ফেরা

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙে তিশার। নীচতলার হইহুল্লোড়, কান্নার আওয়াজ আসে। ঘুম থেকে জেগে কিছু না বুঝতে পেরে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে বসে থাকে ও। নীচের কান্নার আওয়াজ বাড়তেই থাকে। দৌড়ে নীচে যায়। কি ব্যপার সুমার মায়ের ই তো কান্নার শব্দ। কি হলো! খবরটা শুনে স্তব্ধ হয়ে থাকে ও কিছুক্ষন। সুমা আর নেই! মাথা ঘুরে পরে যাবে মনে হয়। গলা শুকিয়ে আসতে থাকে। এক চিৎকার দিয়ে মাটিতে আছড়ে পরে তিশা।

গতকাল রাত করেই দুইজন এক সাথে বাসায় ফিরেছে কেনাকাটা করে। কত প্ল্যান ছিল আগামীকাল এর বেড়ানো নিয়ে। সেই জন্যই শপিং করতে করতে রাত হয়ে গিয়েছিলো। বাসায় ফিরে সুমা কে বিদায় বলেই তিশা ওর রুমে চলে আসে। এসেই কখন ঘুমিয়ে পরে আর মনে নেই।

সুমার মায়ের কাছ থেকে শুনলো, ঘুমের মধ্যেই হার্ট এট্যাক হয়ে মারা যায় সুমা। এক ঘন্টা ওভাবেই শোয়া পরে ছিল। এখনো বিশ্বাস হয়না তিশার। একই বয়সী একজন এত তাড়াতাড়ি মারা গেল! তাও এমন ভাবে!

ভোররাত থেকে এলাকার লোকজন আসতে থাকে। লাশ কে তো বেশিক্ষন এভাবে রাখা যাবে না। সুমার মায়ের আহাজারি তে আকাশ বাতাস এক হয়ে যাচ্ছে। তিশা ঘরের এককোনে দাড়িয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলতে থাকে। তিশার মা অনেকবার বাসায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তিশা যায়নি।

দুই বছর আগে ওদের বিল্ডিং এ সুমা রা ভাড়া আসে।এরপর আস্তে আস্তে সুমার সাথে ওর সখ্যতা বাড়তে থাকে। দুইজন এক মন মানসিকতার হওয়ায় সখ্যতা হতে খুব একটা সময় লাগেনি। কতদিন গল্প করে, টিভি দেখে দুইজন রাত পার করেছে। লাস্ট ফাগুনেও পাড়ার অনুষ্ঠান এ দুইজন একসাথে নেচেছে।

সুমাটা খুব হৈচৈ পছন্দ করতো। যে কোন সময় যে কোন কিছু নিয়ে মজা করা,হাসাহাসি করা ছিল ওর কাজ। নাহ আর ভাবতে পারছেনা তিশা। এক দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসলো। ড্রেসিং টেবিল এর উপরে চোখ পরতেই দেখলো আগামীকালের জন্য কেনা শাড়ি,গহনা,ফুল সব কিছু। ভিতরটা মোচড় দিয়ে ঢুকরে কান্না চলে আসলো আবার।

হঠাৎই তিশার মনে হতে লাগলো কি ক্ষনস্থায়ী মানুষের জীবন। গতকাল রাতেই যে মানুষটাকে নিয়ে এত্ত কিছুর প্ল্যান করা আজ সে মানুষটা কিছুক্ষন পর কবরে শায়ীত হবে। কবরের কথা মনে হতেই গা শিরশিরে এক অনুভুতি হলো।

কতদিন ঠিকভাবে নামাজ পড়া হয়না, হৈ হুল্লোড়, হাসি তামাশায়ই কেটে যাচ্ছে জীবন। সুমাও তো ঠিক আমারই মত ছিল। ওর কবরের জীবন টা কেমন হবে!!! এই ভাবনায় পেয়ে বসল তিশা কে।

এই প্রথম জীবনে এইভাবে মৃত্যু, কবর, কবরের জীবন নিয়ে এতটা ভাবনা হচ্ছে। অথচ কাল এই সময়টাতেও ভাবনা ছিল এবারের পহেলা বৈশাখ এ নিজেকে আরো কতটা সুন্দর ভাবে প্রেজেন্ট করা যায় সে সব নিয়ে।

তিশার মাঝে হঠাৎ মৃত্যু ভয় পেয়ে বসে। আসলেই তো, সুমার জায়গায় আজ সে নিজেও থাকতে পারতো। কি হতো ওর কবরে,অথবা সেজে গুজে বৈশাখ পালনে বের হওয়ার পথেও মারা যেতে পারতো। এইসব যে ঠিক না তা তিশা আগে থেকেই জানতো। কিন্তু এইভাবে কখনো মনে হয়নি। এইভাবে অনুভব করেনি প্রতিটা কাজের জন্য জবাবদিহিতার চিন্তাটা।

নানীর রুমে চলে এলো এইসব ভাবতে ভাবতে। নানী পরহেজগার মানুষ। সব সময় নামাজ রোজা নিয়ে থাকেন। কতদিন কত বিষয়ে উপদেশ দিতে চেয়েছেন তিশা কে। অথচ সবসময়ই কথার মাঝখানেই নানি কে থামিয়ে সামনে থেকে চলে যেত। আজ খুব ইচ্ছে করছে নানি কিছু বলুক। নানির কোলে গিয়ে মুখ গুঁজে শুয়ে রইলো তিশা।

নানি বুঝতে পারলেন নাতনীর মনের অবস্থা। আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন, “নানু রে জীবন টা এমনি, এই আছে এই নাই। তাই সময় থাকতেই নিজের যাওয়ার পথ টা সুগম করতে হইব।

আর আল্লাহ বলছেন, যত পাপ কাজ করেই আল্লাহর কাছে আসো না কেন, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ ক্ষমা করে দিবেন। যাও নামাজ পড়ে সব কিছুর জন্য ক্ষমা চাও। আর নিজেকে আল্লাহর ইচ্ছামত পরিচালনা করো, নিজের ইচ্ছায় না।”

নানীর স্বান্তনা শুনে ঢুকরে কেঁদে উঠলো তিশা। ওর মনে হতে লাগলো, সুমা তো আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার সময়টুকু ও পেলোনা। উঠে চলে গেলো নামাজের জন্য। নামাজে এত শান্তি আগে কখনো লাগেনি। নামাজ এ দোয়ায় ছিল সুমা, যার জন্য আগে কখনো এইভাবে দোয়া করা হয়নি। মন থেকে দোয়া করা, মন থেকে ভালো কামনা এইভাবে আর কখনো করা হয়নি। অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করতে লাগলো তিশা। আল্লাহর দিকে ফেরা টা সত্যিই অনেক প্রশান্তিময়।

——————-
ফেরা
জান্নাত সুলতানা মারিয়া

এপ্রিল ১৪, ২০১৮ইং