এক সকালে

১.

ঘুম ভেংগেই মোবাইল হাতে নেওয়া কোন ভালো অভ্যাস নয়। কিন্তু সময় জানার জন্য এর চেয়ে ভালো কোন মাধ্যম আপাতত নেই রেনুর। দেওয়াল ঘড়ির কাটাটা ব্যাটারির মৃত্যুতে স্থির।

ভেবেছিল সময় দেখেই রেখে দিবে হাত থেকে। কিন্তু ফেবুর নোটিফিকেশন বক্সটা তা আর হতে দিল না। করবো না করবো না ভেবেও চেক করার জন্য আংগুলটা যেন নিজেই সচল হয়ে টাচ করে দিল বক্সটা।

আর এরপরেই মুখটা বিকৃত করে ফেলল সে।

তার স্কুল ফ্রেন্ড সামিহা চেক ইন দিয়েছে শাহজালাল এয়ারপোর্ট। ফ্লাইং টু সিংগাপুর।

কিছুদিন আগেই না ইন্ডিয়া থেকে বেড়িয়ে আসলো? আবার যাচ্ছে? আবার?

আর সে পোড়াকপাল নিয়ে এই মরার শহরেই আটকে আছে। বাড়ির কাছে কক্সবাজারে পর্যন্ত যেতে পারছেনা ছোট বাচ্চা নিয়ে। যতবার শাহীনকে বলেছে বেড়াতে নিয়ে যেতে, একেকবার একেক বাহানায় এড়িয়ে যায়। কখনো অফিসের ব্যস্ততা, কখনো ছোট বাচ্চা নিয়ে দূরে যাওয়া ঠিক হবেনা ইত্যাদি ইত্যাদি।

ঘরকুনো আলসে একটা। বিয়ের আগে কত্ত স্বপ্ন ছিলো বর কে নিয়ে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াবে। আর জুটলো এমন এক মানুষ যাকে নিয়ে নিউমার্কেট যেতে চাইলেই তার জ্বর চলে আসে।

“গু গা গা গু গা” শুনেই পাশে তাকায় রেনু। উঠে গেছেন ম্যাডাম। এবার মাকে দু’দন্ডের জন্য জিরোতে দিবেন না। কি ভেবে মেয়ের ছোট্ট ছোট্ট লালচে পা দু’টো বন্দী করে মোবাইলের ক্যামেরায়।

ফেবুতে আপ্লোড করে দেয় ছবিটা। নিচে ক্যাপশন, “আমার পৃথিবী, আমার সওওব”। আপ্লোড করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় তাকে। তার পৃথিবী দুইহাত দিয়ে মায়ের চুল টেনে মুখে পোরার চেষ্টা করছে। রেনু কোনমতে জোর করে ছাড়াতেই দারুণ অভিমান করে চ্যাওম্যাও করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে দেন “পৃথিবী”।

বাথরুমে যাওয়া দরকার ছিল। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েই যাবে নাকি কাঁদিয়ে রেখে যাবে ভাবতে ভাবতে খুব কান্না পেল রেনুর। “আমার কপালটাই এত খারাপ কেন?”

২.

পুরো বাসা একদম নিরব। পিন পরলেও যেন শোনা যাবে। মাঝেমাঝে এত নিস্তব্ধতায় দম বন্ধ হয়ে যায় শানুর। শরিফ দুই দিনের ট্রেনিং এ কুমিল্লা গেছে। মানুষটা থাকলে সকালের এই সময়টা বেশ কেটে যায় খুনসুটি আর আড্ডায়।

দারুণ আড্ডাবাজ ছেলে শরিফ। পাঁচটা মিনিট চুপ করে বসে থাকার মানুষ না। এই অফিসের গল্প বলছে, এই চা বানাচ্ছে, এই হয়ত হেড়ে গলায় গান ধরলো। ছেলেমানুষিতে মাঝেমাঝে হাপিয়ে ওঠে শানু। কিন্তু আজ যখন মানুষটা দূরে, তখন এই ছেলেমানুষিগুলোই খুব মিস করা শুরু করে সে।

