গতি-দুর্গতি

– এই নার্গিস আপা, এই! ঐ যে ঐ যে দেখেন ফিরোজ ডাক্তারের মেয়ে ঐটা।

রিতা ঘটক দৌড়ে এসে নার্গিস বেগমকে ছোটখাটো একটা ধাক্কা দিলেন।

– কোনটা আপা? ঐ সবুজ শাড়ি পরা মেয়েটা?

– আরে না, বোরকা পরা মেয়েটা। আপনি না বললেন ছেলে পর্দা করা মেয়ে চায়?

– তাই বলে বিয়ে বাড়িতেও বোরকা পরে? আপনি যা-ই বলেন, বেশি পর্দাওয়ালিদের তলে তলে অনেক কাহিনী থাকে। নাম কি মেয়ের?

– আনিকা। আপা তলে তলে কাহিনীর খোঁজ আমি নিব। আপনি দূর থেকে মেয়ের চালচলন দেখতে থাকেন। বেশি কাছে যাবেন না, আজকালকার মেয়েরা অনেক সেয়ানা। একবার যদি বুঝে ছেলের জন্য দেখছেন, বিনয়ের অবতার হয়ে যাবে। আসল চেহারা ধরতেই পারবেন না।

– ঠিক বলেছেন আপা। দূর থেকেই দেখতে হবে। আমার অবশ্য সবুজ শাড়িটাকে ভাল লাগছে। ছেলের যে কী পছন্দ…আগা মাথা বুঝি না।

– আচ্ছা আপা আপনি দেখেন। আমি একটু ওদিকটায় যাই। কাজ আছে অনেক।

………

– আরে আনিকার মা না? আপনাকে তো আজকাল দেখাই যায় না ভাবি!

– ভাবিইইই! কতদিন পর দেখা!

– সেটাই তো বলছি। কেমন আছেন বলেন তো! আনিকার কী খবর? বিয়ে দিয়েছেন?

– ভাবি বিয়ের কথা আর বলবেন না! মেয়েকে নিয়ে খুব চিন্তায় পড়ে গেছি। ওর যে কী পছন্দ আর না পছন্দ! কিছুই বুঝি না। কত ছেলের প্রপোজাল আসে ওর পছন্দ হয় না! ওর বাবা, আমি, কতবার কতভাবে জানতে চেয়েছি তোর কাউকে পছন্দ থাকলে বল। বলে পছন্দ নেই। থাকলে তো বলতাম!

– কী বলেন এসব! আনিকা বিয়েতে এসেছে আজকে?

– হ্যাঁ অনেক কষ্টে এনেছি। তাও আসতো না। ওর বান্ধবী সুরভীও দাওয়াত পেয়েছে। তাই এসেছে। এই মেয়েকে নিয়ে কী যে জ্বালায় পড়েছি ভাবি! বললাম একটা শাড়ি পর। ওর বাবা ইন্ডিয়া থেকে একটা নীল কাঞ্জিভরম কিনে এনেছে মেয়ের জন্য। কিন্তু ও পরবে না। বলে আমি সব জায়গায় বোরকা পরি, বিয়েতেও বোরকা পরে যাব!

– ভাবি আপনার কথা শুনে তো ভয় লাগছে। মেয়ে বোরকা ধরল কবে? ছ্যাঁকা ট্যাকা খায়নি তো? আজকালকার মেয়েরা প্রেমে ছ্যাঁক খেলে কয়েকদিন বোরকা ধরে। আরেকটা প্রেম হলে, বিয়ে টিয়ে হলে আবার ঠিক হয়ে যায়। আপনি খোঁজ নিয়েছেন তো?

– কী আর বলব! আমিও প্রথমে তাই ভেবেছিলাম ভাবি। ওর সব বান্ধবীকে রিমান্ডে নিয়েছি। ওসব কোনো সমস্যা না। ও নাকি এখন ছেলেদের সাথে কথাই বলে না তেমন। এ যুগে এগুলো চলে ভাবি বলেন?

– ও মা! ছেলেদের সাথে একটু আধটু না মিশলে বিয়ে হবে কীভাবে! প্রেমের কথা বলছি না…একটু মেলামেশা চেনাজানা না থাকলে, একটু ঘোরাফেরা না করলে মানুষ তো প্রস্তাব পাঠাবে না!

