পাত্রী চাই

“আপা মেয়ে তো খুঁজে পাচ্ছি না।” চেয়ারে বসতে বসতে হতাশ কন্ঠে দীপুর মা বললেন।

“আপা কম মেয়ে তো দেখলেন না, কাউকেই তো আপনার পছন্দ হল না।” সাথে সাথে উত্তর দিয়ে দিলেন মায়ার শাশুড়ি।

“এটা কী বললেন আপা? একমাত্র ছেলে আমার একটু দেখে শুনে বিয়ে দিব না?”

“তা তো অবশ্যই। কিন্তু পনেরো-বিশটা মেয়ের কাউকেই আপনার পছন্দ হল না?”

“না…ইয়ে মানে, বলতে চাচ্ছিলাম আর কি আপনার ছোট বউটা কী যেন নাম? নীতু? মা শা আল্লাহ্‌ রুপে গুণে পরীর মত আপা। অমন একটা বউ পেলে আর কিছু লাগে বলেন? অমন মেয়ে তো একটাও পেলাম না।”

মায়ার শাশুড়ি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “আপা আমার ঘরে কিন্তু তিনটা বউ। একজন বেশি ফর্সা সুন্দর মানে যে বাকীদের কোন দাম নেই তা কিন্তু না। আমার চোখে ওরা তিনজনই সমান।”

“না না আপা আপনার তিন বউই অনেক ভাল মা শা আল্লাহ্‌। কিন্তু ছোট বউটাকে আমার একদম পরীর মত লাগে।”

“আপা এটাই তো আমাদের সমস্যা! আসলে আমরা যতোই মুখে ধর্মের কথা বলি না কেন সামাজিক সমস্যাগুলো থেকে নিজেদেরকে আমরা বের করতে পারিনি এখনো। যেখানে গায়ের রঙ এর উপর মেয়েকে সম্মান দেওয়া হয়, ঘরের কাজ করতে পারে না মানে সেই মেয়ে সংসার করার যোগ্যই না। বাপের বাড়ির টাকা পয়সার উপর মেয়েকে আদর যত্ন করা হয়।

“হুম, ঠিকই বলেছেন আপা। আসলে সুন্দর শিক্ষিত একটা বউ না আনলে আত্মীয় স্বজনরাই পরে কথা শোনাবে। এই আর কি।”

“তা বটে! আমরা তো আল্লাহ কে কম মানুষকে বেশি ভয় পাই। সমাজ বলে কথা!”

“কী যে বলেন আপা! সমাজ ছাড়া কে চলতে পারে বলেন? আচ্ছা আমাকে আর কয়টা মেয়ের খবর দিয়েন তো। ছেলেটা বিয়ে বিয়ে করে মাথা খাচ্ছে।”

“তো খাবে না? বয়স তো কম হল না ছেলের। যাদের কে বাদ দিয়েছিলেন তাদের ভেতর থেকেই দেখেন না হয় আবার।”

“তারা তো সবাই এখনো লেখাপড়া করছে!”

মায়ার শাশুড়ি আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “এই যে একটু আগে আমার ছোট বউ এর সুনাম করলেন, ও তো এখনো লেখাপড়া করছে। সাথে সংসারও সামলাচ্ছে মা শা আল্লাহ। ওর ক্লাস এর সময়, পরীক্ষার সময় আর পড়ার সময় ওর কাঁধে কোন কাজ দেই না আমরা, আমার বাকি দুই বউও এই ব্যাপারে যথেষ্ট সহযোগিতা করে মা শা আল্লাহ্‌। একটু তো ছাড় দিতেই হবে শিক্ষিত বউ চাইলে তাই না?”

“এটা তো অনেক বড় সমস্যা আপা! পাশের বাসার লিপি ভাবীর বউ এই পড়ার নাম করে নিজের ঘর থেকেই বের হয়না! আমি ছেলের বিয়ে দিব নিজে একটু আরাম করব তাই। এই বয়সে আর কতো খাটা যায় বলেন?”

