অপেক্ষা

অনেকদিন নিতান্ত অবহেলায় পরে আছে ঘরটা। টেবিলের উপর তো এক কেজি ধুলো জমেছে মনে হয়। পেছনের বারান্দায় টবের মেহদী গাছটা শুকিয়ে খড়কুটোর মত হয়ে গেছে। 

খুব পুরোনো একটা শার্ট হাতে নিয়ে একটু ঝেড়ে নিলো আমেনা। সাথে সাথে শরীরের সমস্ত শক্তি সঞ্চার করে সজোরে একটা হাঁচি দিলো। ডাস্ট এলর্জি আছে যে। একদম ধুলো বালি সহ্য করতে পারেন না উনি। আজ আবার অহনার মাও আসেনি। ছুটা বুয়াদের এই একটা সমস্যা! নিজের মন মত ছুটি নিয়ে নেয়। আজ অনেক কাজ করতে হবে!

অবশ্য কাজ করতে খারাপ লাগবে না। মনটা আজ খুব ভালো যে। কত্ত দিন পড়ে ছেলেটা ফোন করেছে। প্রায় বছর ক্ষাণেক পর। নাহ!আমেনা আঙ্গুল গুণে দেখলো পাক্কা তিন বছর পরে! এই ঘরটা বাবুর ঘর।পুরোনো শার্টটা হাতে রেখেই একবার ঘরটার দিকে চোখ বুলালেন আমেনা।

কত স্মৃতি ভরা একটি ঘর। বিয়ের পর এ বাড়িতে প্রথম এ ঘরেই বসানো হয়েছিল তাকে। তখন এটা তার শশুর শাশুড়ির ঘর ছিল। পেছনের বারান্দার পর্দাটা তখন গাঢ় সবুজ রং ছিল। বারান্দা দিয়ে বাবুর বাবার বন্ধুরা উনাকে দেখার জন্য ভিড় করছিলো; তখন শাশুড়ি মা রেগে পর্দা টেনে দিয়ে ছিলেন।

দরজার পেছনে কাপড় রাখার পেরেক ছিলো কিছু। শশুর মশায়ের পাঞ্জাবি ওখানেই রাখা হতো। পাঞ্জাবির পকেট ভর্তি লজেন্স থাকতো। বাবু স্কুল থেকে ফিরেই রোজ দাদাভাই এর পলেট থেকে লজেন্স চুরি করতো। শশুর মশায় অবশ্য লজেন্স গুলো বাবুর জন্যই আনতেন; তবু প্রতিদিন চুরি করা নিয়ে বাবুকে বকতেন। হয়তো এটাই এক প্রকার খেলা ছিলো ওদের।

এসব ভেবে আমেনার ঠোঁটে হালকা একটু মুচকি হাসি দেখা দিলো। পুরনো শার্টটা হাতে নিয়েই ধুলো মাখা খাটের এক কোনায় বসলেন আমেনা। বসতে গিয়ে টের পেলেন মাজার ব্যাথাটা ভালোই বেড়েছে। মনে মনে ভেবে নিলেন, আজ বাবুর বাবা ফিরলে মাজায় একটু মলম ডলে দিতে বলবেন। এই কাজটা করতে বললে বুড়োটা খুব খিটখিট করে। কি আর করা! ওনারও তো ভালোই বয়স হয়েছে। মলম ডলতে গিয়ে হয়তো ওনারও হাতটা ধরে ওঠে। 

তাও তো এখন অনেক কাজ করেন; আগে তো এক গ্লাস পানিও নিজে ঢেলে খেতেন না। পেছনের বারান্দার দরজার বামপাশে মাকড়শার জাল ঝুলছে। ঐ দিকে তাকিয়ে একটি বিরক্ত মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আমেনা। প্রতি সপ্তাহেই অহনার মাকে এই ঘরটা পরিষ্কার করতে বলা হয়। কি কাজ করে মহিলাটা কে জানে! 

