এক চিলতে রোদ

১.
“এতো চিল্লানোর কি আছে, আমরা কি বাচ্চাকাচ্চা পয়দা করিনি, নাকি? আজকালকার মেয়েদের এত নখরা- বাবা রে বাবা!”

কথা কটা কানে যেতে ফাইলে এডিমিশন অর্ডার লিখতে লিখতে আড়চোখে ভদ্রমহিলাটার দিকে তাকালো মুবাশ্বিরা। যাকে উদ্দেশ্য করে বলা সে প্রাণপণে ঠোঁট কামড়ে কান্না সামলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই ধরনের কথা এই ম্যাটারনিটি ইউনিটে ডিউটির সেই প্রথম থেকেই শুনে যাচ্ছে- একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার নিজের কাজে মন দিল, সিনিয়রদের উপদেশ মনে করিয়ে দিল নিজেকে- এই ইউনিটে মাথা কুল, ইমোশনাল হলেই নিজেকে ঝুঁকিতে ফেলা।

হাতের ঘড়ি পিকপিক করে জানান দিল রাত ২টা বাজে। নিজের ৭ মাসের ছুটকুটা বাসায় ওর বাবার কাছে, কাজ গুছিয়ে একটু ফোন দিতে যাবে তখনই এই রোগীটা আসলো, ব্যথার তোড়ে একটু পর পর দমকে দমকে উঠছে মেয়েটা – আর সাথে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে তার এটেন্ডেন্ট। ওয়ার্ডের বাইরে আরো দুই তিনজন দাঁড়িয়ে – সবার চোখে মুখে ঘুম আর বিরক্তির ছাপ।

নার্সের হাতে এডমিশন অর্ডারটা দিয়ে মহাবিরক্তি নিয়ে গজগজ করতে থাকা বয়স্কার কাছে গিয়ে মুবাশ্বিরা বললো- “এখনও সময় আছে৷ প্রথম বাচ্চা, সময় লাগবে। আপনারা হালকা কিছু খাবার খেতে দেন রোগীকে আর বিশ্রাম নেন। অস্থির করবেন না, যার আসার সে সময়মত আসবে৷ আর রোগীকে ঘুমাতে দেন- ওর শক্তি দরকার।”

বয়স্কা আরো বিরক্তি নিয়ে ফোত করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন- “যত্তসব! আজকালকার মেয়েরা! এতটুকু সবর নাই, আর মা হতে এসেছে সব। বললাম কত করে সকাল পর্যন্ত হাসপাতালে আসার দরকার নাই- না, উনার এক্ষুনি আসা লাগবে! আমরা আর বাচ্চার মা হইনি! বাড়ি সুদ্ধ সবাইকে হয়রানি…… “

গজগজ করতে করতে প্রস্থান করলেন তিনি অপরাধিনীকে ফেলে, অপরাধিনী তখন অনেক কষ্টে চোখ উপচে পড়া কান্না আটকাচ্ছে।

আহারে, কি অভিমান দুই চোখে- আর লজ্জা! মা হওয়ার লজ্জা, অসহায় হওয়ার লজ্জা, সবাইকে কষ্ট দেওয়ার লজ্জা- এ লজ্জা আর বাক্যবাণের কষ্টের পাশাপাশি মা হওয়ার কষ্ট আছে, বাচ্চাকে নিয়ে আশংকা আছে, নিজের সম্পূর্ন টুকু অপরিচিত ডাক্তার নার্সের সামনে উন্মুক্ত করার জড়তা আছে। এই সময়টা নিজে পার করে এসেছে মুবাশ্বিরা, আলতো করে মেয়েটার মাথায় হাত রাখলো ও- “একটু ঘুমাতে চেষ্টা করুন। সময় হলে আসল পরিশ্রম আপনাকে করতে হবে, এখন যতটা পারেন রিলাক্স করুন।”

২.
নিজের রুমে এসে খোকনকে ফোন লাগালো মুবাশ্বিরা- “সুহাইল কি করে? ঘুমিয়েছে?”

