অন্যরকম ঈদ

[এক]

রৌদ্রময়ীরা জানতে চাইল আমার মুসলিম জীবনের প্রথম ঈদ সম্পর্কে। প্রথম ঈদটা আসলে বাবার বাড়িতে থাকাকালীন যেনতেনভাবে কেটেছিল। আজ আমি শোনাব আমার স্বাধীন-জীবনের প্রথম ঈদের গল্প।

আমার বিয়েটা হয়েছিল ২৬ রমাদান, ১৪৩০ হিজরী। বাসা থেকে পালিয়ে এসেছিলাম১, ফলে ঝামেলা এড়াতে বিয়ের জন্য সকালের সময়টাই বেছে নিয়েছিলাম। যদিও পাত্রপক্ষ দেরি করাতে যুহরের পর নিকাহ সম্পন্ন হয়েছিল, শ্বশুড়বাড়িতে পৌঁছেছিলাম আসরের পর।

এদিকে ঘটতে লাগলো একের পর ঘটনা। মাগরিবের আগে শাশুড়ি ইফতারি তৈরিতে ব্যস্ত রান্নাঘরে; হঠাৎ খবর পেলেন, আমার মা বিয়ের কথা জেনে গেছেন। অফিস থেকে মা নাকি ছুটে আসছেন এখানে। মার আসার খবর পেয়ে এতটাই বিচলিত হয়ে পড়লেন যে চুলায় কড়াই ভর্তি নুডুলসে শাক ঢেলে দিয়ে নাড়তে লাগলেন তিনি!

উদ্ভ্রান্ত হয়ে ছুটে আসার পর কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে ছিলেন আমার অমুসলিম মা। তার সবচাইতে আদরের মেয়েটা হঠাৎ পালিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে, তাও আবার এক মুসলিমের সাথে হুজুর পরিবারে। এখানে এসে দেখেন তারা মেয়েকে অন্য নামে ডাকছে, নামাজ পড়তে বলছে। এত বড় শকের কারণে যেন হত-বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে অবশ্য সহজ হয়েছিলেন, সে অন্য কাহিনী। আল্লাহ তাকে হিদায়াত দিন!

তো মা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন; বলেছিলেন পরে সবাইকে জানিয়ে, অনুষ্ঠান করে পরে এখানেই বিয়ে দিবেন। সমাজের ভয় করছিলেন তিনি। আমি যাইনি। ঐ অভিশপ্ত জীবনে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। এখানেই থেকে গেলাম, উদযাপন করলাম জীবনের প্রথম ঈদ।

এই পরিবারের জীবনযাত্রা আর এখানকার পরিবেশের সাথে আমার বিগত পরিবারের আকাশ পাতাল পার্থক্য! কাজেই শুরুতে এক একটা মুহূর্ত বেশ উপভোগ করেছিলাম। জীবনে প্রথম পুরো একটা পরিবারের সাথে একসাথে বসে ইফতার করেছি। বাবার বাড়িতে গোপনে সিয়াম পালন করতে হতো, লুকিয়ে সাহরি-ইফতার করা লাগতো। ফরয সলাতটাও আদায় করতে পারতাম না। সেদিন খাঁচার বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া বনের পাখির মতই স্বাধীন মনে হচ্ছিল নিজেকে। হয়তো একারণেই, সেই সময়ের প্রতিটা মুহূর্ত আজও মনে গেঁথে আছে আমার। মনে হয়, এই তো সেদিন…

[দুই]

মাগরিবের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার সাথে সাথে সবাই সুন্নাহ অনুসরণ করে আগে খেঁজুর মুখে দিয়ে রোজা ভাঙলাম, এরপর পানি। মাগরিবের সলাত আমরা জামা’তে আদায় করেছিলাম। পরিবারের পুরুষরা সামনে, আর মহিলারা পেছনে। বাসার কাজের মেয়েটাও মালিকের সাথে পায়ে পা, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাড়িয়েছিল। ইসলামের সৌন্দর্য এখানেই। এই জীবন-বিধানে ছোট-বড় দুনিয়ার সবাই এক উম্মাতের সদস্য, যেন এক পরিবার।

