অশ্রুর প্লাবন

১.
– ”নুহা মামণি, কই এদিকে এসো তো। মামিম্মু তোমার জন্য তোমার পচ্ছন্দের পুডিং করেছে।” পুডিংটা নামাতে নামাতে ভাগ্নিকে ডাকে মেহের।

– “আসচ্ছিইইইই…” বলতে বলতে বেলকনি থেকে দৌঁড়ে আসে নুহা। হাতে একটা খেলনা প্লেন।

– “মামিম্মু! মামিম্মু! তুমি আমাকে কোলে নিয়ে খাইয়ে দেবে, ক্যামন?”
– “ঠিক আছে বাবু সোনা, আমি তোমাকে কোলে করে খাইয়ে দিচ্ছি…” বলতে বলতে নুহাকে কোলে তুলে নেয় মেহের।

এক চামচ মুখে দিতেই চেঁচিয়ে ওঠে নুহা, “শয়তান আমার খাবারে ভাগ বসাচ্ছে তো! ওয়াক থু!! বিসমিল্লাহ…বিসমিল্লাহ…।”

ওর কাণ্ডে নুহার মা নীলা আর মেহের দু’জনেই হেসে ওঠে। 

“এইরে পোলাওটা বোধ হয় ধরেই গেছে…” বলতে বলতে রান্না ঘরে ছুট লাগায় ননদ নীলা। এতক্ষণ দুজনের কান্ড দেখছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। 

মেহেরের বর ইনাম তার বিজনেস নিয়ে মহাব্যস্ত। আজ এই পার্টি তো কাল সিংগাপুর, পরশু লন্ডন। যদিও সময় পেলেই ওকে সাধ্যমত সময় দিতে চেষ্টা করে ইনাম। তবু বলতে গেলে মেহেরকে প্রায় একাই থাকতে হয়। ঠিকা বুয়াটা ঘন্টা তিনেকের জন্য আসে। তারপর সারাদিন অখন্ড অবসর মেহেরের। একা ফ্ল্যাটে দমবন্ধ হয়ে আসে ওর। আত্মীয়-স্বজন কেউ এলে ও যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায়। 

ছোট ননদ নীলা এসেছে তিন বছরের মেয়ে নূহাকে নিয়ে। বেশ ক’দিন থাকবে। এই ননদ ওকে খুব পছন্দ করে। মেহেরও ওরা আসলে খুবই খুশী হয়। নুহাকে খাওয়াতে খাওয়াতে আনমনা হয়ে পড়ে মেহের। 

হঠাৎ ওর হাত ধরে ঝাঁকুনি দেয় নুহা। হাতের প্লেনটা দেখিয়ে বলে, “মামিম্মু, এই বাসাতে যতন এত্তা বাবুণি আসবে.. তথন আমি আল বাবুনিটা এই প্লেনে তলে আতাসে উলবো, ত্যামন?”

নুহার কথায় বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে ওর। দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

নুহা অবাক হয়ে জানতে চায়, “মামিম্মু, তুমি কাঁদছো কেন? চোখে কী হয়েছে তোমার?”
“না মামনি, কিছু হয়নি। চলো তোমাকে গোসল দিয়ে দেই।

গোসলের কথায় কোল থেকে নেমে খুশীতে লাফাতে লাফাতে ওয়াশরুমের দিকে ছুটে নুহা। মেহেরও ধীরপায়ে ওকে অনুসরণ করে। 

২.
আর পারে না মেহের। অনেক কষ্টে চেপে রাখা অশ্রুরা প্লাবন হয়ে ঝরে পড়ে। বিয়ের দশ দশটি বছর হতে চলল অথচ আজও ওদের ঘর আলো করে কোন রাজপুত্র বা রাজকন্যার আগমন ঘটেনি। অথচ ওর পরে বিয়ে হয়েও সবার সন্তান আছে। শুধু মেহেরের বিরানভূমি আজও বিরান হয়ে আছে। কচি কন্ঠের “মা” ডাক শুনলেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে ওর। বিকালের কথাটা মনে পড়তেই আবারও ফুঁপিয়ে ওঠে মেহের।

বড় ননদ এসেছে বিকালে। দুই ছেলে আর এক মেয়ের জননী সে। মেহের আদর করে ছোট ছেলেটাকে কোলে নিতেই ননদ একটানে ছেলেকে নামিয়ে নিয়ে বলে, “হয়েছে তোমার আর আদর করতে হবে না। বংশের বাতিই জ্বালাতে পারলে না তার আবার মায়া কিসের!”

