বুয়া সমাচার

দেশে ম্যাক্সিমাম মানুষ হেল্পিং হ্যান্ড এর সাহায্য নেয়। না থাকলে অনেকের মোটামুটি অচল অবস্থায় যেয়ে দাঁড়ায়। এইবার দেশে যেয়ে ভালো রিয়েলাইজেশন হয়েছে।

যেহেতু ঈদের সময় ছিলাম, ঈদের পরপর হেল্পিং হ্যান্ড খরায় ভোগে বেশীর ভাগ মানুষ। উনারা গ্রামের বাড়ীতে ঈদ করতে গেলে লম্বা সময় কাটান। ৩ দিনের জায়গায় ১০ দিন কাটিয়ে আসে টাইপ অবস্থা। আর এইদিকে বাসা বাড়ীতে হাহাকার।

মেয়েদের গ্রুপগুলোতে বুয়াদের পিন্ডি চটকায়। এত দিলাম, এত দিলাম, যাকাত দিলাম, ফিতরা দিলাম, তারপরও আসলো না! ছেঁকা দিলো!- এই টাইপের ম্যাসেজে ভরপুর।

লম্বা সময় দেশে কাটিয়ে আসেপাশের লোকজনের কাছ থেকে খালি শুনলাম, আরে, বিদেশে থাকলে আর কাজ কি! তোমার সব কাজ তো মেশিনেই করে দেয়। এজ ইফ, আমার অন্য কাজ তো বটেই, বাচ্চা পালার মেশিনও একটা আছে, মেশিনে ঢুকিয়ে দেই, বাচ্চা নিজে নিজেই পেলে যায়। আমার আর কাজ কি। খালি আরাম আর আরাম।

শুনতে শুনতে নিজেরই মনে হতে থাকলো, আসলেই তো। আরাম ছাড়া আর কি!

হেল্পিং হ্যান্ড ছাড়া কি দাঁড়ায় আসলে! আমার বাসায় আমিই বুয়া। রান্না, কুঁটা বাছা, হাঁড়ি-পাতিল ধোয়া, ঘর ঝাড়ু দেয়া-মোছা, কাপড় ধোঁয়া, বাচ্চার রান্না, গেষ্ট এটেন্ড করা- বুয়া না থাকায় কোনটা কি বাদ যায়?

প্রাইমারি কেয়ার গিভার হিসেবে, বাচ্চা পালার হ্যাপা বাদই দিলাম। রান্নায় সবজি বেশীরভাগ আস্ত কিনে কাটি। রেগুলার কাপড়ের বড় একটা অংশ হাতে ধুই (ধুতে হয়, না হলে হয় সুতি কাপড় নষ্ট হয় নতুবা রাগী দাগ হাঁ করে থাকে)।

ইন্ডিয়ান দোকান থেকে ফুলঝাড়ু কিনে বাসা ঝাড়ু দেই। বালতিতে পানি নিয়ে ঘর মুছি। হ্যাঁ, এখানে ধূলাবালি যেহেতু খুব বেশী হয় না, তারউপর নিজে অলস প্রকৃতির। রেগুলার এগুলা আমি করি না। অনেকেই কিন্তু করেন। বাইরে যারা কাজ করেন, তাদেরও এগুলা করা লাগে।

তাই বলে এখানে কি হেল্পিং হ্যান্ড নাই ই? না, পয়সা দিলে তাও আছে। এশিয়ান, ম্যাক্সিকান অনেকেই হাউজ কিপিং টাইপ কাজ করেন। যারা এভেইল করতে পারেন, বিশাল বাড়িতে থাকেন, তারা সহজেই এই ধরনের মানুষ হায়ার করেন।

কিছুটা আভিজাত্যের প্রতীক আর কি। কারন এই সব হেল্পিং হ্যান্ডরা কিন্তু বেশ ভালোই আর্ন করেন। আর বাদবাকী ম্যাক্সিমাম সাধারন মানুষকে নিজেরটা নিজে করে খেতে হয়।


এক মেয়েদের পেইজে দেশে থাকে আপা ভার্সাস বিদেশে থাকা আপার আর্গুমেন্ট শুনছিলাম। দেশে থাকা আপা গলা ফুলিয়ে বলছেন, আরে কি কাজ করতে হয়, জানিনা আবার! আমরাও তো দেশে-বিদেশে যাই। আমাদেরও আত্মীয়-স্বজন বিদেশ থাকে। আর পান না, তাই খান না। রাখতে পারলে আপনিও রাখতেন।

