ঘরের কাজ

দুই বছর পর সাত মাসের ছেলে নিয়ে দেশে এসেছে নিতু। সৌভাগ্যক্রমে একজন খাদিমার ব্যবস্থা করতে পেরেছে ওর মা আগে থেকেই। বিয়ের আগে মায়ের সংসারে ঘরের কাজের দিকে নিতুর নজর দিতে হয়নি। ওর মা খুব চটপটে গৃহিণী। উনি নিজেই অনেক কাজ করে ফেলতেন। ওর বাবার বাড়িতে খাদিমাও থাকত সবসময়। তারচেয়ে বড় কথা ওর মা মনে করতেন বার বার ঘরের কাজের জন্য ডাকলে পড়াশোনায় ব্যঘাত ঘটবে। উনি মেয়েদের পড়াশোনার প্রতি খুব যত্নবান ছিলেন। 

ঘরে যে আসলে কত শত ছোটখাটো কাজ থাকে এটা নিতু প্রথম বুঝতে পেরেছে ওর বিয়ের পর এবং আরও ভালোভাবে অনুভব করেছে স্বামীর সাথে বিদেশে যাওয়ার পর। এই কাজগুলো এমন যে করে ফেললে মনে হয় অতি সামান্য ব্যপার কিন্তু না করলে যেন ঘরটা আর সচল থাকে না। 

প্রথমবারের মত নিতুর উপলব্ধি হোল যে, মেয়েরা যদি ঘরের কাজগুলো না করত তাহলে গোটা পৃথিবীটা অচল হয়ে যেত! দিনের প্রথম কাজটা করে মেয়েরা, দিনের শেষ কাজটাও করে মেয়েরা। আগে পরের এই কাজগুলো না হলে মাঝের কাজগুলো যেন সব জট পাকিয়ে যাবে!

যা বলছিলাম, বিদেশে নিতুর কোন খাদিমা ছিল না। স্বামী নিয়ে প্রথম একা সংসার শুরু করেছে। তারপর নিজে অন্তঃসত্তা হয়েছে। প্রথমে ছিল শুধু একজন মানুষের দেখাশোনা করা, তারপর হলো শারীরিক অসুবিধা নিয়ে দেখাশোনা করা। এরপর আরও একজন মানুষের যত্ন নেয়া যে নিজের কোন কাজটাই করতে পারে না বরং দেরি হলে প্রবল আপত্তি জানাতে থাকে। এই পর্যন্তও সবকিছু বেশ ঠিকঠাক চলছিল। নিজের সংসারে নিজের মতো করে ও চালিয়ে নিতে পারছিল। 

কিন্তু দেশে আসলে অবশ্যই একজন খাদিমা লাগবে। নিতুর শ্বশুরবাড়িতে বাড়তি কোন কাজের মানুষ নেই। এদিকে দেশে বাচ্চাকে প্রতিদিন গোসল দেয়া, বাচ্চার কাপড় ধোয়া, শুকানো, ঘরে আনা ইত্যাদি নানা কাজ যুক্ত হয়। এখানে রুম বেশি, আসবাব বেশি তাই বাচ্চাকে সারাক্ষন চোখে চোখে রাখতেও হয়। 
একজন খাদিমা পাওয়ার পর এবং মাসখানেক যাওয়ার পর নিতু দেখল যে বাড়ির মুরব্বীরা অভিযোগ করছেন যে সে যথাযথভাবে কাজের মানুষ চালাতে জানে না। তাকে ঠিকমত হুকুম করতে পারে না অথচ এদিকে তাকে প্রতি মাসে কয়েক হাজার করে টাকা দিতে হচ্ছে। ভাবখানা এমন যে মানুষকে খাটিয়ে এই টাকাটা উসুল করতেই হবে। তাদের কে বোঝাবে যে নিতু বিদেশে একা সংসার করেছে তাই হুকুম দিতে সে অভ্যস্ত নয়। 

অনেক কাজ সে নিজেই করে ফেলতে চায়। কখনো সে মনে করে যে থাক মেয়েটা তো আমার বাচ্চাকে নিয়ে আছে, আমিই না হয় কাজটা করে ফেলি। কখনো সে ভাবে মেয়েটা তো ঘরের অন্য কাজও করছে আমি এই কাজটা করে তার দায়িত্ব কিছুটা কমিয়ে দেই। 

নিতু বুঝতে পারে ঘরের কাজ করতে, বাচ্চা দেখাশোনা করতে সময় ও শ্রম লাগে। সে তাই মেয়েটাকে দুপুরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে দেয় যদিও তার বাচ্চা জেগে থাকে এবং তাকেও জাগতে হয়। নিতুর যদি আরামের প্রয়োজন হয় তাহলে খাদিমারও সেই প্রয়োজন আছে। নিতু এই প্রথম কাজের মানুষ চালাচ্ছে এবং উপলব্ধি করছে যে কাজের মানুষ চালানোও একটা আর্ট। 

কাজের মানুষকে সাধ্যাতীত কাজ দিয়ে দিনের পর দিন তার থেকে সেই কাজ আদায় করা যাবে এটা ভাবলে ভুল হবে। সারাক্ষণ তার দোষ ত্রুটি ধরলে তার মন এমনিই খারাপ হবে এবং কাজেও অনীহা চলে আসবে। তাকেও তার মতো করে কাটানোর কিছু সময় দিতে হয়। তাহলেই মানুষের সাথে মানুষের একটা মায়ার সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা অর্থ দিয়ে পাওয়া যায় না। প্রয়োজনের সময় এই মায়ার টানেই মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। 

……………

ঘরের কাজ
বিন্ত খাজা
(৯ জানুয়ারী ২০১৮)