হতভম্ব মেহের ফ্যাল ফ্যাল করে ননদের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। রাগতস্বরে ননদ বলে চলেছে, “নিজে তো মা হতে পারলে না। তাই বলে আমার ভাইটাকে তো আর বঞ্চিত করার অধিকার তোমার নাই। তোমাকে বলে দিচ্ছি, ভাইকে আরেকটা বিয়ে করিয়েই তবে এ বাড়ী থেকে যাবো।”

তারপর ছেলেমেয়েদের টানতে টানতে মেহেরের কাছ থেকে সরে যায়। ছোট ননদ নীলা বড় বোনের কথার প্রতিবাদ করতেই ওকেও অনেক কথা শোনায় শিলা। অপমানিত মেহের নিজের রুমে চলে আসে। 
কিছুক্ষণ পর নীলা আসে ওর রুমে। আস্তে আস্তে পাশে এসে দাঁড়ায়। বলে, “কেঁদো না ভাবী। আপু তো অমনই।”

চোখ মুছিয়ে টেনে বেডে বসায় ওকে। নিজেও পাশে বসে। তারপর বলে, “একদম মন খারাপ করবে না ভাবী। ধৈর্য্য ধর! আল্লাহকে ডাকো। তিনি তোমাকে ফিরাবেন না। ইশ! চোখগুলি কেমন ফুলে উঠেছে। যাও ওয়াশরুম থেকে অযু করে আসো। ফ্রেশ লাগবে। আর যখন খারাপ লাগবে, এটা পড়বে।”
কুরআনের এক কপি অনুবাদ দেয় ওকে নীলা।
“আমি যাই, দেখি নুহা ঘুম থেকে উঠে পড়লো মনে হয়। তুমি ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ আসো।” – বলতে বলতে পর্দা ঠেলে বেরিয়ে যায় নীলা। মেহের ভাবে – দুই সহোদরা অথচ কত পার্থক্য!

৩.
ব্যবসার কাজে সিংগাপুর গিয়েছিল ইনাম। চারদিন পরে ফিরেছে। ফোনে বোনেরা এসেছে শুনে খুশী হয়েছে। যাক মেহেরকে তাহলে একা থাকতে হবে না। কিন্তু বাসায় ফিরে চমকে ওঠে ইনাম। মেহেরের মুখটা কেমন ভার ভার। চোখটাও ফোলা। কিন্তু ওরা এলে তো ওকে কখনো বিরক্ত দেখেনি। কি হয়েছে মেহেরের জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও করে না। 

রাতে খাবার টেবিলে দু’ভাই-বোন মুখোমুখি। হঠাৎ শিলা বলে, “তুমি আরেকটা বিয়ে কর ভাইয়া। ভাবী তো আর বংশ রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে পারলো না। দশটা বছর চলে গেল। আর কতদিন?”
আর কত দিন! চমকে ওঠে ইনাম। মেহেরের দিকে তাকায় একবার। তারমানে ওর ওপর দিয়েও একপ্রস্থ ঝড় বয়ে গেছে। তাই মুখটা অমন লাগছিলো।

“কি কিছু বলছ না কেন?” অধৈর্য্য কন্ঠ শিলার।
“আহ আপু!” নীলা বোনকে থামাতে চায়।
“তুই থামতো নীলা!” ধমকে ওঠে শিলা।
নাহ এ ঝড় এখানেই থামাতে হবে ভাবতে ভাবতে বলে ইনাম,
– “এ প্রব্লেমটা যদি তোদের ভাইয়ের না হয়ে বোনের হতো তাহলে কি এত সহজেই দ্বিতীয় বিয়ের কথা তুলতে পারতিস শিলা?”
– “তাই বলে দশ দশটা বছর পার হলেও বিকল্প চিন্তা করবে না তুমি!” অবাক শিলা। 
– “আমি এখন টায়ার্ড শিলা। পরে কথা বলবো।” বলে কোনরকম নাকে মুখে কিছু খেয়ে উঠে পড়ে ইনাম। 

