রিযিকের গল্প

আজ লতিফা বেগমের মনটা খুব খারাপ। বাচ্চা দুটো সেই কখন থেকে ক্ষুধায় করুন মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনিতে এরা খাওয়া নিয়ে বেশি দিকদারি করে না। দিনের পর দিন ডিম ভাজা আর পাতলা ডাল দিয়ে হাসি মুখে খেয়ে নেয়।

কিন্তু আজ তো বাসায় এইটুকুও নেই!!! মনে মনে প্রমাদ গোনেন বেচারি। মাঝে মাঝে দু টুকরো মুরগী থাকলে এক টুকরো তিনি আর তার মেয়ে ভাগ করে খান। আর গোটা টুকরোটা ছেলেটা কে দেন।

মানুষ শুনলে বলবে, পুত্র সন্তানের প্রতি দরদ বেশি দেখাচ্ছেন। কিন্তু ছোটকুটা খাবার দেখলে এত খুশি হয়ে যায়!! ভাই এর আনন্দ দেখে তারচেয়ে অল্প একটু খানি বড় বোনটাও, আজকাল নিজ থেকেই ভালো খাবারটা ভাই এর পাতে দিয়ে দেয়।

কখনো যদি মুড়োঘন্ট রান্না হয়, ঐটুকু একটা চার পাঁচ বছরের ছেলে বিশাল সাইযের মাছের মাথা পেলে, কি পরিমান যে আনন্দ উত্তেজনার সাথে কচর মচর করে খায়, তা দেখতেও অবাক লাগে লতিফার। আবার মায়াও লাগে, মনে হয় আহারে খাক না বেচারাটা, প্রতি দিন তো আর এত কিছু থাকে না।

অনেক খুঁজে, আজ ঘরে শুধু একটা ক্ষুদ্রাকায় প্যাকেটে মুরগীর কয়েকটা কলিজা পেলেন তিনি। ভেবে নিলেন, অনেকগুলো আলু দিয়ে রাঁধলে, এই কয়েক টুকরোকেও অনেক বেশি মনে হবে। কলিজার প্যাকেট পানিতে ভিজতে দিয়ে, লতিফা সালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন।

আগে রাঁধতে গেলে, সালাতের ওয়াক্ত চলে যাবে। মায়ের জায়নামাজে দাঁড়ানো দেখে হয়তো বা শিশুদুটোর মুখটা কিছুটা মলিন হয়ে গিয়েছিলো সেদিন। কারন মায়ের সালাত সহজে শেষ হয় না। অর্থাৎ আজ ভাগ্যে খাবার বেশ দেরিতে পাওয়া যাবে।

তাও মাটির মালশায় ভেজানো প্লাস্টিকের প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে, তারা কিছুটা আশা সঞ্চয় করার চেষ্টা করলো। না জানি কি আছে, ঐ পোঁটলার মাঝে! ইশ কখন যে মা রান্না ঘরে ঢুকবে!

ওদিকে ওরা তো আর জানে না, তাদের মা আজ কি দুশ্চিন্তা নিয়ে সালাতে দাঁড়িয়েছেন। বাচ্চা গুলোকে এতক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে, এক গাদা আলু দিয়ে অল্প কিছুটা কলিজার তরকারি দিতেও কেমন যেন লাগছে তার। এতে ওরা আশাহত হবে নাকি, ক্ষুধা পেটে খাবার পেয়ে গপ গপিয়ে খাবে, সেই চিন্তায় বিধবা লতিফার মন অস্থির হয়ে আছে।

যা হোক, সব চিন্তা বাদ দিয়ে উনি ইবাদতে মনোনিবেশে ব্যস্ত হলেন। কারন সলাতের চেয়ে গুরত্বপুর্ন আর কিছুই হতে পারে না। এমন কি নিজের এতিম অসহায় শিশুদের ক্ষুধার্ত মুখও, ওয়াক্তের সালাতের সামনে গৌন।

অনেকটা এ ধরনেরই একটি কাহিনী ঘটেছিলো আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে। খলীফা উমার (রাঃ) এর সময়ে, উনি একবার গভীর রাতে শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, প্রজাদের খোঁজ খবর নেবার জন্য।

হঠাত এক বাসায় দেখলেন, বিধবা এক মা বিশাল একটি ডেকচি চুলার ওপর বসিয়ে রেখেছেন। আর তার আশে পাশে গোল হয়ে বসে আছে ক্ষুধার্ত সন্তানেরা।

বাসায় কোন খাবার ছিলো না দেখে, মহিলাটি এক ডেগ পানি, চুলার উপর বসিয়ে বাচ্চাদের প্রবোধ দিচ্ছিলেন। বাচ্চারা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলো, খাবার তৈরি হবার জন্য! এই দৃশ্য দেখে আমিরুল মুমেনিনের হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে গেল। এরপরের গল্প তো অনেকেরই জানা।

প্রায় দেড় হাজার বছর পর, আজকের দিনেও ঘটতে চলেছিলো, এমনই এক গল্পের অপূর্ব পরিসমাপ্তি!

লতিফা বেগম সালাম ফেরাবার আগেই, কলিং বেলের শব্দ শুনলেন। এর পর শুনলেন বাচ্চাদের আনন্দিত স্বরের হৈ চৈ এর শোরগোল।

সালাম ফিরিয়ে দেখেন, তার ছোট ভাই অর্থাৎ সন্তানদের মামা এসেছেন। মামার হাতে একটি বিশাল টিফিন ক্যারিয়ার!! ছেলে মেয়ে দুটো প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম করলো খাবারের ওপর।

মামাজান কাচু মাচু হয়ে বললেন, তারা আজ নতুন বাসায় উঠেছেন, তাই বাড়িওয়ালা প্রচুর খাবার দিয়েছে। ভাগিনা ভাগিনীকে ফেলে এসব খেতে তার মনে ধরছিলো না। তাই সব সমেত এখানে হাজির হয়েছেন।

একাকিনী সেই মা, সালাত শুরু করার সময়েও কল্পনা করেন নি, যে সেদিন তাদের সবার রিযিকে এত রাজভোগ থাকবে!

মজাদার পোলাও, রোস্ট, গরু গোস্ত, ইলিশ মাছ… ইত্যাদি একের পর এক বের হতে লাগলো, টিফিন কলের ভেতর থেকে!!!

নিশ্চয় সেদিন রহমানুর রাহীমের প্রতি, লতিফার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কৃতজ্ঞতার বন্যা বয়ে গিয়েছিল। আর শিশুদুটোও নিশ্চয় বড় হবার পরেও, মনে রেখেছিলো আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নিকট থেকে আগত সেই দিনের আশাতীত রিযিকের ঘটনাটি।

আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন, অবশ্যই সকল প্রশংসা সেই সুমহান স্বত্বার, যিনি ধারণাতীত উৎস থেকে তার বান্দাদের রিযিক দিয়ে থাকেন।

——————-
রিযিকের গল্প
হাসনীন চৌধুরী

এপ্রিল ২১, ২০১৮ইং