুকে। একজন হুমায়ূনের ছোটো ভাই আনিসের আরবী শিক্ষক আর অপরজন হুমায়ূনদের ভাড়াটিয়া, একজন শুকনো লিকলিকে বিদেশী ভদ্রলোক। খুব কষ্ট করে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসছে লোকটা।

ছেলেরা হুজুরকে সালাম দিয়ে সরে দাঁড়ায়। গেইট পার হয়েই ধোঁয়ায় তাঁদের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। বিদেশী ভদ্রলোক কাশতে কাশতে ব্যালকনিতে বসে পড়েন। হুমায়ূন আর বাকি ছেলেরা ব্যাস্ত হয়ে উঠে। কেউ পানি এনে দেয়, কেউ বাতাস করে। বয়স্ক হুজুর ছেলেদের উদ্দেশ্যে বলেন, বাবারা, পান, জর্দা, সিগারেট খাওয়া এমন বদ অভ্যাস যা নিজের ক্ষতির পাশাপাশি অন্য মানুষেরও ক্ষতি করে।

সিগারেটের ধোঁয়া আশেপাশের মানুষের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত করে। কারো কি কোন অধিকার আছে অন্যের ক্ষতি করার? এমনকি নিজের ক্ষতি করারও কারো অধিকার নাই। কারণ এই শরীর আল্লাহর দেয়া আমানত ছাড়া কিছু না। মহান আল্লাহ বলেনঃ “তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিও না।” (সুরা বাকারাঃ ১৯৫) ” ; “তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না।” (সুরা নিসাঃ ২৯) । আল্লাহ্ আরো বলেছেন- “যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে। (সুরা আল আহযাবঃ ৫৮)। এই ক্ষতিকর হারাম নেশা তোমরা ছেড়ে দাও বাবারা। ছেড়ে দাও।

সবাই চুপচাপ শুনছিল। তখন বিদেশী ভদ্রলোক একটু ধাতস্থ হয়ে উঠেন।

মোটামুটি বাংলায় বলে উঠেন, আমি ভেক্টর। সিগারেটের ধোঁয়ায় আমার খুব কষ্ট হয়। আমি হুমায়ূনের পেয়িং গেস্ট। তোমরা নিশ্চয়ই ওর বন্ধু? ভেক্টর মেহমানদের সবার সাথে পরিচিত হন। উনার গলার স্বর ভাংগা। কথা বলতে যেন কষ্ট হয়। কথা বললে মনে হয় যেন শব্দ না, বাতাস বের হচ্ছে। ভেক্টর তারপরেও কষ্ট করে ছেলেদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, “আমিও চেইন স্মোকার ছিলাম। ১৩ বছর বয়স থেকে সিগারেট খেতাম। ২২ বছর থেকে আমার ইমিউনিটি কমতে থাকে। ঘনঘন জর আর কাশি হয়। ৩২ বছর বয়সে আমার মুখে ঘা হয় যা আর কখনো সারেনি। ৪০ বছর বয়সে আমার কন্ঠনালীতে ক্যান্সার ধরা পড়ে। ৩ বছর চিকিৎসার পর সুস্থ হই। এরপর ৪৭ বছর বয়সে আমার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর আবার দীর্ঘদীনের চিকিৎসা চলে। ৫৫ বছর বয়সে মাইল্ড স্ট্রোক করি। এখন আমার বয়স ৬২।” ভেক্টর মাথায় হাত দিয়ে তার উইগ খুলে ফেলেন। ” আজ ২২ বছর ধরে আমার মাথায় কোন চুল নেই। মুখ একদিকে বেঁকে গেছে। কথা বলতে খুব কষ্ট হয় । আমি চাই না কেউ নিজ হাতে আমার মত যন্ত্রনার জীবন বেছে নিক। তোমাদের বয়স কম। সামনে সারাটা জীবন পড়ে আছে। তোমরা নিজ হাতে নিজেদের সর্বনাশ করো না।এখন আর আমার সামান্য ধোঁয়াও সহ্য হয় না। আমি এখন ডাক্তারদের সাথে ক্যান্সার সচেতনতারই কাজ করি। “

একসাথে অনেক কথা বলে ভেক্টর আবার কাশতে শুরু করে। হাঁপানীর মত টান উঠে যায় উনার। আনিস নেবুলাইজার আনতে দৌড় দেয়। মুহূর্তেই এক ভীতিকর পরিস্থিতির জন্ম হয়। নেবুলাইজারের পর অক্সিজেন মাস্ক মুখে দিয়ে আবার কিছুটা ধাতস্থ হন ভেক্টর। হুমায়ূন আর আনিস মিলে উনাকে দোতালায় উনার ফ্ল্যাটে রেখে আসে।

ঘটনাটা দাগ কাটে সবার মনে। নাসিরের মনে হয় টেস্ট করলে নিশ্চয়ই এখন তারও ব্রংকাইটিস ধরা পড়বে। অজয় নিজের গলায় হাত বুলাতে বুলাতে ভাবে, কে জানে তারও কণ্ঠনালীর ক্যান্সার আছে কিনা? প্রায়ই তো তার মুখের ভেতরে ঘা হয়!

সাকিব পকেট থেকে সিগারেট বের করে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে, এটাকে সে বন্ধু ভাবতো আর এটা এতই বড় শত্রু? সাদিব সাকিবের সিগারেটের দিকে তাকিয়ে থাকার দিকে তাকিয়ে তার বাবার কথা ভাবে। উনিও চেইন স্মোকার ছিলেন। কিডনি ফেইলীওরে মারা গেছিলেন। মরতে হবে সবাই জানে কিন্তু ধুঁকে ধুঁকে মরার একটা ভয় যেন সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়ে যায়।

সুখটান
উম্মে ইব্রাহীম

অগাস্ট ২৪, ২০১৯ইং