সুখের নীড়

সানা নিজেকে অবাক করে দিয়েই বিকট শব্দে চিৎকার করে বললো, “হ্যাঁ হ্যাঁ সব দোষ তোমারই!”

এইটুকু বলেই কান্নায় ভেঙে পরলো। ও জীবনে কখনোও ভাবেনি এভাবেও ওকে কথা বলতে হতে পারে। যখনই ও কিছু ঠিক করতে চেষ্টা করে সবটা এলোমেলো হয়ে যায়। নিজেকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আবার কাউকে বুঝাতেও পারে না।

অবাক হয়ে সানার দিকে তাকিয়ে আছে মিনা ও টিনা।

“হুহ! আর তুমি যে কারো কথা শোনো না!? এটা কিছু না, তাই না!!” বললেন মরিয়ম বেগম।

কোনো উত্তর না দিয়েই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সানা।

সবুর সাহেবও কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে কপালে হাতড়াচ্ছেন। যেন এটা কপাল না, কাঁচা মাটি। খুব হাতড়ে এখনি এই মাটি দিয়ে অসাধারণ কিছু বানিয়ে ফেলবেন তিনি।

এই পরিবারের নিত্যদিনের ঘটনা এটা। আজ এই ঠোটের যুদ্ধ শুরু হয়েছে সকালে নাস্তার টেবিল থেকে।

মরিয়ম বেগমের শরীরটা কিছুটা খারাপ। তাই উঠতে দেরি করলেন আজ। সানা, মিনা ও টিনা রান্নাঘরে নাস্তা তৈরি করতে গেলো। মিনার সামনে পরীক্ষা। তাই সানা মিনাকে কোনো কাজ করতে নিষেধ করে পড়তে বসতে বললো। নিজে ও ছোটবোন টিনা মিলে নাস্তা তৈরি শুরু করলো। সেই থেকেই ঠোঁটের যুদ্ধ শুরু।

সানা ছয় বছর সংসার করে এখন ডিভোর্স নিয়ে বাবার সংসারে আছে। নিজের অস্তিত্বই নিজের কাছে বোঝা মনে হয় তার। এই বাড়িতে তার কোনো মূল্য নেই৷ ভালো কথা বললেও দোষ হয়ে যায়। আজ সকালে শুধু মিনাকে বলেছিলো, “এখন তোমার কাজ করতে হবে না, তুমি পড়ো আমরা কাজ করি” ব্যস তাতেই লঙ্কা কান্ড হয়ে গিয়েছে।

মিনার দু’মাস পর পরীক্ষা। নিজেকে যথেষ্ট দায়িত্বশীল মনে করে ও৷ সকাল থেকে দেখছে মায়ের শরীরটা খারাপ। বড় বোনেরও মানুষিক অবস্থা কেমন তা মিনা ভালোই জানে। প্রতিরাতেই আপুর কান্নায় ঘুম ভাঙে মিনার৷ কিছু বলতে পারে না৷ সান্ত্বনা দেয়ার কোনো ভাষা ওর জানা নাই৷ প্রতি দিন সকালটা শুরু হত বুকের উপর ভাড়ি পাথর চেপে। আপুর রাতভর কান্না যেন সে কিছুই জানে না এমন ভাব করে। আজ রাতেও সারারাত আপু কেঁদেছে। মিনাও ঘুমাতে পারেনি। এখন এই অবস্থা নিয়ে নাকি আপু নাস্তা বানাবে আর মিনা আরাম করে বসে বসে পড়বে। বড়দের সব কথা শোনা অর্থহীন। তাই সে উঠে নাস্তা বানাতে গিয়েছে। ব্যাস তাতেই লঙ্কা কান্ড হয়ে গিয়েছে।

বাবা, মা ও বড় দু’বোন। সবার উপরই খুব রাগ হচ্ছে টিনার। সবাই এমন কেন। কেউ কাউকে বুঝতে চায় না। সবার ছোট টিনা। তাই তার খুব অর্থপূর্ণ কথাও সবার কাছে অর্থহীন। চোখ মুখ কুচকুচে পড়ার টেবিলে বসে আছে টিনা।

মরিয়ম বেগমের মাথা ব্যথাটা আরো বেড়েছে। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে তার৷ সারাজীবনের সব শ্রম বৃথা মনে হচ্ছে। সন্তান্দের সঠিক শিক্ষা দিতে পারেন নি, তিনি। এই ব্যার্থতায় গুমড়ে গুমড়ে মরেন রোজ।

সবুর সাহেব ঘরের এক কোণে বসে সংবাদপত্রে মুখ গুজে আছেন। তার মাথায়ও একই চিন্তা। সংসারটা এমন ঠোঁটের যুদ্ধক্ষেত্র কেন হয়ে গেলো।