মায়ার শাশুড়ি অবাক হয়ে বললেন, “আপা আপনার মেয়ের পড়ার সময় কি আপনি তাকে একটু ছাড় দেন না কাজ কর্ম থেকে? তাহলে বউ কে কেন দিবেন না? সে শিক্ষিত হলে কি আপনার কোন লাভ নেই? আপনার বংশধর একজন শিক্ষিত মা পাচ্ছে আপনি একজন শিক্ষিত বউ পাচ্ছেন। মানুষকে আরো গর্ব করে বলতে পারছেন আপনি আপনার বউ এর পড়ালেখায় সাহায্য করেছেন! আর সে তো আজীবন লেখাপড়া করছে না।”

“না না আপা। এরপর লেখাপড়া শেষ করে বলবে চাকরি করব! তখন? আমার ষোলকলা পূর্ণ হবে।”

“তাহলে আপনিই সিদ্ধান্ত নেন কী করবেন। ছেলের বয়স ৩৩ পার হতে চলল এখনো আপনি এতো খুত খুত করছেন মেয়ের ব্যাপারে। এটা কী ঠিক হচ্ছে? আপনি নিজেকেই প্রশ্ন করুন।”

“নাহ আপা, এটাও ঠিক বলেছেন। কবে না কবে মরে যাই তার আগে নাতী নাতনীদের মুখ দেখব না?”

মায়ার শাশুড়ি হেসে দিয়ে বললেন, “সন্তান নেওয়াটা কী মানুষের হাতে নাকি? আল্লাহ্‌ যখন চাইবেন তখনই না দিবেন!”

“তা তো ঠিকই। আমি দীপু কে বলে দিয়েছি বিয়ের ৬ মাসের ভেতর প্রমোশনের ব্যবস্থা করতে নয়তো কোথাও ছুটির দুই দিন পার্ট টাইম শুরু করতে। বাচ্চার জন্য অতিরিক্ত খরচ আছে না?”

মায়ার শাশুড়ি শেষবারের মত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “আজ আমি উঠি আপা। বড় ছেলেটা চাকরী ছেড়ে দিয়েছে গত মাসে। আজকে ওর আরেক জায়গায় ইন্টার্ভিউ, ওদিকে ওর বউ এর ডেলিভারি ডেইট আগামি মাসে। এই নিয়ে কিছুটা চিন্তায় ছিলাম। বড় বউ সকালে বলল, একদম চিন্তা করবেন না মা। রিযিকের মালিক আল্লাহ্‌! কোথাও না কোথাও থেকে কিছু না কিছু ঠিকই ব্যবস্থা হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ্‌ এমন অবস্থায় আমি ওকে স্বান্তনা দিব কী উলটা সেই আমাকে বোঝাচ্ছে! বাসার সবাই একটু আধটু চিন্তা করলেও আল্লাহ্‌র উপর আমাদের ভরসা আছে নিশ্চয় উনি উত্তম কিছুই রেখেছেন আমাদের জন্য। এমন একটা সময় হায় হুতাশ না করে আমরা দুয়া করে যাচ্ছি। আল্লাহ্‌ তো বলেছেনই আমি আমার বান্দার প্রতি তেমনই যেমন সে আমার উপর ধারণা রাখে।
ইন শা আল্লাহ্‌ সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার ছেলে নিশ্চয় সারা জীবন বেকার বসে থাকবে না? সে যথেষ্ট দায়িত্ববান। এখন তার দরকার একটু মানসিক সাপোর্ট। যেটা দেওয়ার চেষ্টাই আমরা করছি। দুয়া করবেন আমাদের জন্য। আমিও দুয়া করব যেন আপনার ছেলে ভালো একজন পাত্রী পেয়ে যায় যে মনে প্রানে একজন ভাল মানুষ হবে, সামাজিক কলুষতা থেকে যে নিজেকে মুক্ত করে সুষ্ঠু স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপন করতে পারবে ইন শা আল্লাহ্‌ ।

“আপনাদের কথা শুনে তো আমিই টেনশন এ পরে গেলাম আপা! এ কী অবস্থা আপনাদের? এমন কেন হল? আহারে ছেলেটা! আচ্ছা বাচ্চা হওয়ার খরচ তো মেয়ের বাড়ি থেকেই দেওয়ার কথা, তাই না?”

“এটা কী বললেন আপা? বাচ্চা হবে আমার ছেলের! বংশধর আসবে আমার! সেটার খরচ মেয়ের বাপের বাড়ি কেন দিবে? এসব প্রথা অতি শীঘ্রই দূর না করলে সাংসারিক অশান্তি গুলোও কোনদিনও শেষ হবে না আপা।

আলহামদুলিল্লাহ্‌। আমরা দুশ্চিন্তা করছি না। আপনিও করবেন না। শুধু সম্ভব হলে দুয়া করবেন।
আজ তাহলে আসি।
ফি আমানিল্লাহ।”

“ফি আমানিল্লাহ আপা।” এরপর দীপুর মা চোখ মুখ কুঁচকে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন।

………………………
পাত্রী চাই
সাকিবা আহমেদ

মে ০১, ২০১৮ইং