-“ম্যাডাম, আমি আপনাকে অনেক ভালবাসি। কেন জানেন?” ওইপ্রান্ত থেকে খোকনের ঘুম ঘুম গলার উচ্ছ্বাস শুনে একটু বুঝি গাল লাল হলো মুবাশ্বিরার। লাজুকভাবে হেসে দিল ও।

– “আমি তোমার জন্যে আজকে আম্মুকে জড়ায় ধরে বলেছি – আম্মু, আমাকে মাফ করে দাও। তোমাকে সারাজীবন বহুত জ্বালাইসি। পারো ক্যামনে ভাই তোমরা? সারাদিন এই বিচ্ছুর পিছনে পিছনে! ক্লান্তি নাই, বিরক্তি নাই! এই ৬ ঘন্টায় আমার তো খবর হয়ে গেছে! তাও আম্মু আছে আমার সাথে। সেই যে বাঁদর ঝুলা হয়ে ঝুলছে তুমি যাওয়ার পর থেকে। আর তুমি তো আরো এক কাঠি উপরে- আমি নিজে ডাক্তার, তাও এইভাবে বাড়ি-ওয়ার্ড সামলাতে পারতাম না। হ্যাটস অফ!”

মুবাশ্বিরা হেসে দিল, ” থ্যাংক ইউ ফর দ্যা এপ্রিসিয়েশন। এইভাবেই যদি প্রতিটা হাজবেন্ড তাদের ওয়াইফকে এপ্রিশিয়েট করতো, তাহলে মেয়েদের জন্যে সব হ্যান্ডেল করা ইজি হতো আরো। যাই হোক, সুহাইল ঘুমিয়েছে?”

-“জ্বী, আপনার বাঁদর আমার বুকের উপর উঠে ঘুমাচ্ছেন। ফিডার খাইয়েছি, ডায়াপার পালটে দিয়েছি। উফ কি গন্ধ! খায় কি যে এত…. আই মিন!”

টুকটাক কিছুক্ষণ কথা বলে মুবাশ্বিরা লাইনটা কেটে দিল ঠোঁটে হাসি নিয়ে। এই জায়গাটা একদিনে পায়নি- আস্তে আস্তে একটু একটু করে আদায় করে নিয়েছে। শুরুতে তো খোকন পানির গ্লাসটার জন্যেও ওর শ্বাশুড়ি আর ওকে ডাকতো৷

এখন সব করে নিজে খেয়াল করে, ওর শ্বাশুড়ির ও অনেক অবদান আছে এখানে, প্রচন্ড সম্মান করে মুবাশ্বিরা তার শ্বাশুড়িকে – পরিবর্তনকে কেউ ভাল চোখে দেখে না, আর তা যদি বাড়ির বউয়ের হাত ধরে আসে- তাহলে তো আর কথাই নেই। আর আছে সামাজিক অনাচার! ছেলের বউয়ের সব খারাপ, বউ তো ছেলেকে পুষ্যি নিয়ে নিচ্ছে! নিজে কষ্ট পেয়েছি, বউটাকেও দেখাতে হবে এখন! কি এক অদ্ভুত প্রথা!

ওর শ্বাশুড়ি এমন কিছুই করেননি – শুরুতে বুঝতে সময় লেগেছে দুইজনেরই, সম্পূর্ণ দুই দুনিয়ার মানুষ ওরা। কিন্তু দুইপক্ষের এক হতে সময় লাগেনি। মুবাশ্বিরাও মায়ের মত তাঁর কাছে সঁপে দিয়েছে নিজেকে, আর তিনিও মেয়ের মতই আগলে নিয়েছেন৷ এমনটা সবখানে হয় না, কিন্তু হলে কত ভাল হতো!

“ইন শা আল্লাহ, আমার সুহাইলের বউটাও আমাকে এইভাবে ভালবাসবে, সম্মান করবে- যেমন আমি আম্মাকে করি। ইন শা আল্লাহ আরো ভাল শ্বাশুড়ি হবো মার কাছ থেকে শিখে শিখে।” – নিজেকে এ কথা কটা বলে একা একাই ফিক করে হেসে দিল; হায়রে মা- মাত্র ৭মাসের পিচুয়াকে বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছে এখনি!

৩.
মা- তাই না!

কত আবেগ যে জড়ানো শব্দটার মাঝে৷ সুহাইল পেটে থাকার কথাগুলো মনে পড়লো মুবাশ্বিরার- টুকুশ টুকুশ করে নড়তো; প্রথম যেদিন নড়া টের পেয়েছিল; নামাজে দাঁড়িয়ে কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে গেছিল ও। বার বার শুকরিয়া আদায় করেছে, নফল নামাজ পড়েছে। ২৮সপ্তাহ থেকে ফিটাসের অডিটরি ফাংশন ডেভেলপ করে- ও কুরআন তিলাওয়াত করলেই সুহাইল চুপ করে থাকতো, যেন সে কত বুঝে!

