প্রিয় বাপী, প্রিয় মামণি (শেষ পর্ব)

প্রথম পর্বের পর…….

ফুপি উত্তর দিলেন, “যারা পৃথিবীতে ভালো কাজ করে, আল্লাহ্‌র কথা শোনে, তারা আল্লাহ্‌র কাছে গিয়ে শান্তিতে ঘুমায়। আর যারা মিথ্যে কথা বলে, মানুষকে কষ্ট দেয়, পচাঁ পচাঁ কাজ করে তারা আল্লাহ্‌র কাছে গিয়ে শাস্তি পায়।”

আবির আবার জিজ্ঞেস করলো, “বাপী আর মামণি এখন কী করছে, ফুপি?” ফুপি আনিলা আর আবীরের চোখে চোখ রেখে বললেন, “বাপী আর মামণি দুজনই এখন তোমাদের কাছ থেকে একটি জিনিস পাওয়ার জন্য অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে।” দু’জনই চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, “কি সেটা?” ফুপি উত্তর দিল, “দোয়া। এই মুহূর্তে বাপী আর মামণির সবচেয়ে বেশি দরকার তোমাদের দুজনের দোয়া। তোমরা যত বেশি দোয়া করবে, বাপী আর মামণি আল্লাহ্‌র কাছে ততো ভাল থাকবে।”

আনিলা জিজ্ঞেস করল, “কোন দোয়াটা করবো? ওই যে গত রাতে দাদু আমাদের যে দোয়াটা শিখিয়েছেন, ওটা? রাব্বির হামহুমা কামা রব্বাইয়ানি সগি-রা?” ফুপি নরম স্বরে বললেন, “হ্যা মা। তুমি কি অর্থটা জানো?” আনিলা চটপট জবাব দিল, “হে আমাদের পালনকর্তা, তাদের দুজনের (বাবা, মা) প্রতি দয়া করো, যেমন করে তারা আমাকে ছোটবেলায় লালন-পালন করেছেন।”

আবির প্রশ্ন করল, “শুধু দোয়া করলেই হবে, ফুপি?” ফুপি বললেন, “উহু, দোয়া করার সাথে সাথে তোমাদের আরও কিছু দায়িত্ব আছে। বাপী, মামণি তোমাদের যেসব ভালো কাজ শিখিয়েছেন, সেগুলো বেশি বেশি করে করতে হবে। আর যেসব পচা কাজ করতে মানা করেছেন, সেগুলো একদম করবে না। তোমাদের ভালো কাজের জন্য আল্লাহ্‌ বাপী আর মামণি কে অনেক অনেক প্রাইজ দিবেন। তোমরা কি তা চাও?” দুই ভাই-বোন ছলছল চোখে জোরে জোরে মাথা নাড়ল।

৮.
সেদিন ভোরবেলায় আনিলা বাবা-মাকে স্বপ্নে দেখল। বাপী আর মামণি সাদা ধবধবে পোশাক পরে একসাথে একটি বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আনিলা বাগানের গেইটের কাছে এসে বলছে, “বাপী, আমি আর আবিরও বাগানে ঢুকতে চাই, তোমাদের সাথে থাকতে চাই।” বাপী মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, “এখনো সময় হয়নি মা, বাগানে ঢুকতে হলে তোমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।”

আনিলার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। অনেকদিন পর বাপী, মামণি কে এত কাছ থেকে দেখল। স্বপ্ন কি এতো জীবন্ত হতে পারে? দৌড়ে আনিলা মামণির রুমে গেল। সুইচ টিপে লাইট জ্বালাল। কে–উ নেই। বাপীর অফিসের ফাইল, কম্পিউটার, রিডিং গ্লাস, পানি খাওয়ার মগ, মামণির ড্রেসিং টেবিল, জায়নামাজ, আলনায় ঝোলান সালোয়ার-কামিজ, হ্যান্ড-ব্যাগ সব আগের মতোই যার যার জায়গায় আছে।