ফোন দেওয়ার জন্য মোবাইলটা হাতে নেয়। রাতে ভাইবারে কথা বলতে বলতে কে যে আগে ঘুমিয়ে গেলো মনে আসছে না তার, মোবাইলের ডাটা কানেকশন অন রেখেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। এক গাদা নোটিফিকেশন ও আসছে দেখা যাচ্ছে।

ফোন দেওয়ার বদলে ফেবুতে ঢুকে যায় শানু। রেনু একটা ছবি দিয়েছে ওর বাচ্চার পায়ের। লাল লাল পুতুলের মত পা। বুক মুচড়ে কান্না আসে শানুর।

ওর কপালে মা হওয়া নেই। একটা ছোট্ট পুতলা বুকের মাঝে চেপে সব দুঃখ ভুলে যাওয়া হবেনা কোনদিন। কতবার নিজেকে বুঝিয়েছে যা হবেনা সেসব নিয়ে আফসোস করতে হয় না, কিন্তু আজ সকালের এই নিসঙ্গতা বন্যা হয়ে দু চোখ বেয়ে নেমে আসে হঠাৎ।

সব রাগ অভিমান হয়ে ঝরে পরে শরিফের উপর। তার অনুপস্থিতিতেই তো এইসব অনর্থক চিন্তাগুলো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিল শানুকে।

চোখ মুছে মোবাইলে লেখে সে,

যেদিন আমি হারিয়ে যাবো, বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে।

লিখে শরিফকে ট্যাগ করে দেয় সে।

৩.

এয়ারপোর্টে বসে বসে মোবাইল স্ক্রল করছিল সামিহা। আবহাওয়াজনিত কারণে ফ্লাইট ডিলে করেছে। পাশেই হাসান, ক্লান্ত ভাবে চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে। শরীর যা খারাপ তার চেয়ে অনেক বেশি ভেংগে পরেছে মানসিক ভাবে।

হঠাৎ করে হাসানের অকারণ এবং অস্বাভাবিক পেট ব্যাথার উত্তর খুঁজে পেয়েছেন ডাক্তাররা। গতমাসেই ইন্ডিয়া গিয়েছিল একটু আশার আলোর খোঁজে। মেলেনি। সামিহা হাল ছাড়বেনা। সিংগাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথে নিয়ে যাবে হাসান কে। এরপরেও কাজ না হলে ইউরোপ এমেরিকায় দেখবে। সে হাল ছাড়বে না। কিছুতেই না। দুইটা ছোট বাচ্চা নিয়ে সে বিধবা হবেনা, তার বাচ্চাদের এতিম হতে দিবেনা। যা হয় হোক। শুধু মানুষটা বেঁচে থাক ব্যস।

হাসান একটা বেসরকারি ফার্মে খুব উচু পোস্টে চাকরী করে। চিকিৎসার সব খরচ অফিস থেকেই দিচ্ছে। কিন্তু সামিহার মাঝে মাঝে মনে হয় সে জুয়া খেলছে আর তার জীবনের সব কিছু সে বাজিতে লাগিয়ে দিয়েছে।

মোবাইল স্ক্রল করছিল সময় কাটাতে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছে। সবাইকে খুব সুখী মনে হচ্ছে। রেনুর বাচ্চা হয়েছে, সোহা নতুন চাকুরী পেয়েছে, শানু স্বামীকে নিয়ে আহ্লাদ করছে।

অন্য সময় হলে সে কি ভাবত কে জানে, কিন্তু তার পরীক্ষা হঠাৎই যেন তাকে খুব পরিপক্ক করে দিয়েছে। রেনু স্বামী-শাশুড়িকে নিয়ে খুব কষ্টে আছে। সোহা রিসেন্টলি ডিভোর্সড। শানুর বাচ্চা হচ্ছেনা। এরা কেউই এসব ফেবুতে দেয়নি। কিন্তু ক্লোজ ফ্রেন্ড হওয়ায় এদের আপডেট সে জানে।

সে নিজেই কি হাসানের অসুখের কথা ফেবুতে বলেছে! হঠাৎ কি মনে করে লগ আউট করে দেয় সে। হাসানের দিকে ফিরে মিষ্টি হেসে বলে, কফি খাবে?

এক সকালে
নূরুন আলা নূর

এপ্রিল ২৬, ২০১৮ইং