বেসিনে হাত ধুতে ধুতে মেহেরকে বলে, “মেহের! আমাকে কড়া করে এক কাপ কফি দিও। মাথাটা বড্ড ধরছে।” বলে ডাইনিং থেকে চলে আসে ইনাম। পেছনে রাগতস্বরে শিলার কন্ঠ ভেসে আসে। শিলা কি বলে ইনামের শ্রবণেন্দ্রিয় তা ছুঁতে পারে না। 

সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না ইনাম। মেহের ঘুমিয়ে যেতেই বেলকনিতে এসে বসে। মেহেরের হাতে লাগানো গোলাপের সুবাসে ভরে আছে সারা বেলকনি। বুকের ভেতরটায় যেন ঢেঁকির পাড় পড়ছে। মাথার ভেতর সুনামীর গতিতে চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে ইনামের। 

মনে পড়ছে মাসখানেক আগের এমনি এক রাতের কথা। সন্ধ্যায় সিংগাপুর থেকে ফিরেছে। এবার মেহেরও ছিল ওর সাথে। চারদিকের সবার নানান কথায় অতিষ্ঠ হয়ে দেশের বাইরে গিয়েছিল ডাক্তার দেখানোর জন্য। রির্পোটে কোন সমস্যা নাই। তারপরও কেন যে এমন হচ্ছে। ডাক্তাররা কিছুই বলতে পারলো না। 

মনে পড়ে ওখানকার এক ডাক্তারের কথা – “ইয়াংম্যান! আর ইয়্যু এ্যা মুসলিম?”
ও হ্যাঁ বলতেই বলেছিল, “তাহলে এত টেনশন কেন? তোমাদের কুরআনেই তো লেখা আছে। বৃদ্ধ বয়সে ইবরাহীমকে সন্তান দিয়েছিলেন তোমাদের গড। তার কাছেই চেয়ে নাও।”

খৃস্টান ডাক্তারের কথায় চরম বিস্মিত হয়েছিল ইনাম। কুরআনের কথা। অথচ ওতো জানে না। নিয়মিত নামাযটা পড়লেও ধর্ম নিয়ে অতোটা জানাশোনার ব্যাপার থাকতে পারে কখনো চিন্তাও করেনি ইনাম।

ডাক্তারের কথায় আলোড়ন তুলে ওর সমস্ত অন্তরাত্মায়। ভাবে ও কিভাবে জানবে ওতো কুরআন পড়তেই ভুলে গেছে। সেই ছোটবেলায় বাবা একজন হুজুর রেখে দিয়েছিলেন। তার কাছে গোটা পনেরো সুরা আর নামায পড়াটা শিখেছিল। তারপর বাবার মৃত্যুর পর সে সব পাট কবে চুঁকে গেছে।

মা ওসব তেমন পছন্দ করতেন না। তবে ছোটবোন নীলার সাথে পারেনি। ও কেমন করে করে কুরআন, নামায এসব শিখেছে। ওর পীড়াপীড়িতে ইনামও নামায ধরেছিল। নীলার বিয়েও দিতে হয়েছে মাদ্রাসার এক প্রিন্সিপালের সাথে। সে আরেক কাহিনী। অবশ্য ছোট মামার অনেকখানি অবদান রয়েছে। 

ইদানীং মেহের মাঝে মধ্যে কুরআন পড়তে বললেও সময়ের অভাবে আর অনভ্যাসের কারণে তেমন পড়া হয় না। কিন্তু ডাক্তারের কথায় কি যেন একটা ছিল। বাসায় এসেই মেহেরের কাছ থেকে কুরআন নিয়ে পড়তে শুরু করেছিল ইনাম। আর তখন থেকেই একটু একটু করে বিশ্বাসটা মজবুত হতে লাগলো ওর। অস্থিরতাও কমে আসতে লাগলো। 