ঢং ঢং করে বড় দেয়াল ঘড়িটাতে ছয়টা বাজল। মামণির কাছে শুনেছে, এই ঘড়িটা নাকি বিয়ের সময় নানাভাই বাপীকে দিয়েছিলেন। ঘড়িটা এখনও বেঁচে আছে, টিক টিক করে সময় দিয়ে যাচ্ছে কেবল নেই শুধু ……………………।

বাপী-মামণির খাটের দিকে তাকিয়ে আনিলার বুকের ভেতরে কেমন হু হু করে উঠল। নেপাল যাওয়ার আগের দিন রাতেও এই খাটে বসে আবিরের ‘পেসহোনাল ব্যাগ’ নিয়ে চারজন কত হাসাহাসি করেছিল। রাতে আনিলা, আবির, মামনি, বাপী সবাই মিলে নেপালের গল্প করতে করতে একসাথে ঘুমিয়েছিল। মামণির বালিশে শুয়ে, বাপীর কোলবালিশে মুখ গুঁজে আনিলা অনেকক্ষণ কাঁদল; বাপী-মামণির গায়ের গন্ধটা যেন এখনও বিছানায় লেগে রয়েছে।

একটু পর নিঃশব্দে পাশের ব্যালকনিতে, মামণির হাতে লাগানো বেলী ফুলের গাছগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সাদা সাদা ফুলে মামণীর ছোট্ট বারান্দাটা ভরে গেছে। কী মিষ্টি গন্ধ বেরুচ্ছে ফুলগুলো থেকে! আনিলা ফুলগুলোর গায়ে পরম মমতায় হাত বুলাতে বুলাতে নিজের সাথে কথা বলতে লাগল, “বাপী আর মামণি সারা জীবন আমাদেরকে অনেক গিফট দিয়েছে। এবার আমাদের দেবার পালা। আমি আর আবির প্রতিদিনই মামণি আর বাপীর জন্য অনেক দোয়া করব, তাদের শেখানো ভাল কাজগুলো বেশি বেশি করে করব যাতে ওরা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে বেশি বেশি পুরস্কার পেতে পারে। এখন যে এটাই ওদের সবচেয়ে দরকার।”

আজ আনিলা, আবির প্রথম মামণিকে ছাড়া স্কুলে যাচ্ছে। গত কাল রাতে আনিলা নিজ হাতে স্কুল ড্রেস রেডি করেছে। আবিরের ব্যাগ গুছিয়েছে, পাউরুটিতে বাটার আর চিনি মাখিয়ে দুই ভাই-বোনের টিফিন রেডি করেছে, ফুপিকে দিয়ে ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রেখেছে যাতে ঠিক সময়ে স্কুলে যেতে পারে। সবার মাকে স্কুলের গেইটে দেখা যাবে কিন্তু মামণি আর কখনো ওদেরকে স্কুলে দিয়ে কিংবা নিয়ে আসবে না একথা ভাবতেই দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল আনিলার চোখ থেকে। চোখের পানি মুছে, মন শক্ত করে আনিলা নিজেকে বোঝাতে লাগল, “আমার এখন অনেক দায়িত্ব। নিজের কাজ নিজে করতে হবে, পড়াশোনা করে ভাল রেজাল্ট করতে হবে, আবির কে দেখে রাখতে হবে। আমার কি এখন কাঁদলে চলবে? বাপী সবসময় বলতেন, ‘ভালো মানুষ হবে, বড় হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবে’। ইনশাআল্লাহ্‌ আমরা অবশ্যই ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করব, বড় হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াব।”

ধীরে ধীরে আকাশের রঙ ফরসা হতে লাগলো। বিষণ্ণ মনে আনিলা ঘরের দিকে পা বাড়াল। যাওয়ার আগে শেষ বারের মতো আকাশের দিকে হাত নেড়ে বলল, “বাপী-মামণি, তোমরা যেখানেই থাক, ভালো থাক। ইনশাআল্লাহ, আবার আমাদের দেখা হবে। রাব্বির হামহুমা কামা রব্বাইয়ানি সগি-রা।”

সমাপ্ত
……………………………………..

প্রিয় বাপী, প্রিয় মামণি (শেষ পর্ব)
উম্মু জুয়াইরিয়া