ফিনিক্স

১.
স্কুল কলেজের বিশাল একটা সময় বাবা মার ছায়াতেই পার করেছি। আশেপাশের সবাই যখন উঠতি বয়সের নানা রকম পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে ব্যাস্ত আমার মধ্যে তখন তেমন কোন পরিবর্তন নেই। অন্যরা যখন নিউ রিলিসড্ হিন্দি/ইংলিশ মুভি আর গানের টানটান উত্তেজনায় উত্তেজিত আমি তখন জাপানিস এনিমে, মিকি মাউস, টম অ্যান্ড জেরি তে ব্যস্ত। অন্যরা যখন স্কুল বা প্রাইভেট শেষে তাদের প্রিয়জনের অপেক্ষায় অস্থির সময় কাটাত, আমি তখন এক কোনায় দাঁড়িয়ে আব্বুর লাল বাইক এর প্রতীক্ষায় থাকতাম। আব্বুর সেই বাইকে চড়ে প্রতি বেলা সব টিচারদের বাসায়, কোচিং, আর স্কুল-কলেজে যাওয়া আসা। আর ঘুরতে গেলেও ঐ আব্বুর বাইকে চড়েই। আব্বুরও যেন কোন ক্লান্তি নেই। যখনি বলব ওখানে যাব ব্যাস বাইক বের করে রেডি। 

স্কুলে থাকতে একটা জিনিস আমি কিছুতেই বুঝতে পারতামনা। কিছু কিছু ব্যাপারে আমাকে আমার অনেক ফ্রেন্ড এড়িয়ে চলত, অনেক কিছু বলতনা। এখন বুঝি, তার কারণ ছিল ভাল ছাত্রী/ভাল মেয়ের ট্যাগ। আমি যেমন ছিলাম সবাই আমার সাথে সেভাবেই মিশত। আমি সে সময় পড়াশুনা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারতামনা তাই তারাও আমার সাথে পড়াশুনা ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে আলাপও করতনা, যদিও তাদের মধ্যে অনেকে আমার অনেক ক্লোসড ফ্রেন্ড ছিল। এটা অবশ্য আমার নিজের মাথা থেকে বের হয়নি এটা ব্যাখ্যা করেছিল অন্য একজন তার পরিচয় কিছু পরে দেব। 

২.
আমার পরিবার একেবারে ফুল প্র্যাকটিসিং না হলেও মোটামুটি ছিল। যে কারনে অনেক ছোট থেকেই বাধ্যতামূলক নামাজ, রোযা, পর্দা করতে হতো। এটা ছিল অনেকটা করতে-হবে-তাই-করা, মন থেকে আসতো না। সেরকম কোন উপযুক্ত উত্তর ও আমি তখন পাইনি যে আসলে কেন আমরা এগুলো করছি আবার বেশী একটা জিজ্ঞেসও করা যেতনা সবাই কি ভাববে এই ভয়ে।

এরপর হঠাৎ একদিন পিস টিভি নামক এক নতুন চ্যানেল দেখা দিল টিভিতে। একদিন দেখি আম্মু ডাকছে এক দাড়িওয়ালা টুপি পরা লোকের (ডঃ জাকির নায়েক) লেকচার শুনার জন্য। দেখলাম উনি অনর্গল কম্পিউটার এর মত কুরআন, বাইবেলের বিভিন্ন টেস্টামেন্ট, বেদ ইত্যাদি থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন এবং যুক্তিগুলি আমাকে খুবই স্পর্শ করছিল। আমার মনে হচ্ছিল ওই মুহূর্তে আমি আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাচ্ছি। আমি টানা কয়েকদিন মুগ্ধ হয়ে শুধু তার লেকচার শুনেছি। তখন থেকে কিছুটা মন দিয়ে ইবাদতগুলি করার চেষ্টা করতাম। 

৩.
ধীরে ধীরে স্কুলের গণ্ডি ছেড়ে কলেজ জীবনে পা দিলাম। স্কুলের ফ্রেন্ডরা বিভিন্ন জায়গায় ভর্তি হওয়ায় আমি অনেকটা একা হয়ে গেলাম। বাসা থেকে টিভি আউট হয়ে আমার কার্টুন, এনিমে দেখাও বন্ধ হয়ে গেল। ফলে শুধু কলেজে, প্রাইভেটে যাওয়া আসা আর বাসায় বসে শুধু পড়া ছাড়া আর কোন করার মত কাজ ছিল না। ফলে ভাল ছাত্রীর ট্যাগটা যেন আরও ভালোভাবে লেগে গেল। মাথার মধ্যেও শুধু একটা জিনিসই কাজ করত যে ভাল কোথাও চান্স না পেলে জীবনের কোন মূল্য নেই। তখনো জীবনের প্রকৃত অর্থ ও উদ্দেশ্য বুঝিনি। আল্লাহ্‌র রাস্তায় পড়াশুনার চেয়ে দুনিয়াবি পড়াশুনার গুরুত্বই ছিল বেশী। 