খোকন তখন এমফিল কোর্সে ঢাকায়, আসতো যেত যখন ছুটি ম্যানেজ করতে পারতো। মুবাশ্বিরা পুরো প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডটা মোহনপুরে একা একা ডক্টরস কোয়ার্টারে কাটিয়েছে, শুধু একটা ছুটা বুয়া এসে রান্নাবাড়া আর ঘরের কাজ করে দিয়ে যেত। কত কষ্টের পাওয়া সরকারি চাকরি – ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা কল্পনাতেও আসেনা। কত কি শখ হতো- একটু ভাল মন্দ খাওয়া, এই ভর্তা সেই আচার, ডিউটি শেষে একটু ঘুরতে যাওয়া- কোনোকিছুই করতে পারেনি ওরা।

পাশের ফ্ল্যাটের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ভাইয়ের ওয়াইফ- ভাল মন্দ একটু কিছু করে খাওয়ালে, সন্ধ্যার পর কিছুক্ষন এসে বসলে ও যে কি কৃতজ্ঞ বোধ করতো! এই মায়াগুলোই ওকে কষ্ট করার শক্তি দিয়েছিল – বার বার বদলির কাগজ নিয়ে ছুটাছুটি করে সুহাইল হওয়ার ১ মাস আগে বদলির অর্ডার পেল শেষমেষ অনেক চেষ্টার পর। ঢাকায় এসে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জয়েন করে তবে যেন একটু শান্তির নিশ্বাস নিতে পারলো ও।

তখন নিজের মা-বাবা, শ্বাশুড়ি, জামাই, ছোট ভাই সবাই কাছে। তবুও আল্লাহ এর কি হুকুম- লেবার পেইন ডিউটিতে থাকতেই উঠলো, খোকনের তখন পরীক্ষা চলে। পরীক্ষা শেষ করে বেড়িয়ে দেখে সবার এত এত মিসকল, খবর পেয়ে যখন এসেছে তখন সুহাইল প্রায় চলে এসেছে। আহারে জীবন!

মুবাশ্বিরার সারা শরীর যন্ত্রণায় ছিঁড়ে আসছিল আর শুধু একজনেরই হাতের আশ্রয় খালি খুঁজেছিল ও অভিমানিনীর মত- সুহাইলকে ওর বুকের উপর যখন দিল- এইটুকু সাদা লাল গোলাপিতে মেশানো এক হাত সাইজের একটা ছোট্ট মানুষ, না কেঁদে পিটপিট করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে যেন।

সুহাইলের পিঠে হাত দিয়ে বুকে চেপে ধরে মুবাশ্বিরা ব্যথায় ফুঁপাতে ফুঁপাতে শুধু মা আর শ্বাশুড়িকে প্রশ্ন করেছে- “ও এসেছে, ও এসেছে?” তখন ওর বাচ্চা ছেলে না মেয়ে, তা জানার চেয়েও অনেক বেশি জরুরি ছিল জানা, খোকন বন্ধ দরজার ওপারে কি না। ও ভাবেই জ্ঞান হারিয়েছে মুবাশ্বিরা, চোখ মেলে মাথায় খোকনের হাতের ছোঁয়া পেয়ে আবার নিশ্চিতে ঘুমিয়ে গেছে পোটলা করা সুহাইলকে বুকের কাছে টেনে। আর ভয় নেই ইন শা আল্লাহ।

৪.
নিজের স্মৃতিগুলোকে মনের কোণে সযতনে রেখে উঠে দাঁড়ালো মুবাশ্বিরা, ঘড়িতে ৩টা বাজে- নতুন আসা মেয়েটার লেবার প্রোগ্রেস দেখতে হবে।

মেয়েটা এখনো ফুঁপাচ্ছে- আশেপাশে এটেন্ডেন্ট বয়স্কা মহিলাটাকে দেখতে পেল না মুবাশ্বিরা, মেয়েটার কাছে নার্স দাঁড়িয়ে স্বান্তনা দিচ্ছে- “এই তো, আর একটু!”

“কি ব্যাপার সিস্টার?”- বলে কাছে দাঁড়ালো ও।

-” ম্যাডাম, রোগীর লোক চলে গেছে। বলে গেছে সকালে আসবে। ওষুধ খাবার সব কিনে রেখে গেছে। কিন্তু মেয়েটার কাছে একজন থাকবে না, বলেন?”

