দ্যা ম্যাসেজ

আনিতা একটা স্কুলে চাকরী নিয়েছে। বছরের পর বছর আদিল একটা কিছু করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। 

দুই সন্তানকে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তারা। আদিলের এমন অবস্থা যে, সে রিক্সা ভাড়াটাও দিতে পারে না। হেঁটে হেঁটে এখানে সেখানে যায়। কারো কাছে হাত পাততে পারছে না, কাউকে কিছু বলতেও পারছে না তারা। অথচ একটা সময় আদিল কত স্বচ্ছল অবস্থায় ছিল।

বিয়ের সময় অনেক গহনা পেয়েছিলো আনিতা। সেই গহনা বিক্রি করে সংসার চালায় সে। সে তো আর রাজরানী নয় যে তার অঢেল গহনা আছে। বসে বসে খেলে তো রাজার ভাণ্ডারও ফুরিয়ে যায় একদিন। তাই সে ঠিক করলো কিছু একটা করতে হবে তাকে। পাশের কিন্ডারগার্টেন স্কুলে গিয়ে সিভি জমা দিয়ে আসলো। 

একদিন পরেই সেখান থেকে ফোন আসলো। নির্ধারিত সময়ে গিয়ে ইন্টার্ভিউ দিয়ে আসলো। সেদিনই তাকে জানিয়ে দেওয়া হলো, তাকে শিক্ষক হিসাবে মনোনীত করা হয়েছে। খুব কম টাকা। কিন্তু তাতে কি, কিছু তো হেল্প হবে সংসারের জন্য। বাসায় এসে আদিলকে বললো। আদিল বিশ্বাস করতে চায় না। কারণ বছরের পর বছর সে কিছুই করতে পারছে না, আর আনিতা একদিনের মাথায় চাকরী পেয়ে গেলো কিভাবে!

আনিতার চাকরী জীবনের বছর দুয়েক পার হয়ে গিয়েছে। আদিল এখনো আগের অবস্থায়। কোনো পরিবর্তন নেই তার অবস্থার। ছেলে হিসাবে আদিল ভালো। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, বাজে কোনো নেশা নেই। কিন্তু আয়ের কোনো ব্যবস্থা করতে না পারায় দিনদিন মন ভেঙে যাচ্ছে তার। মাঝে মাঝে সে ভাবে, দুই নাম্বারি কাজ কারবার শুরু করে দিলেই তো হয়। আনিতাকে বলে সে কথা। আনিতা বুঝায়, ধৈর্য ধরতে বলে। 

বাচ্চারা বড় হচ্ছে। তাদের এখন আরো খরচ বেড়েছে। স্কুলের চাকরীর আয়ে চলছে না। একটা ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে হবে, চিন্তা করলো আনিতা। ব্যাংকে চেষ্টা করলে কেমন হয়? তার বেশীরভাগ আত্মীয়স্বজন তো ব্যাংকেই চাকরী করে। আদিলের সাথে পরামর্শ করে সে। আদিল অমত করেনি। 

কিছু আত্মীয়স্বজন আছে তাদের, যারা কিনা বেশ প্রভাবশালী। তেমনই এক আত্মীয়ের কাছে গিয়ে সাহায্য চাইলো আনিতা। একটা নামকরা সূদী ব্যাংকে চাকরী চায় সে। যেমন করেই হোক তাকে সেই ব্যাংকে ঢুকতেই হবে। আত্মীয় অভয় দিলেন, তবে সাথে এও বললেন যে, ব্যাপারটা সহজে হবে না। অনেক জায়গায় তদবির করতে হবে। 

প্রায় তিনমাস ধরে আনিতা এখানে ওখানে তদবির করে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো ফল পাচ্ছে না। প্রায়ই তার মন খারাপ থাকে। ইদানীং মন খারাপ থাকলে সে অর্থ আর তাফসির সহ কুরআন পড়ে। বিয়ের সময় তার ছোটভাই তাফসির সহ কুরআনটা উপহার দিয়েছিলো।

একদিন সকালে সে কুরআন পড়ছিলো। সূরা বাকারার শেষের কিছু আয়াত পড়তে পড়তে চমকে গেলো। বিশেষ করে ২৭৯ নাম্বার আয়াত। সূদের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকলে আল্লাহ্‌’র সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করা হবে। তাফসির পড়তে গিয়ে সাথে হাদিসের কথাটাও পড়লো সে। হাদিসে বলা হয়েছে সুদ খাওয়া, দেওয়া, কারবার লেখা ইত্যাদি সুদের সব কাজের সাথে রিলেটেড থাকলে তার উপর আল্লাহ্‌’র লানত থাকবে সর্বক্ষণ। 

কিসের পিছনে দৌড়াচ্ছে সে? নিজেকে প্রশ্ন করে আনিতা। সারাদিন আয়াতটা ঘুরপাক খাচ্ছে মনের মাঝে। মনে মনে ডিসিশন নিয়ে ফেলে, নাহ, আল্লাহ্‌’র লানত নিয়ে সে দুনিয়ার বুকে চলবে না। আল্লাহ্‌’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষমতা যেহেতু তার নেই, সাধারণ ভাবেই কাটুক তার জীবন, দরকার হলে না খেয়েই থাকবে। আল্লাহ্‌ যখন তাকে ম্যাসেজ পাঠিয়েই দিলো, ম্যাসেজটা গ্রহণ করে নিলো সে। 