অবশেষে পরিশ্রমের ফল আল্লাহ্‌ আমাকে দিয়েছিলেন। ভাল জায়গায় চান্স, ভাল বিষয় উভয়ই পেয়েছিলাম। হলে উঠার পর থেকে শুরু হল আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায়। 

এই প্রথম বাবা-মাকে ছেড়ে অনেক দূরে। সবকিছু অপরিচিত। নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয়, নতুন ফেইসবুক একাউন্ট, ভারচুয়াল ফ্রেন্ডস আর আমার প্রিয় এনিমে। বাবা-মাকে ছেড়ে থাকার কষ্ট আর পড়াশুনা রিলেটেড হতাশাগুলি এগুলো দিয়ে ভুলে থাকতে চেষ্টা করতাম। 

সলাতে মনোযোগ আসত না, অত্যন্ত দ্রুতগতিতে কোনরকম পড়ে উঠতে পারলে বাঁচি এমন অবস্থা। কুরআন যেখানে আগে প্রতিদিন পড়তাম সেটা গিয়ে ঠেকল সপ্তাহে এক দিনে বা মাসে এক/দুই দিনে। শয়তান এর কাজ করা আরও সহজ হয়ে গেল। সারাদিন ফেইসবুক আর নিত্য নতুন এনিমে এপিসোড চলতে থাকত আমার পিসিতে। 

৪.
এর মধ্যে ধীরে ধীরে আমার নিজের মধ্যে কিছু পরিবর্তন খেয়াল করতে লাগলাম। যেই আমি প্রেম জিনিসটার সাথে একেবারে অপরিচিত ছিলাম, আস্তে আস্তে সে বিষয়ে আমি জানতে শুরু করলাম। আমার আশেপাশের প্রায় অনেককেই আবিষ্কার করলাম যারা অনেকদিন ধরে প্রেম করছে এবং তাদের কাছে এগুলো ডাল ভাত। নিজেকে সবার মাঝে খুবই বেমানান, আনইজি, ব্যাকডেটেড লাগতে লাগল। ফেইসবুকের দীর্ঘদিন প্রেম করে বিয়ের গল্পগুলি ভাল লাগতে শুরু করল।

এরই মাঝে খেয়াল করলাম আমার ফ্রেন্ডলিস্টের একজনের আমার প্রতি দুর্বলতা। প্রথম প্রথম মেনে নিতে পারলাম না। রাগ হতো। ভাবতাম ব্লক করে দেব, যোগাযোগ বন্ধ করে দিব। কিন্তু পরক্ষনেই তার জন্য খুব কষ্ট লাগত। আমিও একরকম দুর্বল হয়ে গেলাম তার প্রতি। সে ছিল সেই একজন যার কথা শুরুতে বলেছিলাম। 

রিলেশনে শুরু করলাম আমিও। সে আর আমি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় থাকতাম। দূরত্ব অনেক বেশী হওয়ায় যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ফোন। সারাদিন চিটচ্যাট আর ফোনে কথা। রিলেশনের শুরুতে যা হয় আর কি। ওর সাথে কথা না বললে, সবকিছু শেয়ার না করলে শান্তি পেতাম না। রাতভর কথা বলে ফজরে সময়মত উঠতে পারতাম না। ও অনেক সুন্দর কবিতা, গল্প লিখত আর অনেক সুন্দর করে কথা বলতে পারত যা আমাকে খুব মুগ্ধ করত। 

আমি ওকে নামাজ পড়া ধরালাম। প্রতি ওয়াক্তে ফোন দিয়ে মিসকল দিয়ে তাগিদ দিতাম। নিজেও যত যাই হোক আর কিছু করি আর না করি নামাজটা কখনও ছাড়িনি, এজন্যই বুঝি আল্লাহ্‌ আমাকে শেষ পর্যন্ত ফিরিয়েছেন।