………………………………

‘পরিবার’ আমাদের বিশ্বাসের এক দৃঢ় জায়গা। যেখানে আমি আমার মত থাকতে পারি। কিন্তু প্রায়ই আমাদের পরিবারগুলো এমন ঠোঁটের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিনত হয়। আমরা বুঝি না কি করা উচিত। নিজেদের বুঝি না। আপন জনদেরও বুঝি না। সেই সময়টা নিজেকে সবচে’ অসহায় মনে হয়। যেন এই বিশাল পৃথিবীতে আমি একা। কেউ বুঝে না আমায়। সারাক্ষণ মনে হতে থাকে কেউ আমায় ভালোবাসে না৷ কেউ আমার কেয়ার করে না। অতীতের সব ভুলগুলোর স্লাইড শো চলতে থাকে মাথার ভেতর।

কিন্তু, এমনটা কেন হয়?

কেন আবার, এটা আমাদের একমাত্র প্রিয় শত্রু শয়তানের কাজ৷ ‘প্রিয়’ শব্দটায় অবাক হচ্ছেন? প্রিয় কারো কথাই তো আমরা নির্দ্বিধায় শুনে থাকি, তাই না? তো শয়তান আমাদের যা বলে তাও তো আমরা কোনো আর্গুমেন্ট ছাড়াই নির্দ্বিধায় মেনে নেই৷ তাহলে শয়তান তো আমাদের প্রিয় শত্রুই হলো।

তো প্রিয় শত্রুর কাজ হলো আমাদেরকে সারাক্ষণ বিভ্রান্ত করে রাখা। একজন মানুষের শিকড় তার পরিবারে যখন সে আঘাত আনতে পারে তখন তার জন্য কাজটা সহজ হয়ে যায়৷ তাই আপনা আপন মানুষদের বেশি ভুল বুঝি।

যেমন, মা বকা দিলে বকা খাওয়ার কারণ না খুঁজে আমাদের মনে চলতে থাকে, “সামান্য ব্যপারে মা এতো চিল্লায় কেন!” এর সাথে সাথে আগের সব বকার স্লাইড শো তো আছেই।

তাই, যখনই কারো ব্যপারে মনে এমন নেগেটিভ (শুধু পরিবারের মধ্যে না; পরিবারের বাইরের কেউ হলেও) চিন্তা মনে আসবে তখনই ‘আউজুবিল্লাহ্’ পড়ে নিন। নিজে কে মনে করিয়ে নিন, “অহেতুক ধারণা করা যাবে না।” প্রিয় শত্রুকে প্রশ্রয় দিবেন না। এই মানুষগুলোর আপনার উপর করা ইহসানের কথা স্মরণ করুন। যেমন, যদি বোনের সাথে মনোমালিন্য হয় তাহলে স্মরণ করুন বোনটি আপনার জন্য এ পর্যন্ত কত কিছু করেছে। ছোট ছোট আনন্দগুলো মনে করুন৷ যদি বাবার সাথে মনোমালিন্য হয়, স্মরণ করুন এই মানুষটা নিজের জীবনের সবটুকু দিয়ে আপিনার স্বপ্ন পূরণ করতে কাজ করে যাচ্ছে।

তবুও যদি ঠোঁটের যুদ্ধ শুরু হয়েই যায়, ভালো কথা বা হাসির কথা বলে প্রসঙ্গ পাল্টাতে চেষ্টা করুন, চুপ থাকার চেষ্টা করুন। স্থান পরিবর্তন করুন। ওযু করে নিন। কিছুতেই কাজ না হলে আল্লাহ কে বলুন, “আল্লাহ আমার পরিবারে তোমার রাহমাহ্ দাও৷ আমাদের মনোমালিন্য দূর করে দাও৷ শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে আমাদের হেফাজত করো।”

মনের মালিক তো একমাত্র তিনিই, তাই না?

………………………..

দুপুরে খাবার টেবিলে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো সানার। সব তার পছন্দের খাবার করা হয়েছে আজ। মিনা ও টিনা খুব নাটকীয় ভঙ্গিতে সানাকে এটা সেটা বেড়ে দিচ্ছে। সবুর সাহেব তার কলেজ জীবনের মজার কোনো ঘটনা বলছেন। কাথার ফাঁকে ফাঁকে মিনা টিনা খিলখিল শব্দ করে হাসছে। মরিয়ম বেগম এখনো খুব গম্ভীর হয়ে আছেন।

সানা ছোট্ট স্বস্তির শ্বাস ফেলে মনে মনে, “আলহামদুলিল্লাহ” বললো। এতো অসাধারণ পরিবার আর কয়টা আছে!

…………………….

“সুখের নীড়”
নুসরাত জাহান মুন
২৩ অক্টোবর ২০১৮