জীবনধারাটাও তো কিছুটা পাল্টে গেছে ওর। আগের মতো পার্টি-ফার্টি আর ভালো লাগে না। সময় পেলেই কুরআন নিয়ে বসে ও। প্রশান্তি লাগে। 
হঠাৎ চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে তন্ময়তা কাটে ওর। ধুমায়িত কপির ট্রে হাতে ওড়না উড়িয়ে ওর পাশে এসে বসে মেহের। কফির কাপটা ওর হাতে দিতে দিতে বলে, “নাও কফিতে চুমুক দাও ভালো লাগবে।”
রাতে ঘুম না আসলে দু’জনে মিলে বেলকনিতে বসে কফি খেয়ে রাতের আকাশ দেখে দেখে কত রাত পার করেছে ওরা। আর শিলা আজ এ কি বলে? আর কত দিন?? 

“এত কি ভাবছো বলতো?” ইনামের হাতে আলতো করে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে মেহের।
“নাহ, তেমন কিছু না।”
“তুমি কি ভাবছো আমি জানি। তুমি চাইলে শিলার কথায় রাজী হতে পারো। দশটা বছরতো হলো, অনেকদিন। নতুন করে আবার সব শুরু করো তুমি।”
“এ কি বলছো তুমি মেহের! আর কখনো এসব বলবে না!” ধমকে ওঠে ইনাম। 

তারপর মেহেরের কোমল হাত দুখানি হাতে নিতে নিতে বলে চলে, “যিনি ইবরাহীম (আ) ও যাকারিয়া (আ) কে বৃদ্ধ বয়সে সন্তান দিয়েছেন তিনি অবশ্যই আমাদের ফিরাবেন না।”

বেলকনির গোলাপের টবের দিকে তাকিয়ে বলে চলে ও, “যে রব এত সুন্দর গোলাপ সৃষ্টি করেছেন তিনি কি আমাদের গোলাপের মত একটি ফুটফুটে রাজকন্যা নয়তো রাজপুত্র দিবেন না, মেহের?”
“কেন দিবেন না অবশ্যই দিবেন।” স্বামীর চোখে চোখ রেখে মেহের বলে ওঠে।

ইনামের পরিবর্তন ওর চোখে পড়েছে। সে-ও তো চেঞ্জ হয়েছে। নীলার দেওয়া কুরআন পড়ে পড়ে ওরও বিশ্বাসের ঝুলিটা দিনে দিনে মজবুত হয়েছে।
ইনাম গাঢ় গলায় বলে, “তাহলে ওসব আর কখনো বলবে না। চলো আমরা তার কাছেই নিজেদের কথা বলি। যিনি সব পারেন।”

৪.
ওয়াশরুম থেকে অযু করে আসে দু’জনে। বিগলিত অশ্রুতে ধুয়ে মুছে ফেলতে চায় বিগত দিনের সকল অবাধ্যতার চিহ্ন। নতুন দিনের আশায় চারটি চোখের সম্মিলিত অশ্রুতে ভেসে যেতে থাকে জীবনের সব না পাওয়ার বেদনা। দু‘জনে সমস্বরে বার বার আওড়াতে থাকে,

“রাব্বি লা তাযারনী ফারদান ওয়া আনতা খায়রুল ওয়ারিসীন। রাব্বী হাবলী মিল্লাদুনকা যুররিয়্যাতান ত্বায়্যিবাতান, ইন্নাকা সামিউ’দ দু’আ।”

ওদের কান্নার ধ্বনি আসমান-যমীন পেরিয়ে পৌঁছে যায় আরশে আযীমে। স্রষ্টার রহমের চাদরে আবদ্ধ হয়ে থাকে দু’টি মানব-মানবী।

…………………………….

অশ্রুর প্লাবন
সুমাইয়্যা সিদ্দীকা
(১৪ জানুয়ারী ২০১৮)