আমরা সেইম এইজ, সেইম ইয়ার ছিলাম শুরুর দিকে। কিন্তু কিছুদিন যেতেই ওদের প্রতিষ্ঠানে সেশনজট শুরু হয়। ফলে আমরা আর সেইম ইয়ার থাকিনা। ও আমার চেয়ে এক বছরের মত পিছিয়ে পরে। আমার হতাশা বাড়তে থাকে। আমাদের পরিবারে প্রেম করা বিষয়টা ছিল চরম অপছন্দের। জানতে পারলে পড়াশুনা বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দেবে অন্য কারো সাথে এমন ভয়াবহ অবস্থা। এমন প্রতিকূল পরিবেশে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে যে প্রেম করেছি এখন ভাবতেও অবাক লাগে। 

তো যাই হোক ওর সাথে এই হতাশাগুলি যখন শেয়ার করতাম ও মাঝে মাঝে কিছুটা রেগে যেত। বলত, “আছ কেন আমার সাথে? যাও ভাল ছেলে দেখে বিয়ে করে ফেল আমি তো অনেক পিছিয়ে।” 

আমার তখন খুব কষ্ট লাগত। কারণ আমি আশা করতাম ও পজিটিভ কিছু বলবে,এরকম উত্তর ঐ মুহূর্তে ওর কাছে থেকে আমার প্রত্যাশিত ছিল না। ইনফ্যাক্ট ওর মধ্যে বাস্তবতার যথেষ্ট অভাব ছিল। আমাদের এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়েও ওকে সিরিয়াসলি কখনও ভাবতে দেখতাম না। যা কিছু চিন্তা, সিরিয়ানেস, হতাশা সব আমার মধ্যে। 

আর যদিও বা কখনো আমি এ বিষয়ে অতিরিক্ত কথা বলে ফেলতাম তখন দেখা যেত সে নিজেই উলটো হতাশ হয়ে মন খারাপ করে ফেসবুকে দুঃখের স্ট্যাটাস দিয়ে এমন অবস্থা করত যে আমার নিজেরি আবার তাকে বুঝানো লাগত। এভাবে দিন চলতে থাকল। 

৫.
এর মাঝে আমি খেয়াল করতে লাগলাম আমি আগের মত ভাল ছাত্রী আর নেই। বরং আমার রেজাল্ট দিন দিন খারাপ হতে থাকে। দুয়াগুলি আর আগের মত কবুল হয় না। আমার এই বিষয়গুলি আমার কাছের কিছু ক্লাসমেটদের সাথে শেয়ার করতাম। আল্লাহর অশেষ রহমত যে আমি এরকম অসাধারন একটা সার্কেল পেয়েছিলাম। কারণ ওদের মাধ্যমেই আল্লাহ্‌ আমাকে শেষ পর্যন্ত সাহায্য করেছেন। 

ওরা সবাই মোটামুটি ইসলামিক মাইন্ডেড ছিল। ওরা আমাকে বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করত। এই রিলেশন থেকে বের হয়ে আসতে বলত। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টা খুবই অসম্ভব বলে মনে হতো। আমার মনে সব সময় এটা কাজ করত যে আমি ওকে ঠকাতে পারব না। প্রেম যখন করেছি বিয়ে করলেও ওকেই করব। একজনের সাথে প্রেম করে অন্যজনকে বিয়ে করার মত ভণ্ডামি আর হয়না! ওর মনে কষ্ট দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে আমি কী হিসাব দেব! 

অথচ একটিবারও আমার মাথায় আসেনি যে ওর মন রাখতে গিয়ে আমি আমার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তালার মন ভাঙছি! তাঁকে কষ্ট দিচ্ছি! তাঁর করা নিয়ম লঙ্ঘন করছি! তো যাই হোক, আমার ক্লাসমেটদের মধ্যে একজন ছিল মোটামুটি প্র‍্যাক্টিসিং ওর কাছে একদিন এই দুয়া কবুল না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ও বলল হারাম কাজের মধ্যে থাকলে অনেক সময় দুয়া কবুল হয়না। 