সাত তলার উপরে ছিল বাড়িটা। আমার শৌখিন শ্বশুর বানিয়েছিলেন ছাদের উপর, বাংলো স্টাইলে। উপরে টালি দেওয়া ছাদ, একপাশে ছোটখাটো একটা বাগান। আশেপাশে আর কোনো উঁচু বিল্ডিং না থাকাতে চারদিক দিয়ে সুবিশাল বর্ণিল আকাশটা দেখা যেত।

সেদিন মাগরিবের সলাত শেষে দিগন্তে অস্ত যাওয়া রক্তিম সূর্যটার দিকে তাকিয়ে জায়নামাজে বসেছিলাম অনেকক্ষণ। রসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম) সুন্নাত অনুসরণে হাতের কড়ে গুনেছিলাম তাসবীহ-তাহমীদ-তাকবীর। প্রত্যেকটা জিকর অন্তর থেকে বেড়িয়েছিল সেদিন। চোখ দুটো সিক্ত হয়েছিল আমার রবের প্রতি কৃতজ্ঞতায়, ভালোবাসায়।

[তিন]

সে রাত ছিল সাতাশ রমাদানের রাত।
সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে কিতাব নাজিল হয়েছিল রমাদানের শেষ দশকের কোনো এক বেজোড় রাতে। মুসলিমরা তাই এই রাতগুলো সেই বিশেষ রাতের সন্ধানে, রাতভর ইবাদাত করে কাটিয়ে দেয়। শান্তিময় মহান এই রাতে প্রতিবছর মালাইকারা নেমে আসেন। এ রাতে রয়েছে বিগত এক বছরের পাপের ক্ষমার সুযোগ, আগামী এক বছরের ভাগ্য নির্ধারণ হয় মহিমান্বিত এই রাতে।

সে রাত ছিল আমার বাসর রাত। স্বাধীনতার প্রথম রাত। নতুন বন্ধুত্বের সাথে নতুন অভিযাত্রার শুরু। দু’জন একসাথে সলাত আদায় করেছিলাম। আল্লাহর কাছে প্রাণভরে দুয়া আর ইবাদাতের মাধ্যমে হয়েছিল জীবনের সেই নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

[চার]

সেবারই প্রথম আমি আক্ষরিক অর্থে ঈদ উদযাপন করতে পেরেছিলাম। সারাজীবন অমুসলিম পরিবেশে বেড়ে ওঠার দরুন ঈদের আনন্দ মানে কী কোনো ধারনাই ছিল না।

ট্যাবলয়েডে দেখা ঈদ ফ্যাশন, ঈদ শপিং আর নারীদের লোক দেখানো ঈদের সাজ, বাহারি রেসিপি আসলে ঈদ না। ঈদ মানে রাতে খোলা ছাদে নতুন চাঁদ দেখার উচ্ছ্বাস, মাসজিদে মাসজিদে চাঁদ দেখার ঘোষণা, মাইকে ঈদের তাকবীর, এলাকার বাচ্চাদের হৈ হুল্লোড় আর বাজি ফোটানো, হাত ভরা মেহেদির নকশা, সকাল সকাল সবাই মিলে ঈদগাহে যাওয়া..। আমার ঈদ…সব আনন্দ যেন আজ আমার ঈদের জন্যই।

এই প্রথম আমার নামে সাদাকাতুল ফিতর আদায় হলো। ঈদ-উল-ফিতরে ঈদের সলাতের আগে পরিবারের প্রত্যেক মুসলমানের নামে এই সাদাকা দেওয়া সম্পর্কে আগে কিছুই জানা ছিল না। অথচ ধনী-গরীব প্রত্যেকে যেন ঈদের দিন খেতে পারে – তার জন্যে কত সুন্দর একটা বিধান।