টেবিলের উপর পরে থাকা নষ্ট ক্যালকুলাটরটার দিকে তাকালেন আমেনা। বাবুর মেট্রিক পরীক্ষার আগে কেনা। তখন টাকা পয়সার বেশ টানাপোড়ন ছিল। বাড়তি খরচের মধ্যে শাশুড়ি মার ওষুধের টাকা জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হত। পরীক্ষার আগে একটা ক্যালকুলেটরের জন্য খুব সাত পাঁচ ভাবতে হয়েছিল। শেষে বাড়ির পেছনের সুপারি গাছের সুপারি বিক্রি করে বিক্রির টাকা দিয়ে ওটা কেনা।কত বছর আগের নষ্ট ক্যালকুলেটর তবুও আমেনার ওটা ফেলতে ইচ্ছে করে না। 

আমেনা বেশ অবাক হলেন। বাহ্! এত আগের কথাও মনে আছে ওনার। অথচ আলমারির চাবিটা কোথায় যে রাখেন তা তিনি দিনে বাহাত্তর বার ভুলে যান কত বকা খেতে হয় এজন্য বাবুর বাবার কাছ থেকে। পেছনের বারান্দা দিয়ে খুব সুন্দর মিষ্টি বাতাস আসছে। হাতের পুরনো শার্টটা বিছানার উপরে রেখে আমেনা উঠে দাঁড়ালেন অনেক কাজ করতে ইচ্ছে করছে ওনার। 

সেই কিশোরী বউ এর মত। ঘর ভর্তি মেহমান থাকবে; আমেনা দ্রুত হাতে রান্না শেষ করবেন। শাশুড়ি মা চেখে, চোখ দুটো সরু ও তীক্ষ্ণ করে বলবেন,
“লবণ কি তোমার বাপের বাড়ি থেইকা আনছো! “ রান্নাঘরের সবার মধ্যে একটা হাসির রোল পরে যাবে। আমেনা লজ্জায়, কষ্টে চোখ ছল ছল করে, মাথা নীচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকবে। 

তারপর, শাশুড়ি মা কোমলতা ও কাঠিন্য মিশ্রিত একটা কণ্ঠে বলবেন, “কিছু আলু কাইটা দিয়া দাও। দেখি মুখে তোলা যাইবে কি না”। 

আমেনা দৃষ্টি শুন্যে মিশে গেছে। ঠোঁটের কোনে মিষ্টি একটা স্মৃতি মাখা হাসি। শাশুড়ি মা বেঁচে থাকা অবস্থায় বৃদ্ধ মহিলাটাকে একদম সহ্য করতে পারতেন না তিনি। ভাবতেন, ছেলের বউকে সব সময় পরের মেয়েই ভাবে মহিলাটা। প্রতিটা কথায় খোঁটা দেয়া, আমেনার দোষ ধরা একটা স্বভাব ওনার। তখনি ভেবে রেখেছিলেন বাবুর বউকে কষ্ট দিয়ে কোনো কথা বলবেন না তিনি।

ভুলটা বোধ হয় এখানেই ছিলো! কাউকে ভালোবাসলে তাকে শাসন করার অধিকারটাও আপনাআপনিই জন্মায়। আর শাসন করার অধিকার না থাকলে ভালোবাসাও যায় না। কোনো ভুল করলে মায়ের কাছ থেকে হাজার বকা কান মলা খাওয়া যায়। কিন্তু শাশুড়ির খুব স্বাভাবিক কথাতেও ‘কটু কথা’ সিল লেগে যায়। আবার নিজের মেয়ের প্রচন্ড অবাধ্যতা বেয়াদবি হজম করা যায়! কিন্তু ছেলের বউ কোনো কথার যুক্তিসংগত উত্তর দিলেই সে ‘ঝগড়াটে’ উপাধি পেয়ে বসে। 

আমেনার ইদানীং শাশুড়ি মার কথা খুব মনে পরে। কত কি শিখেছেন ওনার কাছ থেকে। প্রতিটা বকা, ঝাড়ি, খোঁটা, কটু কথা সব কিছুতেই কিছুনা কিছু শেখার ছিলো। যে ভুলগুলোর জন্য বকা খেতে হত সে ভুলগুলো পরে আর হত না। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের ভেতরে আটকে রেখে আমেনা শলার ঝাড়ুটা আনতে গেলেন। বিছানা ঝেড়ে ঘরটা ঝাড়ু দিতে হবে! মাকড়শার জালটা সরাতে হবে। 

