স্মৃতি-কণা

ফজরের পরের এই সময়টা আমার ভীষণ প্রিয়৷ জানালা খুলে দেখলাম এখনো বেশ অন্ধকার৷ আজ চাঁদটাকেও একটু বেশি সুন্দর লাগছে৷ ভালোভাবে দেখার জন্য গরম কফির ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে যাওয়া চশমার গ্লাস মুছতে হচ্ছে একটু পরপর৷ কয়েকজন লোককে মসজিদে যেতে দেখলাম৷

পাশের বিল্ডিং এর তিন তলার একটা ঘরে আলো জ্বলছে; হয়তো নিসা নামের মেয়েটা এখন পড়তে বসবে, সামনে ওর জেএসসি পরীক্ষা৷

খুব কাছ দিয়ে কা কা করতে করতে উড়ে গেলো এক ঝাঁক কাক৷ আশ্চর্য! তাদের ডাকাডাকি আমার বেশ ভালো লাগলো! এই সময় সব কিছুকেই সুন্দর মনে হয়৷ হয়তো সবচেয়ে পবিত্র-বিশুদ্ধ জিনিসগুলো এই সময়েই চোখে পড়ে৷

মেইন গেইটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আম গাছটায় এবার অনেক মুকুল এসেছে৷ কিন্তু সবগুলোই কি থাকবে? হঠাৎ একদিন ঝড়ো হাওয়া, ঝরে যাবে অর্ধেক মুকুল৷ তারপর যখন কচি কচি আম ধরবে; হঠাৎ একদিন কাল বৈশাখী ঝড়, থেকে যাবে মাত্র কয়েকটা!

আজ, এত বছর পর তোর কথা খুব মনে পড়ছে৷ মনে পড়ার অবশ্য একটা কারণ আছে৷ গতকাল বুক-সেলফ পরিষ্কার করতে গিয়ে বড় মামার দেয়া গোলাপী ডায়েরীটা পেলাম৷ খুব ছোটবেলা থেকে ডায়েরী লিখতাম৷ একটা পৃষ্ঠায় দেখি আমি লিখেছি, “আজকে আমাদের ৪র্থ শ্রেণির প্রথম পার্বিক পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে৷ আমি ২য় হয়েছি৷ আমি আবারও ১ম হতে পারিনি৷ কণা ১ম হয়েছে৷” যদিও তখন বেশি আবেগ দিয়ে লিখতে পারতাম না, কিন্তু সেদিন আমার মনের অবস্থা কেমন ছিলো- সেটা খুব বুঝতে পারছি৷

হা হা, স্কুল জীবনের ছয়টা বছর তোকে কাটিয়ে ফার্স্ট হতে পারিনি- এই দুঃখটা অনেক দিন ছিল বটে! কিন্তু এই দুঃখের কারণে তোর প্রতি কোনো বিদ্বেষ কোনোদিন তৈরি হয়নি৷ বরং তুই ছিলি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড৷ এক সাথে স্কুল-কোচিং এ যাওয়া, একসাথে ঘুরতে যাওয়া- একসাথে কতোকিছু! তারপর তো বাবার বদলির কারণে অন্য শহরে চলে এলাম৷ এরপরও আমাদের বন্ধুত্ব টিকে ছিল অনেক দিন৷ ফোনে কথা বলতাম ঘন্টার পর ঘন্টা৷

এখনও তোকে খুব মিস করি৷ তোর কি আমার কথা মনে পড়ে? হয়তো তুইও আমাকে মিস করিস, নয়তো করিস না!

জানিস, ঐ দিনটার কথা আমি কোনোদিন ভুলব না৷ আমাদের এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছিলো৷ কয়েক হাজার ছেলেমেয়ের মত আমিও গোল্ডেন এ+ পেয়েছিলাম৷ টেনশনে ক’দিন ধরে চুপসে যাওয়া আমি রেজাল্টের হয়ে গেলাম আকাশে উড়তে পারা পাখির মত! মনের মধ্যে লাড্ডু ফুটছে আর চারিদিকও মিষ্টিময়৷ প্রথম দিন গেল কাছের দূরের আত্মীয়ের কাছে খবরটা ছড়িয়ে দিতে৷

দ্বিতীয় আরেক দফা এই কাজ শুরু করেছি৷ ফোনের কন্টাক্ট-লিস্ট থেকে তোর মায়ের নাম্বারটা খুঁজে বের করলাম৷ কল দিতেই ভয় লাগছিল৷ হয়তো হাজার খানা উপদেশের পসরা তোর মা আমাকে বিলি করার চেষ্টা করবেন৷ সাথে থাকবে তুই কতোটা কষ্ট করেছিলি সেটার উপাখ্যান৷