– ভাবি কান্না আসে আমার। যা সম্বন্ধ আসে সব ওর বাবার পরিচয়ে। কোনো গেট টুগেদারে নিয়ে যেতে পারি না ওকে। এরকম বিয়ে টিয়েতে আসলেও তো সম্বন্ধ আসতো! বলে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে, মেয়েদের সাথে ঘুরে না এমন হুজুর খোঁজো। আমি এমন হুজুর কই পাই ভাবি বলেন তো?

– হুজুররা তো জংগি হয় ভাবি! মেয়ের এই অবস্থা কীভাবে হল? নিকাব পরে না তো আবার?

– নিকাব পরবে বলে ওর বাবার সামনে ঘোষণা দিয়ে ফেলেছে। অনেক কষ্টে থামিয়েছি। ওর সাথেই সুরভী সবুজ শাড়ি পরে পরীর মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আমার মেয়েটা বোরকা পরে আছে! ভাল লাগে আপা? কেউ আমার মেয়ের দিকে তাকাবে আজকে?

……………………….

সুরভী আর আনিকা খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। বিয়ে বাড়িতে খাবার ছাড়া আর কী আছে! কাচ্চি, রোস্ট আর কাবাবের জন্যই তো এই ভীর ভাট্টা ঠেলাঠেলি। সুরভী অবশ্য তেমন একটা খেতে পারে না। আনিকা ঠিক করেছে সুরভী যা যা খাবে না, সব আনিকা নিজের প্লেটে নিয়ে নিবে। সুরভীর সাথে কোথাও খেতে গেলে লাভ বই লোকসান নেই।
আনিকাদের এক দেড় হাত দূরে দুইজন আন্টি ফিসফিস করছেন। এর মাঝে একজন এগিয়ে এলেন ওদের কাছে। 

– এই মেয়ে নাম কী তোমার?

আনিকা ধরেই নিয়েছে প্রশ্নটা সুরভীকে করা হয়েছে। ওদিকে সুরভী ওকে গুতাচ্ছে…নাম বল! তোকে নাম জিজ্ঞেস করেছে।

আসলেই ভদ্রমহিলা আনিকাকে প্রশ্নটা করেছেন।

– আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আমি আনিকা।

– ওয়ালাইকুম সালাম। বাসা কোথায় আম্মু? বাবা কী করে? কয় ভাইবোন? কীসে পড়ছো?

এরকম একের পর এক প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আনিকার অবস্থা কেরোসিন। ওদিকে সুরভী মিটিমিটি হাসছে। 

আন্টিদের এড়িয়ে এক ফাঁকে আনিকার কানে কানে বলেও ফেলেছে, “তোর এবার একটা গতি হবে রে আনিকা!”

দীর্ঘ প্রশ্নোত্তর পর্ব চলতে চলতে আনিকাদের সামনের টেবিলটা খালি হল। মুহূর্তে বাচ্চা কাচ্চা সমেত আপু, আন্টি দিয়ে টেবিল ভর্তি হয়ে গেল। দুই আন্টিও ঝপ করে বসে পড়েছেন। খালি আছে কেবল একটি চেয়ার।
আনিকা আর সুরভীর দীর্ঘশ্বাস। এ টেবিলেও বসা হবে না! ওরা চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ সেই আন্টির ডাক,
-এই আনিকা! একটা চেয়ার খালি আছে। তুমি এখানে বসে পড়। তোমার বান্ধবী সামনের টেবিলে বসুক।

-হ্যাঁ হ্যাঁ আনিকা তুই এখানে বস। 

সুরভী জোর করে ওকে বসিয়ে দিয়ে গেল। ওর চোখে মুখে দুষ্টুমির ঝিলিক। আজ আনিকাকে রোস্ট বানানো হবে!

একদম আন্টির মুখোমুখি চেয়ারে আনিকা খেতে বসেছে। শান্তিমত খেতে পারছে না। আন্টি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ও কীভাবে মুখে কাচ্চি তুলছে, কীভাবে চাবাচ্ছে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে!
খেতে খেতে আন্টিদের গল্প চলছে। প্রধাণ বক্তা প্রশ্নকর্তা আন্টি।

– বুঝলেন ভাবি, আমার ছোট ছেলেটার জন্য মেয়ে দেখছি। ঠিক করেছি আগে থেকেই পর্দা করে এমন মেয়ে দেখব। বিয়ের পর পর্দা করবে এমন আশ্বাস দিয়ে আসলে পর্দা হয় না। কত মেয়ে দেখলাম অমন!

