ফেইসবুক ফেইকবুক

(১)
সাহেদের আজ মুখটা বেশ ভার দেখাচ্ছে, অফিস থেকে ফিরে নীপার সাথে একটা কথাও বলেনি। নীপা বেশ চিন্তিত। ভয়ে আছে- মুখ ভারের কারণ সে নাকি অফিস!

নীপা সাহেদের জন্য চা এনেছে। ট্রে বিছানার উপর রেখে জিজ্ঞেস করলো, “কী হয়েছে?” ব্যাস অমনি সাহেদ ফেটে পড়ল, যেন অপেক্ষায় ছিল নীপার তরফ থেকে একটি বাক্যের!

-“আপনি যে এত বড় লেখিকা হয়ে গেছেন, আপনার জন্য তো অফিসে আমার ইজ্জতের টানাটানি, সেটা বুঝে আসে না!”

-“মানে কী!! কিছুই তো বুঝলাম না!”

-“আপনি বুঝবেন না, কারণ আপনি তো একজন বিদ্রোহী, নারীবাদী। আপনি শুধু মেয়েদের দুঃখে মাতম তোলেন!”

নীপার খুব অবাক লাগছে কারণ সাহেদের কাছ থেকে এ রকম ব্যবহার সে খুব একটা পায়নি বিয়ের এতগুলো বছরে। ঘটনার যে ভালোই জল গড়িয়েছে সেটা বুঝতে নীপার বাকি রইলোনা।

-“কোন লেখাটা নিয়ে এত কথা, সেটা ক্লিয়ারলি বললেই হয়।“

-“আর জানা লাগবেনা আপনার।“

নীপা আর ঘাঁটালোনা, কারণ সে জানে কিছু না বললে সাহেদ একটু পর এটা নিয়ে কথা বলবেই।

রাতে খাবার টেবিলে সাহেদ-
-“আমি নাকি ঘরে বৌ এর যত্ন নেই না, বৌ নাকি একা কাজ করে করে মরছে। আমি নাকি খেয়াল রাখিনা। আমি নাকি বৌকে বুয়া বানিয়েছি। ছিঃ! এগুলো শুনতে হল তোমার লেখার কারণে আমাকে!”

-“সে কী! আমি কি তোমার কথা বলেছি নাকি?! সেটি তো একটা জেনারেল লেখা। অনেক স্বামীরাই তো স্ত্রী দের কদর করেনা। সেটা তুমিও জানো। আর তুমি আমার কতটুক কদর কর, সেটা আমার থেকে ভালো কে জানবে!?”

-“থাক হয়েছে, আর কদর করা লাগবেনা তোমার।“
-“কে কী বলেছে?”
-“আর কে? তোমার বান্ধবীর জামাই- আরিফ সাহেব। সামনে আরো দু’জন কলিগ ছিল, ছিঃ কীভাবে টিটকারি করছিল!”

নীপা আসলেই বেশ ব্যথিত হল। সাহেদের জায়গায় ও থাকলে, ওরও খুব খারাপ লাগতো। তাছাড়া সাহেদ নীপার সম্পর্কের গভীরতা নিয়ে অন্য কেউ হাসি ঠাট্টা করবে এটা নীপা ভাবতেই পারেনা, সাহেদ তার জীবনে আল্লাহ্‌র কত বড় রহমত সেটা নীপা ভালো করেই জানে। কিন্তু সাহেদ এর রাগকেও সে দোষ দেবে কীভাবে।

তাহলে সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখা যাবে না? নাকি দুজনের ভালবাসার সত্য মিথ্যা গল্প লিখলেই লোকে ধরে নিবে ওরা সুখী!

নাকি “বিঃদ্রঃ” দিয়ে বার বার পাঠককে জানান দেয়া লাগবে যে “এই ঘটনা তার পরিবারের নয়”। লেখকের স্বাধীনতা বলে বুঝি কিছুই থাকবেনা বাকি?

(২)

খাবার টেবিলে সুমি তপনকে আচ্ছা মত ধরল। কী ভেবেছে ওর আত্মীয়-স্বজন? যখন যা মন চায় বলে যাবে, এলাকায় বলে বেড়াবে তার নামে?
সুমির গজগজানিতে তপন জিজ্ঞেস করল, “আরে বাবা পরিস্কার করে বল না কী হয়েছে আবার?”