বারান্দার টবে এবার কোনো ছোট্ট ফুল গাছ লাগানো যায়। আরো কিছু টব এনে সুন্দর করে সাজানো যায় বারান্দাটাকে। শাশুড়ি মা থাকাকালীন ঠিক যেমন ছিলো। গাছে পানি দেয়ার বাহানায় অন্তত প্রতিদিন ঘরটা খোলা তো হবে! তাহলে হয়ত অহনার মাকে দিয়ে ঘরটা পরিষ্কারও রাখা যাবে। ‘পরিষ্কার’ শব্দটা আবারও অতীতে টেনে নিয়ে গেলো আমেনার কাজহীন মস্তিষ্কটকে। 

সেবার শাশুড়ি মা খুব অসুস্থ। খাবার খেয়েই বমি করে দেন। বিছানা ময়লা করে ফেলেন। বাড়িতে আমেনা ছাড়াও আরো তিন জন ছেলের বউ। সবাই এসব দেখে নাক কুঁচকায় কিন্তু কাজের বেলায় কেউ নেই। মায়ের দায়িত্ব চার ছেলের মধ্যে ভাগ করা। কেউ ওষুধের খরচ দেয়; কেউ হাসপাতালের। 

চার ভাইয়ের মধ্যে বাবুর বাবার আয় তখন সব চে’ কম। তাই তেমন কোনো খরচ দিতে পারতেন না। এসব নিয়ে প্রতি মুহূর্তে আমেনাকে কথা শুনতে হতো। তিন জা তো কিছু করতোই না সাথে নানা রঙ্গের কথা।

এসবে অসুস্থ বৃদ্ধ মানুষটাও খুব কষ্ট পেত। আমেনা সবই বুঝতো তবু করার মত কিছুই ছিলো না। কখনো কখনো দেখা যেত ময়লা বিছানাটা পরিষ্কার করে সবে মাত্র নতুন বিছানা চাদর বিছিয়ে দিয়ে আমেনা নিজে পরিষ্কার হয়ে এল; এসেই দেখেন আবার শাশুড়ি মা বমি করে সব নোংরা করে ফেলে রেখেছে। জায়েরা দড়জার বাইরে দাঁড়িয়ে নাক কুঁচকে নানা কথা বলে যেত আর এভাবেই অসুস্থ বৃদ্ধ মানুষটা ময়লা বমির মধ্যেই শুয়ে থাকতো।

মাঝে মাঝে আমেনাও হাঁপিয়ে উঠত। এমনি একদিন বমি পরিষ্কার করে শাশুড়ি মার ঘরে ঢুকে আমেনা দেখতে পেলো গাঢ় নীল রঙের হিজাব পরা একটা মেয়ে বিছানা ও মেঝেতে পরে থাকা বমিটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর দরজার বাইরে থেকে ছোট জা ও তার বোনের মেয়ে টিনা নাক কুঁচকে বার বার বলছে, “তুমি এসব করতে যাচ্ছো কেন! বের হও তুমি”। 

আর মেয়েটাও প্রতিবার একই উত্তর দিয়ে যাচ্ছে, “এমনিতেই তো উনি অসুস্থ! বমির গন্ধে ওনার আরো খারাপ লাগবে।“ বয়স কম মেয়েটার; বাবুর থেকে ৩/৫ বছরের ছোট হবে হয়ত। এইটুকু মেয়ের এতো মায়া দেখে আমেনা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিলো। মেয়েটা কে তা বুঝে ওঠার আগেই সে সব ময়লা পরিষ্কার করে আমেনাকে জিজ্ঞেস করলো, “আন্টি, ময়লা কাপড়গুলো কোথায় রাখবো?” মেয়েটা ছোট জায়ের বোনের মেয়ের বান্ধবী। আজ এতো বছর পরও তাকে ভুলতে পারেনা আমেনা। মাঝে মাঝে মনে হয় ইশ্! যদি ওই মেয়েটার সাথেই বাবুর বিয়ে হতো! সেই প্রাচীন আক্ষেপে বুক ভরে একটা সুবিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেললো আমেনা। 

