কন্যা সম্প্রদান

আজকে যে আমার বিয়ের দিন তা একদমই মনে ছিল না!! ফেসবুক মেমরির কল্যানে মনে পড়ে গেল। অবশ্য বিয়ের দিনের কথা মনে না থাকার পেছনে দুটো কারণ আছে, প্রথমত আমরা বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করি না।

দ্বিতীয়ত আমাদের আকদ হয়েছিল কয়েক মাস আগে। এই দিনে শুধু উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। (“উঠিয়ে নেয়া” কথাটা কেমন যেন অদ্ভুত লাগে শুনতে!! যেন নারী কোন পণ্য বিশেষ, তাকে এক গুদাম থেকে অন্য গুদামে উঠিয়ে নেয়া হয়।) আকদের দিনটাই কেবল মনে থাকে, অন্যান্য দিন মাথায় থাকে না।

ভেবে দেখলাম, আজকের দিনটিকে আক্ষরিক অর্থে বিবাহ বার্ষিকী বলা না গেলেও, অন্তত পক্ষে শশুর বাড়ি পদার্পণ দিবস বলা যায়।

মানুষের বিয়ের দিন নিয়ে অনেক সুখ স্মৃতি থাকে, কিন্তু আমার স্মৃতি জুড়ে আছে শুধুই আতংক আর আতংক!! বিয়ের কিছু দিন আগে থেকেই আমি নানা কারণে অতীব শংকিত থাকতাম, এ যুগে আমার মত আতঙ্কিত বউ সচরাচর দেখা যায় না!

এরেঞ্জড ম্যারেজ হবার কারণে বিয়ের আগেই বরের প্রতি কোন অনুভূতি ছিল না।, তাই বাসার সবাইকে ফেলে কি করে থাকব, সেই চিন্তায় আমার সমগ্র স্বত্বা আচ্ছাদিত ছিল। তার উপর শশুর বাড়ি কেমন হবে সেটি নিয়েও দুশ্চিন্তার কমতি ছিল না।

এখনো মনে আছে বিয়ের আগের দিন রাতে প্রায় অর্ধ রাত পর্যন্ত আমি আর আমার ছোট্ট ভাই দু জন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কি যে কেঁদেছিলাম!! কাঁদতে কাঁদতে মনে হয় চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল, যে কারণে আমাকে যখন কমিউনিটি সেন্টার থেকে “উঠিয়ে নিয়ে’ যাচ্ছিল অর্থাৎ কন্যা বিদায়ের সময় চোখ ভেজেনি একটুও। এত মানুষের সামনে কেন যেন চোখে পানি আসে নি। … শুধু দু চোখ জবা ফুলের মত লাল হয়ে আসছিল বার বার আর কলিজা ফেটে যাচ্ছিল কষ্টে।

গাড়িতে ওঠার পর আমি মায়ের হাতটা ধরে রেখেছিলাম, আমার আদরের মায়ের হাত থেকে আমার হাতটা যখন ছুটিয়ে নেয়া হল আর গাড়ি রওনা হয়ে গেল, তখনকার অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

আপন জনদের ছেড়ে, অচেনা একজনের সাথে, সম্পুর্ন অচেনা পরিবারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে বুক ভেঙ্গে যাচ্ছিল, কি যে কষ্ট হচ্ছিল!! অচেনা মানুষটি হয়তো কিছুটা সান্তনা বা আশ্বাস দেবার চেষ্টা ছিল। কিন্তু বেচারার নির্বাক সান্তনায় খুব একটা কাজ হচ্ছিল না, প্লাস্টিকের পুতুলের মত আমি বসেছিলাম, চোখের কোন দিয়ে অঝোরে নেমে যাচ্ছিল জলের ধারা।