তোর কষ্টের উপাখ্যান অবশ্য শুনেছি৷ কিন্তু সাথে যেটা শুনেছিলাম – তেমন কথাও কখনো শুনতে হবে সেটা কল্পনাও করিনি৷ কল রিসিভ করেছিল তোর মেঝো খালামণি৷ ধরে আসা গলায় পাঁচ মিনিটের মত কথা বললেন।

ছুটি কাটাতে নানুবাড়ি গিয়েছিলি৷ সোনা মাখানো এ+ পাবি সেটা প্রায় নিশ্চিত, তাই রেজাল্টের একদিন আগেই মিষ্টি এনে ফ্ৰিজ ভর্তি করে রাখা হয়েছিল৷ কিন্তু তথাকথিত সোনার হরিণ না এসে অজানা কারণে একখানা ‘F’ অক্ষর এসেছিলো তোর মার্কশীটে৷ সবার হাসি মুখে পড়ল কালো মেঘের ছায়া৷ আর মুষলধারায় বৃষ্টি ঝরলো তোর চোখ দিয়ে৷ মন ভালো করতে চলে গেলি বাড়ির পাশের বিশাল পুকুরটাতে৷

তোর নানুবাড়ির এই পুকুরটার অনেক গল্প শুনেছি৷ পূর্ণিমার রাতে সবাই মিলে পুকুর পাড়ে বাসে গল্প করতিস৷ দিনের বেলা সব কাজিন এক সাথে পুকুরে সাঁতার কাটতো, আর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা তোকে পানি ছিঁটাতো৷ সাঁতার না জানার কারণে তুই পানিতে নামতিস না৷ এক মামাতো-বোন ছিলো; কি যেনো নাম? হ্যাঁ, মিমি আপু! সে তোর হাত ধরে আস্তে আস্তে পুকুরে নামাতো৷ পুরোটা সময় হাত ধরে রাখতো৷

কিন্তু সেদিন কেউ হাত ধরেনি, তুই একা একাই পুকুরে নেমেছিলি৷ তারপর একটু একটু করে পানিতে মিশে যাওয়ার চেষ্টা৷ সব গ্লাণি, সব না পাওয়াকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা৷ হারিয়ে যেতে চেয়েছিলি সবার কটু কথার ভয়ে, বাঁকা চোখে তাকানো সেই দৃষ্টির ভয়ে, নিগ্রহের ভয়ে৷ অথচ যিনি তোকে সবচেয়ে ভালোবাসেন তাঁকে ভয় করলি না৷ এ পৃথিবীর জীবন ছেড়ে চলে গিয়ে মানুষের কটু কথা থেকে হয়তো বাঁচতে পেরেছিস, কিন্তু পরের জীবনে কী সুখ পেয়েছিস?

মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়৷ হয়তো আমার মতো কারো ফোন-কলের ভয়ে কণারা পৃথিবীর সবার স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে চায়৷ ‘মানুষ মরে গেলে নাকি আকাশের তারা হয়!’, গল্প-উপন্যাস-সিনেমায় এই কথাটা অনেক শুনেছি৷ কোনোদিন বিশ্বাস করিনি। আর কথাটা বিশ্বাস করার যৌক্তিকতা নিয়ে অবশ্য কোনোদিন ভাবিওনি৷ কিন্তু আজ হঠাৎ করে চাঁদটাকে তোর গোল মুখটার মত দেখতে পাচ্ছি!

উহ্! বাম হাতটা চট করে একটা চড় বসিয়ে দিল ডান হাতের উপর৷ ঠান্ডা বাতাসের সাথে যে মশারাও ঘরে ঢুকছে – এতক্ষণ পর টের পেলাম৷ নিচতলার দু’জন আন্টি হাঁটতে বের হয়েছেন৷ তাদের সাথে আজ আরও একজনকে দেখা যাচ্ছে৷ চশমার গ্লাস মুছে পরিষ্কার দেখার চেষ্টা করলাম৷ তবুও ঝাপসা দেখছি কেন? কফি তো সেই কখন শেষ হয়ে গেছে! আসলে আমার চোখ দুটোই ঝাপসা হয়ে এসেছে….।

…………………….
স্মৃতি-কণা
মাহবুবা উপমা

এপ্রিল ০৩, ২০১৮ইং