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, সেদিন বিকেলবেলা সেই প্রভাবশালী আত্মীয় তাকে ফোন দিয়ে বললো, “আনিতা আগামীকাল সকালে কাগজপত্র নিয়ে চলে আসো আমার বাসায়। চাকরী কনফার্ম তোমার। এখন যা বেতন পাচ্ছো তার থেকে তিনগুণ বেতন বেশী। ছয়মাস পর চাকরী স্থায়ী হলে বেতন আরো বাড়বে।”
আনিতা অনেক বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে, শক্তি সঞ্চয় করে বলে ফেললো,” চাকরীটা করছি না আমি। সুদের কোনো কাজে আমি নেই।” অপর প্রান্ত থেকে অকথ্য ভাষার তুবড়ি চললো। বুঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো আনিতা। লাভ হলো না। 

আনিতার চোখে পানি। সে হজম করলো কথাগুলো। সে জানে তার এই প্রত্যাখ্যানের জন্য পরিবারের অনেকের সাথে সম্পর্ক খারাপ হবে। কিন্তু সে আল্লাহ্‌কে ভয় পায়। আল্লাহ্‌’র জন্য সে দুনিয়া ছাড়তে প্রস্তুত। কোথা থেকে তার বুকে এত শক্তি আর সাহস এসেছিল, সে জানে না। 

কাছের ও দূরের যারাই তার এই চাকরী ফিরিয়ে দেওয়ার কথা শুনেছে, তারাই তাকে বোকা, লুজার, বেশী বুঝা পাবলিক, পাগল, মাথা নষ্ট ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত করেছে। সেই প্রভাবশালী আত্মীয় সহ অনেক কাছের মানুষদের সাথে হয়েছে প্রচণ্ড মনমালিন্য। 

আনিতা একটা কথাই বারবার বলেছে সবাইকে, “সংসার চালানোর দায়িত্ব আমার না, আমি সহযোগীতা করছি মাত্র, কিন্তু সেটা হালাল ভাবেই করতে চাই। আমার কাজের জন্য আমাকেই আল্লাহ্‌’র কাছে জবাব দিতে হবে। কেয়ামতের সময় কেউ সাহায্য করবে না আমাকে, এমনকি যাদের জন্য এই চাকরী করছি, তারাও সাহায্য করবে না।” সে যখন এই কথা বলতো, তখন বেশীরভাগ মানুষ বলে ফেলতো, “তাহলে তুমি কি বলতে চাও তোমার অমুক মামা, অমুক চাচা হারামের সাথে জড়িত?” অথবা বলতো, ” তুই কি বলতে চাস আমিও হারামের সাথে জড়িত?” উত্তরে আনিতা বলে, ” হারাম তো সবসময় হারাম, সারা দুনিয়ার মানুষ হারাম কাজ করলেও, সেই হারাম হালাল হবে না।” 

সূদী ব্যাংকের চাকরী ফিরিয়ে দেওয়ার পর এক মাসের মাথায় একটা ভালো চাকরী পেয়ে যায় আনিতা। তার চাকরী পাওয়ার ছয় মাসের মাথায় সরকার পে-স্কেল ঘোষণা করে। আল্লাহ্‌’র রহমতে বেতন বেশ ভালোই বেড়ে যায় তার। 

আদিলের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি এখনো। আনিতা ও আদিল মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে একদিন আদিলের অবস্থার পরিবর্তন হবে। কিভাবে হবে জানে না, তবে হবে, এই দৃঢ় বিশ্বাস তাদের আছে। আইয়ুব আলাইহে ওয়া সাল্লামের মত হয়তো আল্লাহ্‌ আদিলকে ৩/৪ গুন বেশী দিয়ে দিতে পারেন। সূরা ত্বালাকের ২-৩ আয়াতের কথা মনে প্রানে বিশ্বাস করে তারা। তারা এটাও এখন অনুভব করে যে, তাদের এই খারাপ সময়ের দরকার ছিল নিজেকে চেনার জন্য, মানুষকে চেনার জন্য।

আনিতা যদি সেসময় ব্যাংকের চাকরীটা করতো, এতদিনে তার ফ্ল্যাট আর গাড়ি হয়ে যেতো। ছয় ডিজিটের সর্বোচ্চ বেতন পেতো সে। প্রতিবছর বিদেশ ঘুরে আসতে পারতো ফ্যামিলি নিয়ে। বাচ্চাদের ভালো স্কুলে পড়াতে পারতো। কিন্তু সেজন্য আফসোস নেই তার। 

কারণ অভাব অনটনের মাঝেও অনেক বরকত পায় আনিতা ও আদিল। শুধু একটা বরকতের কথা বলি। আদিলের স্বচ্ছল জীবনের সময় হজ্জ ফরজ হয়ে যায়, কিন্তু অজ্ঞানতার জন্য সে সময় হজ্জ করেনি সে। টানাটানির সংসারে কিভাবে যেনো আনিতা চাকরির আয় থেকে দুজনের হজ্জের টাকা জমিয়ে ফেলে। সেটাই তাদের সর্বশেষ সম্বল। হজ্জে চলে যায় দুজন। সেই আনন্দ তাদের জীবনের অনেক বড় পাওয়া। যেটা অনেকেই বুঝে না। 

তাদের হজ্জে যাওয়া দেখে মানুষ ভাবে তাদের বুঝি প্রচুর টাকাকড়ি। কিন্তু আদতে তাদের কিছুই নেই। নিজেদের অভাবের কথা বুঝতে দেয় না তারা কখনো। অন্যকে বুঝতে না দিয়ে নিজেরা কষ্ট করে থেকেও যে প্রশান্তি তারা পায়, সেটা আকাশ থেকে ফয়সালা হয়েই আসে। 

সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা।

দ্যা ম্যাসেজ
তাহনিয়া ইসলাম খান
(২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৮)