শশুর বাড়িতে যখন প্রথম পা দিলাম, তখন চারদিকে ঝলমলে উৎসবের আমেজ। আর আমার শুধু মনে হচ্ছিল, এক ঘরকে অন্ধকার করে অন্য ঘরে এসেছি আলো হয়ে। এ বাড়িতে নতুন বৌকে গৃহে প্রবেশ করানোর উচ্ছলতায় সবাই আনন্দ করছিল। অন্য দিকে আমার ওই ঘরে তখন নিশ্চয় এক রাশ কান্না বুকে জমিয়ে বসে ছিল আমার মা ও ভাই।

এ সমাজে “মেয়ে উঠিয়ে দেয়ার” এ হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হওয়াটা যদি বন্ধ করা যেত তাহলে বিয়েটা আরো আনন্দঘন হত। নতুন পরিবারে প্রবেশের পর তাদের ব্যবহার কেমন হবে ও নিজের মায়ের পরিবারের সাথে ঠিক মত সম্পর্ক বজায় রাখতে পারবে কিনা, যখন খুশি মায়ের কাছে যেতে পারবে কি না, ইত্যাদি নানারকম দুশ্চিন্তার কারণেই এই মন খারাপের পরিস্থিতি তৈরী হয়।

অলিখিত ভাবে এবং অকথিত ভাবে সবাইকে শেখানো হয় কন্যা বিদায়ের মাধ্যমে, কন্যা নামক বস্তুটির মালিকানা হস্তান্তর করা হল। এখন থেকে মেয়েটির ওপর মায়ের মায়ের বাড়ির আর কোন অধিকার থাকবে না এবং শশুর বাড়ি হবে মেয়েটির নতুন মালিক!

আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের সংস্কৃতি থেকে “কন্যা বিদায়”, “কন্যা সম্প্রদান” ইত্যাদি শব্দ গুলো উঠিয়ে দেয়া উচিত। এই সব প্যাথেটিক শব্দ গুলো আমাদের মাথা খেয়েছে।

আমরা মুখে মুখে এত আধুনিক হচ্ছি, কিন্তু এই প্রাচীন মানসিকতা থেকে কেউ বের হতে পারছি না ! বিয়ের সাথে সাথে মেয়েরাও যেন অটোমেটিকালি মেনে নেই, সে দিন থেকে আমি আমার পিতৃকুল থেকে পর হয়ে গেলাম।

অনেক পরিবারে আবার শেখানো হয় বিয়ের পর মেয়েরা মায়ের বাড়িতে মেহমান হয়ে বেড়াতে যায়, কারণ সেটি আর তার নিজের বাড়ি নয়, সেটা এখন তাদের ভাইয়ের ভাই এর বউদের বাড়ি। আর শশুর বাড়িই এখন থেকে তার স্থায়ী ঠিকানা। কি হাস্যকর চিন্তা ধারা! সারা জীবন যে বাড়ি কে নিজের বাড়ি ভাবলাম, মাত্র তিনবার কবুল বলার মাধ্যমে সেই বাড়ি আমার পর হয়ে গেল!

‘কবুল’ শব্দ দ্বারা জীবনে নতুন একজন মানুষকে গ্রহণ করার কথা ….. কিন্তু নিজের পরিবারকে ত্যাগ করে, সমাজের সকল পঁচে যাওয়া প্রথাকে কবুল করার কথা তো কথাও লেখা নেই।

ইসলামে কিন্তু একটি মেয়ে কখনো তার পরিবারের পর হয় না, জন্ম থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার পরিবারের প্রতি তার একই রকম অধিকার থাকে।

এ সমাজে বিয়ে নামের জিনিসটি আরো একটু সহজ করলে কত ভাল হত। এখানে ছোট থেকেই মেয়েদের শেখানো হয়, “তোকে একদিন বিয়ে দিয়ে দিব, তুই তখন শশুর বাড়ি চলে যাবি”, কন্যা সন্তান হলে মা বাবার মুখ কালো হয়ে যায়, কারণ তাকে আদর করে পেলে পুষে বড় করে কি লাভ, শেষ পর্যন্ত সেই শশুর বাড়িই দিয়ে দিতে হবে।