কথাটা আমার ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়েছিল কিছুক্ষনের জন্য। ওর একটা জিনিস আমার ভাল লাগত যে ও কখনো ডাইরেক্টলি আমাকে বলতনা যে তুই ওকে ছেড়ে দে, ও শুধু বলত তোরা তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেল অথবা আপাতত কথাটা অফ রাখ ও বাসায় বলার আগ পর্যন্ত। কিন্তু ও তো আসলে এরকম সিরিয়াস ছিলনা। সো, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটত। এর মাঝে কয়েক বছর হয়ে যায় আমাদের সম্পর্কের। 
এদিকে পড়াশুনা প্রায় শেষের দিকে চলে আসাতে বাসা থেকেও বিয়ের জন্য তোড়জোড় শুরু করে। অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে আব্বু আম্মুর পছন্দের। ওকে এসব বলতাম এ আশায় যে ও যেন একটু সিরিয়াস হয়। কিন্তু ও উল্টো রাগ দেখিয়ে বলত, “যাও যাও অনেক ভাল ভাল ছেলে আসছে তো! আমার তো অত যোগ্যতা নাই, পিছায় তো আসি অলরেডি তোমার চে! কেন আমার জন্য বসে আছ! যাও বিয়ে করে ফেল!” 

এবং আবার সেই মন খারাপ প্লাস ফেসবুকে দুঃখের পোস্ট! আমার খুব কষ্ট লাগত কিন্তু কোন রাস্তা পেতাম না সমাধানের। 

একদিন আমার ঐ ক্লাসমেটের একটি বিয়ের প্রস্তাব আসে। ছেলে নামকরা এক প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়েছে, বাইরে থেকে পিএইচ ডি করে এসেছে, দেশে চাকরি খুঁজছে এবং প্র্যাকটিসিং। তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতিতে ওরা কথা বলেছে এবং কিছু কিছু কথা শুনে আমারো ছেলেটাকে ভালই মনে হয়েছে। 
ওরও (আমার ঐ ক্লাসমেট) বিয়েতে কোন আপত্তি নাই। কারণ ও বলত বিয়েটা তাড়াতাড়ি করতে পারলে ফিতনা থেকে বেঁচে থাকা যায়। আমার কেন জানি ঐ মুহূর্তে এক অন্যরকম ভাবনার উৎপত্তি হল যা খুবই অস্বাভাবিক ছিল। ভাবনাটি ছিল এরকম, যে এরকম তো আমার সাথেও হতে পারত! আমিও তো এরকম একজন কে বিয়ে করতে পারতাম যাকে আব্বু আম্মু পছন্দ করে দেবে। যে যথেষ্ট ইসলামিক হবে, আমাকে ইম্প্রুভ করতে সাহায্য করবে। সর্বোপরি সম্পর্কটা হালাল হবে, আল্লাহর বারাকাহ থাকবে, থাকবে না কোন ফিতনা, সবাই খুশি থাকবে এবং সবার সম্মতিতে বিয়ে হবে। এই চিন্তাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে টার্নিং পয়েন্ট! এরপর থেকেই পরিবর্তনের শুরু। 

৬.
হলে এসে ওকে সব খুলে বললাম। বললাম যে দেখো ও কি সুন্দর এখন বিয়ে করে ফেলবে। আর আল্লাহর রহমতও থাকবে ওদের উপর। গুনাহ থেকে দূরে থাকতে পারবে। কিন্তু আমরা তো গুনাহ করছি, অথচ চাইলেই আমরা এটা থেকে দূরে থাকতে পারি, আমাদের সম্পর্কটা হালাল করতে পারি…এভাবে অনেক কিছু বোঝালাম ওকে। এবং শেষে গিয়ে বললাম আমি একটি সিধান্ত নিয়েছি যে আমি আর এই গুনাহের মধ্যে থাকবনা, হয় তুমি কোনভাবে তোমার বাসায় বলে আমার বাসায় বিয়ের প্রপোসাল পাঠাও অথবা আমরা যোগাযোগ বন্ধ রাখব তুমি প্রপোসাল পাঠানোর উপযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত। 

ফলে ও প্রচণ্ড পরিমান রেগে গেল এবং বলতে লাগল, “হ্যাঁ জানিতো আমার সাথেই এমন হয়! তোমার অনেক ভাল ভাল প্রপোজাল আসছে এজন্য তুমি আমাকে কাটানোর চেষ্টা করছ! আমার সাথে এমনই যদি করবে কেন তবে আমার সাথে সম্পর্কে জড়ালে?” 

আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম ওর কথা শুনে। ওকে বোঝালাম, “তুমি আমাকে শুধু শুধু ভুল বুঝছ। আমি তোমাকে সত্যি অনেক ভালবাসি এজন্য আমি তোমার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই এবং মৃত্যুর পর তোমার সাথে জান্নাতে প্রবেশ করতে চাই। এটাই তো বাস্তব তাইনা যে আমাদের সবাইকে একদিন মারা যেতে হবে? সেটা যদি এই মুহূর্তে হয় তাহলে কি পরিমাণ গুনাহরত অবস্থায় আমরা মারা যাব তোমার ধারণা আছে? প্লিজ আমাকে ভুল বুঝোনা, আমি আমাদের ভালোর জন্যই বলছি।”

কিন্তু কেন জানি ও বুঝতে চাইছিল না। আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম না যে ও কেন এমন করছে। আমিতো ওকে ছেড়ে যাচ্ছি না, ও কেন আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলছে! 

ঠিক করলাম ইস্তিখারা করব। আল্লাহর কাছে মন খুলে চাইলাম, “আল্লাহ্‌ ওর সাথে থাকলে যদি আমার মঙ্গল হয় তবে তুমি ওকে বিয়ে করাটা আমার জন্য সহজ করে দাও, আর যদি কোন মঙ্গল না থাকে তাহলে ওকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দাও।”

দুয়াটা করার সময় অনেক কষ্ট হচ্ছিল। বিশেষ করে লাস্ট পার্টটা বলার সময়। দুই চোখ ফেটে কান্না আসছিল। মনে হচ্ছিল আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। আমি অনেক একা হয়ে গেছি। এভাবে কতক্ষন যে জায়নামাজে বসে কেঁদেছি হিসেব নাই। 
ওর সাথে শেষবারের মত রাতে কথা হলো। আশা করেছিলাম এতক্ষণে হয়ত বুঝতে পেরেছে। কিন্তু আসলে কিছুই বোঝেনি। আবারও একই কথা বলতে লাগল, খুব অনুরোধ করছিল যেন কথা বলা বন্ধ না করি। কিন্তু আল্লাহ্‌ আমার হৃদয় ততক্ষণে শক্ত করে দিয়েছেন। আমি শেষ বারের মত ওকে বুঝিয়ে কথা বলা বন্ধ করার সিধান্ত নিলাম। সবকিছু থেকে ব্লক করলাম। 

চোখ ফেটে কান্না আসছিল। তারপরও শক্ত ছিলাম। খারাপ লাগলে আমার ঐ ক্লাসমেট এর সাথে কথা বলতাম। আগে যখন ওর সাথে কথা বলতাম, পরবর্তীতে অনেক খারাপ লাগত। তখন ক্লাসমেটকে ফোন দিয়ে কথা বলতাম। ও আমাকে অনেক সাপোর্ট দিত আলহামদুলিল্লাহ্‌। 

৭.
অনেক দিন পার হয়ে গেছে এর মধ্যে। আগের মত আর মনে পড়েনা ওকে। আল্লাহ স্বয়ং আমাকে সাহায্য করেছেন, তা না হলে আমার পক্ষে এত বড় পদক্ষেপ নেয়া কখনই সম্ভব ছিলনা। বাসায় বলেছি পাত্র দেখতে। শর্ত একটাই পাত্রকে প্র্যাকটিসিং হতে হবে। আব্বু আম্মুতো বেজায় খুশি। যেই মেয়ে বিয়ের কথা শুনতেই পারতনা সে নিজে থেকেই বিয়ের কথা বলেছে তাও আবার প্র্যাকটিসিং পাত্র! এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! মহা সমারোহে তারা তাদের চিরুনি অভিযান ‘মিশন পাত্র খোঁজা’ চালিয়ে যাচ্ছেন! 

মাঝে মাঝে এটা ভেবে খুব অবাক হই আল্লাহ্‌ আসলেই আমার দুয়া কবুল করেছেন, আমার মত এত গুনাহগার বান্দার! 

আর এভাবেই এক নতুন আমির জন্ম হয় আমার মধ্যে থেকে। ঠিক যেন রূপকথার ফিনিক্স পাখির মত। যার জন্ম হয় তার মার পুড়ে যাওয়া শরীরের ধ্বংসস্তূপ থেকে। আমার জাহিল জীবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে আল্লাহ্‌র পথে পরিবর্তনের এক ঝাঁক স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয় এক নতুন আমির পথ চলা।

…………………………

ফিনিক্স
উম্ম আইশা
(১১ জানুয়ারী ২০১৮)