ভোরে উঠে গোসল সেরে পরিবারের সবাই মিলে ঈদগাহে গেলাম। এদেশে মেয়েদের জন্যেও যে এরকম ব্যবস্থা আছে তাও সেই প্রথম জেনেছিলাম। এতদিন জানতাম ঈদগাহে শুধু পুরুষরাই যায়। যদিও মেয়েদের নিজ বাড়িতে নিজের ঘরে সলাত আদায় করা মাসজিদে যাওয়ার চাইতে উত্তম, ঈদের সলাতের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহর রসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম মেয়েদের ঈদগাহে যেতে আদেশ করেছেন।২ সেখানে গিয়ে দেখি মহিলাদের জন্য মাঠে পর্দা ঘেরা আলাদা সলাতের ব্যবস্থা। হাসিমুখে নতুন বউকে অভিবাদন জানাতে এগিয়ে এসেছিল সবাই। এখন তো আমি তাদেরই একজন। এরপর গত দশ বছরে একবার ছাড়া আর কোনো ঈদের সলাত বাদ দেইনি আলহামদুলিল্লাহ্‌।

[পাঁচ]

“নতুন বউদের প্রথম ঈদে বেড়াতে বের হওয়ার আগে বাসায় কিছু খেতে হয় না” – এই তথ্য আমার জানা ছিল না। ভরপেট নাশতা খাওয়ার পর বর সাথে নিয়ে বের হলেন কাছাকাছি থাকা তার আত্মীয়দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। ভালোবাসার অনুরোধে ঢেঁকি গিলে প্রত্যেক বাড়িতে কিছু না কিছু খেয়ে আমার অবস্থা হলো শোচনীয়।

বিকালে বাসায় ফিরে ঘরে গিয়ে ধপাস করে বিছানায় বসলাম, আর সাথে সাথে ভূমিকম্প শুরু হলো! সাত তলার উপরে বলেই কি না জানি না — আমাদের হতবাক করে দিয়ে পুরো ঘরটা নড়ছিল কয়েক সেকেন্ড ধরে।

আলহামদুলিল্লাহ্‌ মুসলিম পরিবারে ঈদ উৎযাপন কাকে বলে, ঈদের আনন্দ আসলে কী তা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম সেবার। এক মাস সিয়াম পালনের পর মু’মিনদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের একটা দিন, এই আনন্দ শুধু সিয়াম পালনকারী মুসলিমদের জন্যই। আবার মহিমাময় মাস রমাদান শেষ হয়ে যাওয়াতে কষ্টও লাগে না যে তা না। বাবার বাড়িতে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল এই মাস জুড়ে, জীবনের কঠিনতম সময়গুলো পার করেছিলাম। সেই স্মৃতিগুলোও কখনো ভোলার নয়।

[ছয়]

এরপর দশ দশটি বছর কাটিয়ে দিয়েছি এ পরিবারে। শুরুতে একজন আগন্তুক ছিলাম; এখন এটা আমার নিজের পরিবার, নিজের সংসার। বছর ঘুরে রমাদান আসে, রমাদান যায়। আল্লাহর পরীক্ষাও আসে, যায়। কিন্তু বিয়ের পর প্রথম রমাদান আর ঈদের দিনটির তুলনা আর হয় না। একজন নওমুসলিমের জীবনে স্বাধীনভাবে পালন করা প্রথম রমাদান, প্রথম ঈদ। অনুভূতিটা কেমন ছিল তা শুধু আমার রব ভালো জানেন।

পরিশেষে, সকল মুসলিমকে জানাই ঈদ মুবারাক!

تقبل الله منا ومنكم

…………………………

অন্যরকম ঈদ

সিহিন্তা শরীফা

জুন ০৬, ২০১৯ইং

[১] সমকালীন প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বই “ফেরা” দ্রষ্টব্য।

[২] উম্মে আতিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন – “আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেন আমরা যেন মহিলাদেরকে ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আযহাতে সালাতের জন্য বের করে দেই; পরিণত বয়স্কা, ঋতুবতী ও গৃহবাসিনীসহ সকলকেই। কিন্তু ঋতুবতী মেয়েরা (ঈদগাহে উপস্থিত হয়ে) সালাত আদায় থেকে বিরত থাকবে তবে কল্যাণ ও মুসলিমদের দোয়ায় অংশ নিবে।” তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মাঝে কারো কারো ওড়না নেই। (যা পরিধান করে আমরা ঈদের সালাতে যেতে পারি)।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সে তার অন্য বোন থেকে ওড়না নিয়ে পরবে।” [বুখারি: ৯৭৪, মুসলিম: ৮৯০]