-“রাহেলা আপা (তপনের কাজিন) আজ ফোন দিয়ে আমাকে ধোলাই লাগালো। আমি নাকি তোমাদের সংসারে ভাঙ্গন ধরিয়েছি। তোমার বাবা মাকে নাকি আমি জীবনেও মান্য করিনি। তোমাকে নাকি বশ করেছি। আর কত বলবে এক কথা? তোমার বাবা মা কে সেবা করিনি, তাদের আমি রেঁধে খাওয়াইনি? উলটা তারাই তো আমার রান্না খাবেননা বলে তোমার আত্মীয় স্বজনের কাছে আমার নামে কান ভারি করতেন। আমার আর কী করার বাকি আছে বলো তো?”

-“পুরনো কথা টানছো কেন? এখন তো তোমাকে কেউ খাওয়াতে বলেনি!”

-“না বললে কী, ত্যানা আমি প্যাচাইনা, তোমার আদুরে বোন প্যাচায়। সে ফেইসবুকে কী পোস্ট দিয়েছে দেখেছো?”

-“কবে?”

-“গত পরশু। বাবা মা এর দুঃখ নাকি শুধু মেয়েরাই বুঝে, আর ছেলেরা বুঝে বৌ এর দুঃখ। এসব দিয়ে মানুষকে কী প্রমাণ করতে চায় সে?”

-“আরে বাবা! ওখানে সে কি তোমার নাম নিয়ে কিছু বলেছে নাকি? শুধু শুধু নিজের ঘাড়ে নিচ্ছো কেন যেচে?”

-“নাম না নিলে কী হয়েছে। সেখানে রাহেলা আপা আর তোমার বোনের কী দুঃখ গাঁথা, ছিঃ। বাইরের মানুষ পড়লে কী ভাবা বাকি রাখবে যে এগুলা নিজের ভাই এর বৌকেই বলা হচ্ছে? আর সেই তালে পড়ে রাহেলা আপার আমাকে ফোন করে শোনানো লাগলো? কারণ আমি তো কমেন্ট করিনি, ভেবেছে আমি যদি ওদের বিষ না দেখে থাকি”।

-“উফ আর ভাল্লাগেনা। ফেইস বুক না থাকলেই ভালো ছিল। না এসব দেখতে, না শুনতে, না শোনাতে”।

-“হ্যাঁ এখন তো আমার দোষ। যারা খোঁচায় তারা তো সাধু!”
-“ধুর খাবোই না!”
-“আরেহ খাবারের সাথে রাগ করার কী হল। আরে আসো বস, বাদ দাও”।
-“না খাবো না”।

তপন উঠে পড়ল।

সুমির আফসোস লাগছে। ধুর, খাবারের সময় এমনটা বলা উচিৎ হয়নি ওর। বেচারা শুধু শুধু খালি পেটে ঘুমিয়ে পড়বে। ধুর!

(৩)

বাইরের মানুষের কথায় আমরা প্রায়ই নিজেদের শান্তির নীড়ে অশান্তি বয়ে নিয়ে আসি। অথচ তাদের কথায় কান না দিলে তারাও কিন্তু আর আমাদের জীবনে ইচ্ছায়/অনিচ্ছায় জায়গা দখল করতে পারে না।

আরেকটা বিষয়, ফেইসবুকে কেউ কিছু বললে হতে পারে এটা ব্যক্তির নিজস্ব ঘটনা/অভিজ্ঞতা/ উপলব্ধি। তাই অন্যের জীবন নিয়ে ধারণা না করে, সেই পোস্ট থেকে শিক্ষার কিছু থাকলে আমরা যেন নেই, আর না পারলে যেন এড়িয়ে চলি- এটাই সোশ্যাল মিডিয়া কার্টিসি হওয়া উচিৎ; অন্তত বিবেকবান শিক্ষিত মহলে।

“ফেইসবুক ফেইকবুক”
উম্ম হুরায়রা
(১৪ নভেম্বর ২০১৭)