হাতের ঝাড়ুটা দিয়ে বারান্দার দরজার বামপাশের মাকড়শার জালটা সরাতে শুরু করলেন। জালটা একটু নাড়া দেয়ার সাথে সাথেই শরীরের সমস্ত শক্তি সঞ্চার করে সজোরে পর পর পাঁচটা হাচি দেলেন তিনি। নাহ্! এমন হলে তো কোনো কাজই করা যাবে না। বাবুর বাবা ফিরলে তো আর কোনো কাজ করতেও দিবে না।

সারাদিন কি এভাবে শুয়ে বসে থাকা যায়! কবে যে বুড়োটা বুঝবে! মানুষটা আগে মোটেও এমন ছিলো না। অথবা কাজের চাপে সময় পেত না। একবার প্রচুর বৃষ্টির কারণে বাড়ির পেছনের সিঁড়িটা খুব পিচ্ছিল হয়ে ছিলো। কাজের মাঝে বেখেয়ালে সিঁড়ি থেকে পরে আমেনার পা মচকে গিয়েছিলো। প্রায় মাসখানেক বিছায় থাকতে হয়েছিলো। তখন থেকেই মানুষটার এতো পরিবর্তন খেয়াল করছেন আমেনা। বাবুর বউ আর নাতি শহরে চলে যাবার পর তো ব্যাপারটা আরো বেশি চোখে ধরা পড়ে।

অবশ্য এ বয়সে বুড়ো মানুষটা কি আর করবে! নাতি নাতনি কাছে থাকলেও একটা কথা ছিলো। একমাত্র ছেলে বলে ছেলের বিয়েটাও তিন বাড়ি পরের মোল্লা বাড়ির মেয়ের সাথেই দিয়েছিলো। দূরে বিয়ে দিবেন না যেন বুড়ো বয়সে একা থাকতে না হয়। কি আর হলো তাতে! 

আমেনা হাতের ঝাড়ুটা মেঝেতে রেখে আলমারির নিচের ড্রয়ারে কিছু খুঁজতে শুরু করলেন। খুব পুরনো একটা ছবি। অনেক আগে আলাদা করে রেখেছিলেন। বাবু কত যে কাঠখড় পুড়িয়ে ছবিটা এনেছিলো। মেয়েটাকে খুব পছন্দ করতো বাবু। বিয়ে করতে চেয়েছিলো। কিন্তু বাবুর বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না।

দূরের মেয়ে পর্দা করা মেয়ের সাথে কিছুতেই বিয়ে দিবেন না বাবুর বাবা। নাহ্! ছবিটা নেই মনে হয়। খুঁজতে খুঁজতে হাপিয়ে উঠলেন আমেনা। আলমারির নিচের ড্রয়ার বন্ধ করে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টের পেলেন মাজার ব্যথাটা ভালোই বেড়েছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই কষ্ট হচ্ছে।

কোনো এক অজানা কারণে মনটা হঠাৎ বিষন্নতায় ভরে গেলো আমেনার। স্মৃতির পাতা উল্টালে ভালো স্মৃতি থেকে মন খারাপ করা স্মৃতিই যেন বেশি দেখা যায়। সারাজীবনের সব ভুলগুলো যেন খুব তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। চোখের কোণে হাজার অভিমানের কণা চিকচিক করছে আমেনার।

“কি ব্যাপার! তুমি আবার এ ঘরে এসে কাঁদতে বসলে!”, আফজাল সাহেব প্রশ্ন করলেন। আমেনা কিছুটা হচকিয়ে উঠলেন। চোখ ভরা অভিমানের অশ্রু নিয়েও এক গাল হেসে উত্তর দিলেন, “জানো আজ বাবু ফোন দিয়েছিলো!” “আমেনা! আবার সেই একই স্বপ্ন!

আজ সকালেও আমি আতিককে কয়েকবার ফোন দিয়েছি। একবার ধরে ‘মিটিং এ আছি পরে ফোন দিবো’ বলে রেখে দিলো”। ক্লান্ত কন্ঠে বললেন আফজাল সাহেব। আমেনা বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। “আসো, খেতে আসো আর এতো ধুলোবালিতে বসে থাকতে হবে না”, বলে বৃদ্ধা স্ত্রীর শক্ত ও কুঁচকে যাওয়া হাতটা ধরে পরম মমতায় খেতে নিয়ে এলেন আফজাল সাহেব। 

—————–
অপেক্ষা
নুসরাত জাহান মুন
(২৪ মার্চ ২০১৮)