কাছে আসার সাহসী গল্প

“আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো। 
ছোট ঘাসফুলের জন্যে, 
একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে, 
আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে
উড়ে যাওয়া একটি পাঁপড়ির জন্যে!’ 

হুমায়ূন আজাদের কবিতার লাইন বলতে বলতে ছলছল করে উঠে ইভার চোখ। চোখ তো নয় পাখির নীড়। ইভা চলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে।

“তুমি চলে যাবে বলতেই বুকের মধ্যে
পাড় ভাঙার শব্দ শুনি –
উঠে দাঁড়াতেই দুপুরের খুব গরম হাওয়া বয়,
মার্সির কাঁচ ভাঙতে শুরু করে;
দরোজা থেকে যখন এক পা বাড়াও আমি
দুই চোখে কিছুই দেখি না – 
এর নাম তোমার বিদায়,
আচ্ছা আসি, শুভরাত্রি,
খোদাহাফেজ।”

মহাদেবের কবিতা বলে তমাল। ইভাকে হাসাতে চেয়েছে। ইভা হেসে ফেলে। হাসির শব্দে কবিতার লাইন হালকা জোকসের মতো বাতাসে মিলিয়ে যায়, তারপরও এক অদ্ভুত আবেগ নিয়ে ঘরে ফেরে ইভা।

রাজিব সাহেব ইভার বাবা। তিনি জানেন ইভা খুুব সাহসী মেয়ে। ওর বুকের ভেতর পাথর। পাথরে ফাঁক ফোকর নেই। ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। রাজিব সাহেব ইভাকে লড়াই করতে শিখিয়েছেন। বেশ কিছুদিন ইভা খেয়ালী জীবন কাটিয়েছে। বন্ধুদের সাথে একা একা ঘুরতে গিয়েছে, রাতে দেরি করে ঘরে ফিরেছে। রাজিব সাহেব বলি বলি করে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেন নি। মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছে বলে স্বাধীনতায় বাধা দেবেন কেন! রাজিব সাহেবের রুচিতে বাঁধে। এমন বাবা পেয়ে ইভাও বেশ খুশী। একসময় ইভা প্রেমে পড়েছে। বুকের ভেতর তমাল নামের দামাল ছেলে। এক অদ্ভুত অসুখ! অন্ধকার ঘোর। 

ভ্যালেন্টাইন ডেতে তমাল ইভাকে আবারো ডেটে নিয়ে যায়। বাবা-মা তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে বললেও ইভার কী আসে যায়! সে সাহসী হয়। কাছে আসার গল্পগুলো ইভাকে সাহস দেয়। রাতে ইভা ঘরে ফেরে না। পরদিন স্বাভাবিক নিয়মেই ঘরে ফিরে। হাসিখুশি উচ্ছল মেয়ে। 

কিন্তু কিছুদিন পর হঠাৎ ইভা বদলে যায়। সে হঠাৎ করে ভয় পেতে শুরু করে। বাবা ইভাকে উন্নত পৃথিবীর চমক দেখিয়েছেন কিন্তু নিকটের মানচিত্র দেখাননি। একটা মৃত শিশুর ছবি বারবার ইভার চোখে ভেসে উঠে। 

তমাল তাকে ফিরিয়ে দেয় নি। আহা বেচারা, সংবাদ শুনে এতটা হতভম্ব হয়ে পড়েছিল যে একটা কবিতাও বলতে পারেনি। চোখমুখ শক্ত করে আ্যবরশনের কথা বলেছে। সেও তো মাত্র উনিশ! এখুনি বাবা হওয়ার চিন্তা ওর জন্য অকল্পনীয়। 

আসন্নপ্রসব-অপরাধবোধে ইভা নিজের মধ্যেও হিংস্রতা টের পায়। সে কি ছুটি কাটানোর নাম করে কোথাও পালাবে? তারপর ফিরে এসে গোপনে অন্যদের মতো ডাস্টবিনে ফেলে দেবে একটি ছোট্ট মাংসপিণ্ড। না না, ওটাকে মাংসপিণ্ডই বলতে হবে, কিছুতেই শিশু ভাবা যাবে না! এক অপার্থিব গাঢ় বেদনা ইভাকে ঘিরে ধরে। সে তো শিশুই। খুনী ইভা কীভাবে বাঁচবে, হাসবে? ইভা তো সাহসী। এক কাজ করা যায়। কী হয় ওকে রেখে দিলে? জীবনের কাছাকাছি অঞ্চল ইভা পুনরায় পাঠ করে। না, বড় লজ্জা। ইভার লজ্জা হয়। অথচ সে কোনোদিন লজ্জাশীলা ছিল না। সকলের সম্মুখেই নগ্ন পা, নগ্ন বাহু, নগ্ন গ্রীবা ছিল তার। কিন্তু এখন চুল থেকে নখ; কী ভীষণ লজ্জা আর জড়তায় জড়িয়ে আছে!

ইভা নিজের ঘরের দেয়ালের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ঘন্টার পর ঘন্টা। কখনো হাঁটে ঘরের ভেতর। ঘরটাকে একটা নির্জন মাঠ মনে হয়। ইভা শোয়, পায়চারী করে, আয়নায়, সেলফোনে নিজেকে বারবার দেখে। একটা ভয়ানক রাত কেটে যায়। ইভা সমাজের চেয়ে বেশি সাহসী হতে পারে না। 

পরদিন ভোরের আলো ফোটার পর সাংবাদিকরা ক্যামেরায় তুলে নিয়ে যায় ফাঁসির দড়িতে ঝুলন্ত ইভার শেষ ছবি।

…………………..

কাছে আসার সাহসী গল্প
মাজিদা রিফা
(১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৮)