– ছেলে কি পর্দানশীন মেয়ে খুঁজছে নাকি ভাবি?

– আমার ছেলের অত বাছ বিচার নেই। শুধু বলে মা ভদ্র শিক্ষিত ফ্যামিলির একটা সুন্দর মেয়ে দেখো। পর্দানশীন আসলে আমিই খুঁজছি। মেয়েদের একটু পর্দা করা দরকার। অত খোলামেলা মেয়ে দিয়ে সংসার টিকে না।

– কিন্তু ভাবি পর্দা করা মেয়েরাও হুজুর ছেলে খোঁজে আজকাল। আপনার ছেলে তো হুজুর না।

– কী বলেন ভাবি! আমার ছেলে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে। কাজে ব্যস্ত থাকলে সব নামায একসাথে কাজা পড়ে নেয়। অফিসের ট্যুরে গেল গত সপ্তাহে। সাথে মেয়ে কলিগরাও ছিল। আমার তো টেনশন….। উঁচা লম্বা ফর্সা ছেলে আমার। মেয়েরা খালি ছোঁক ছোঁক করে। আমি বারবার ফোন করে খোঁজ নিয়েছি। রাত ১ টায় ফোন দিয়েছি ভাবি… ছেলে আমার বলে মা ফোন রাখো তাহাজ্জুদ পড়ব।

– মা শা আল্লাহ! ছেলে তো আপনার অনেক পরহেজগার!

– পরহেজগার মানে! ওর কুরআন হাদীসের এত জ্ঞান ভাবি…কী বলব! ওর মুখে হাদীসের কথা শুনলে আপনার কলিজা ঠান্ডা হয়ে যাবে। অন্তরটা ভরে যাবে!

শুধু একটাই ভয় না জানি মেয়েদের পাল্লায় পড়ে! ছেলে আমার কিছুই লুকায় না। ট্যুরের ছবি দেখতে চেয়েছি। সব দেখালো। সব ছবিতে মেয়ে কলিগগুলো ওকে ঘিরে আছে। ওর কী দোষ বলেন…! এবার বিয়ে দিয়ে দিব। যত খুশি বউকে নিয়ে ট্যুরে যাও। 

আনিকা মনে মনে প্রমাদ গুনলো। চোখে কেবল ভাসছে অসংখ্য নারী বেষ্টিত তাহাজ্জুদ গুজার ভাইয়ের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে। আর তার মা গভীর মনযোগে তিনবেলা আনিকার ভাত চাবানো দেখছে।

খাওয়া দাওয়া শেষে আন্টি আনিকার মায়ের ফোন নাম্বার নিল। এদিকে আনিকা চিন্তায় শেষ। যেভাবেই হোক এ সম্বন্ধ বাসায় পৌঁছুতে দেয়া যাবে না। ফর্সা লম্বা তাহাজ্জুদগুজার ভাইকে পেলে মা বাবা ওকে বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। আন্টি চলে যাচ্ছেন। যা করার এখনই করতে হবে।

আন্টি সিঁড়ি দিয়ে নামছে, আনিকাও বোরকা দিয়ে মেঝে মুছতে মুছতে দৌড়ে আসছে।

– আন্টিইই…আন্টিইইই!

– কী হল মা?

– আন্টি আমার আলজিহ্বা দেখবেন না?

– হ্যাঁ!

– আন্টি আলজিহ্বা দেখবেন না?

– মানেহ?

– না বলছিলাম, আমার দাঁত মাড়ি জিহ্বা সবই তো দেখেছেন। আলজিহ্বাটা দেখা বাকী আছে। এই যে দেখেন আন্টি… আ আ আ।
দেখেছেন আন্টি? সুন্দর না? আসি তাহলে। আসসালামু আলাইকুম।

ছেলের পাত্রী সন্ধানী আন্টির চোয়াল ঝুলে পড়ল। ওদিকে আনিকার থেকে বেশ কয়েক হাত দূরে দূরে থাকা পর্যবেক্ষক নার্গিস বেগমেরও মাথাটা ঘুরে উঠল।

দুই দিক থেকে দুই ভদ্রমহিলার যুগপৎ চেষ্টা সত্ত্বেও আনিকার কোনো গতি হল না!

“গতি-দুর্গতি “
উম্ম মারঈয়াম
(২১ নভেম্বর ২০১৭)