ভাব খানা এমন, যেন অন্যকে দিয়ে দেবার জন্যই মেয়েটিকে বড় করা হচ্ছে। বিয়েই যেন মেয়েদের জীবনের এক মাত্র লক্ষ্য ও সময় মত বিয়ে হওয়াটাই যেন নারী জীবনের অন্যতম সাফল্য।

আমি বিবাহের বিরুদ্ধে কথা বলছি না অথবা শশুর বাড়ি যাবার বিরুদ্ধেও বলছি না, আমি শুধু বলছি আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন এখন অতি জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

# আমাদের মেয়েদেরকে শৈশব থেকে শেখানো উচিত বিয়ে জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ন ধাপ মাত্র, এটি জীবনের এক মাত্র লক্ষ্য নয়।

# বিয়ে হোক অথবা না হোক, বাবার বাড়ি সব সময়ই নিজের বাড়ি।

# বিয়ের মধ্যে কন্যাকে ‘সম্প্রদান’ করা হয় না। আমরা কোন বস্তু নই, অথবা আমাদের বাবা বা স্বামী কেউই আমাদের মালিক নন, যে তারা আমাদের মালিকানা হাত বদল করতে পারবে। আমরা শুধু মাত্র আল্লাহর দাস, উনিই আমাদের মালিক।

# বিয়ে নামের ব্যবস্থাটিও আল্লাহর দেয়া একটি সুন্দর ব্যবস্থা। এর দ্বারা দুটি মানুষ ও তাদের পরিবার একত্রিত হয়, বৈধ ভাবে বংশ বৃদ্ধি হয়।

# স্বামী স্ত্রীর বন্ধন কোন বন্দীত্ব নয়, বরং ‘স্বামী’ ও ‘স্ত্রী’ একে অপরের জন্য রহমানুর রহীমের তরফ থেকে দান করা উপহার ও নিয়ামত তুল্য।

# বিয়ের মাধ্যমে বাবার বাড়ি পরের বাড়ি হয়ে যায় না। বিয়ের মাধ্যমে বাবার বাড়ির সাথে নতুন একটি পরিবারের সদস্যপদ লাভ করা হয়।

# মেয়েটি যেমন শশুর বাড়ির সদস্যপদ লাভ করে, ঠিক একই ভাবে মেয়েটির বরও তার স্ত্রীর পরিবারের নতুন সদস্যে পরিনত হয়।

# স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে একত্রে থাকার জন্য যে সম্মতি প্রকাশ করে, তাকে বিয়ের মাধ্যমে হালাল করা হয়।

# এছাড়া বিয়ের দ্বারা মেয়েটির নিজ পরিবারের প্রতি দায়িত্ব ও অধিকার বিলুপ্ত হয় না, বরং নতুন আরো একটি পরিবারের প্রতি তার দায়িত্ব ও অধিকারের সৃষ্টি হয়।

# স্বামী ও স্ত্রী দুজনে একত্রিত হয়ে তখন একটি নতুন পরিবারের সৃষ্টি হয় এবং এদের দুজনের সারাজীবন নিজেদের বাবা মায়েদের প্রতি কর্তব্য থাকে ও এক্ষেত্রে একে অপরকে যার যার কর্তব্য পালন করতে উৎসাহ দেয়া ও সাহায্য করা বাঞ্চনীয়।

# হাদিসে আছে, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, নব বিবাহিত দম্পতির এজন্য তাদের পুরনো আত্মীয়র (মা বাবা ) ও নতুন আত্মীয়র (শশুর- শাশুড়ি) প্রতি বন্ধন সব সময় অটুট রাখার চেষ্টা করতে হবে।

যাই হোক নিজের বিয়ের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে কত কি লিখে ফেললাম। আমার বরাবর শুধু মনে হয় ‘বিবাহ’ নামের পবিত্র বন্ধনটি সম্পর্কে নারী পুরুষ উভয়ের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা উচিত। তাহলে জীবন আরো অনেক সহজ, সুখের ও আনন্দ দায়ক হত ইন শা আল্লাহ।

কন্যা সম্প্রদান
হাসনীন চৌধুরী

অগাস্ট ১৬, ২০১৯ইং