আমি শুনি খালি। শুনে শুনে তাজ্জব হই। অনেক সময় কাজ করতে করতে ব্যাকপেইন হয়ে যায়। বাজার সদাই করা থেকে বাথরুম ক্লিনিং সবকিছুতে যখন রোল প্লে করা লাগে। তা, আমার আবার কাজ কি। আরামই তো সব।

দেশে এখন মানুষ বাসাবাড়ীর কাজের জন্য প্রচুর গ্যাজেট ইউজ করে। ১০ বছর আগেও এতটা করতো না। ওয়াশিং মেশিনও অনেক বাসাতেই আছে। তারপর রেগুলার কাজের জন্য বাইরের মানুষের উপর ডিপেন্ডেন্সি কমে নাই এতটুকু। যে যেভাবে কাজ করে অভ্যস্থ।

অনেক বাসাতেই খাওয়ার পর প্লেট গ্লাস সব জমিয়ে রাখেন। দুপুরের খাওয়া, বিকালের নাস্তা, রাতের খাবার সবকিছুর পর সিংক উপচে পড়ে। পরদিন বুয়া এসে সব তো ধুবেই। লন্ড্রি বাস্কেট উপচে পড়ে কাপড়ে।

সবকিছুর জন্য যখন একজনের উপর ডিপেন্ডেন্ট, তখন সে না আসলে মাথায় তো বাজ পড়বেই! অথচ টুকটাক কাজে সবাই হাত লাগালে অনেক কিছুই সহজ হয়। অন্তত নিজের কাজটা সবাই যদি নিজে করে!

আমি ভাত খাওয়ার পর আমার প্লেট কেন আমি আরেকজনের জন্য রেখে দিবো! অনেক ফ্যামিলিতেই আমরা জন্ম থেকে এইসব জিনিস দেখে আসি দেখে, গা করি না। অথচ এইগুলা উইয়ার্ডেষ্ট থিং এভার।

স্পেশালি ছেলেরা একধাপ এগিয়ে। অনেক বাসাতেই ছেলেরা হাত ধুয়ে খেতে বসে, পারলে কেউ পানি এনে দিলে, টেবিলেই হাত ধুয়ে উঠে। আর রান্না-বান্না, প্লেট-গ্লাস নাড়ানো? আলাদীনের প্রদীপ আছে না একটা!

দেশে যেয়ে কিছু ব্যাপারে নিজের কাজ নিজে করি- অভ্যাস চালু রেখেছি। প্লেট ইন্সট্যান্ট ধুয়ে ফেলা, রেগুলার নিজের, বাচ্চাদের কাপড় ধোয়া। নইলে নবাবী হালে চললে, এইখানে এসে আমার কাজ কে করে দিবে!

যেগুলোকে মানুষ একসময় বাইরের দেশের সুবিধা বলতো, দেশে এখন সেগুলার সবই পাওয়া যায়। কাটা প্যাকেট করা সবজি, বাটা মসলা, কাটা মাছ-মাংশ, রেডিমেইড রুটি-পরটা, ডিশ ওয়াশিং মেশিন কি নাই!

তারপরও নিতান্ত শ্রম সহজলভ্য বলে এবং এক গৃহিনীর উপর বাসার আমজনতা সমস্তই ডিপেন্ডেন্ট বলে, হেল্পিং হ্যান্ড না হলে চলে না। দরকারে সাহায্য নিতে হতেই পারে। কিন্তু নাই-নাই, হায়-হায় এগুলো কখনোই যাবে না, যদি বাসার সবাই দায়িত্বশীল না হয়।


এইবার দেশে যেয়ে হেল্পিং হ্যান্ড না আসায় অনেকবার বাসার কাজে হাত লাগিয়েছি। হাঁড়ি-পাতিল ধোয়া, ঝাড়ু দেয়া- এগুলাকে আমার আলাদা কিছু মনে হয় নাই। কিন্তু বুয়া নাই, আসে নাই, কেন আসলো না, কি হবে- এসব শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা অবস্থা। এই কালচার থেকে ধীরে ধীরে বের না হয়ে আসলে জাতি হিসেবে সামনে বিরাট বিপদ!

বি দ্রঃ অতি সেন্সেটিভ ইস্যু বুঝতে পারছি। কাউকে ছোট করার জন্য লেখা না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে ব্যক্তিগত মতামত। কেউ গলা ফুলিয়ে ঝগড়া করতে না আসলেই হলো।

বুয়া সমাচার
আফিফা রায়হানা

অগাস্ট ১৬, ২০১৯ইং