“এ আর নতুন কি, আগেও এমন দেখেননি?” মুবাশ্বিরা এখন অনেককিছুই ইজিলি নিতে শিখে গেছে, এইসব ইগনোর করে রোগীর দিকে মন দিতে শিখে গেছে- এখন ওর সাপোর্টটাই রোগীকে বাঁচাবে, জুঝে যাওয়ার শক্তি দিবে। কত কিসিমের যে মানুষ আছে এই দুনিয়ায়, এই ডাক্তারি করতে এসে দেখেছে ও। রোগী কোয়াপারেট করলে খুব একটা সমস্যা হবে না ম্যানেজ করা, পুরোটাই মেয়েটার মনের জোরের উপর ডিপেন্ড করছে।

“কাইন্দো না মা, আমি যামু নি লগে! আফা, আমি থাকলে হইবো না? কি বজ্জাত বেটি গো! ছাওয়ালটাক ফেলি চলি গেস! গজব দিবো আল্লায়!” দুই বেডের মাঝে শুয়ে থাকা বুড়ি মহিলা মাটিতে করা তার বিছানায় উঠে বসে কথা কটা বললো মেয়েটাকে। গ্রাম থেকে এসেছে নিজের মেয়েকে নিয়ে – সিভিয়ার এন্টি পার্টেম ব্লিডিং ছিল, মা-বাচ্চা দুইই ভাল আছে।

তার এই কথা শুনে মেয়েটা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো – মুবাশ্বিরার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে। খুব মায়া লাগল ওর৷ “ওমন করে কাঁদলে কষ্ট পাবে আপু, তোমার বাবুটারও কষ্ট হবে। আমরা আছি তো। এই খালাও যাবে সাথে। তোমার সময় আছে, দেখবে সবাই আসলেই তোমার বাবুটা হবে৷ ঠিক আছে? কাঁদে না! মায়েরা সব পারে। মাদের অনেক সাহসী হতে হয়৷ ভয় পেয়ো না।

একটা সুন্দর দু’আ শিখিয়ে দেই আসো- আমার বাচ্চা হওয়ার সময় খুব পড়তাম, ইয়া আল্লাহ – এই জার্নির একমাত্র সফরসঙ্গী আপনি। আমাকে ঈমান আর তাকওয়ার সাথে এই জার্নি শেষ করতে সাহায্য করুন। আমাকে আর আমার পরিবারকে সকল দূর্ঘটনা, জান মালের ক্ষতি থেকে হিফাজত করুন। আমি নিজেকে আর আমার পরিবারকে আপনার হাতে সঁপে দিচ্ছি। নিশ্চয়ই আপনি সর্বোত্তম হিফাজতকারী। আমাকে বারাকাহ দিন- রিজিক দিন- আমাদের জন্যে আসান করে দিন।”

মেয়েটা ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললো,”আমীন!”

– “কিচ্ছু হবেনা, আমি একটু দেখি তোমাকে? বাচ্চার হার্টবিট শুনতে দিবো, ঠিক আছে? আর কাঁদে না। তুমি এই দু’আটা করো মনে মনে৷ আর যা যা চাইতে ইচ্ছা করে, বলতে ইচ্ছা করে – আল্লাহকে বলো। এখন দু’আ কবুল হয়। আল্লাহ কষ্টের মাঝে দিয়ে গুনাহ মাফ করে দেন।”

“আপু, আমি মেডিকেল স্টুডেন্ট। থার্ড প্রফ দিলাম।” মেয়েটা নিজের কথা বলছে, এটা ভাল লক্ষণ। মন শান্ত হবে কথা বললে৷

-“তাই? মা শা আল্লাহ! খুব ভাল তো তাহলে! তোমার সাথে উনি কে ছিলেন? “

“আমি হোস্টেলে ছিলাম এতদিন, ১ মাস আগে বাড়ি ভাড়া নিয়েছি। উনি বাড়িওয়ালী চাচী৷। আমার ইডিডি তো আরো ১০দিন পরে। কালকে আম্মু আব্বুর রওনা দেওয়ার কথা ছিল- ফোন পেয়ে আজকে রওনা দিয়েছেন। আর হাজবেন্ডের পোস্টিং বগুড়ায়- ও ও রওনা দিয়েছে। রাত ১টায় কি আর কিছু পাবে আসার মত?

বাবু নড়ছিল না, তাই আমিও আর সাহস পাইনি বাসায় থাকার। বান্ধবীরা হোস্টেল থেকে আসতে চাইছিলো, এত রাত দেখে আমি মানা করেছি। চাচী বলছিলেন বাসায় থাকতে, কিন্তু আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল আপু, আর পানি ভেঙে গেল হঠাৎ করে- বাবুও নড়ছিল না…. আমি কিছু বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে?”

মেয়েটার জন্যে খুব মায়া লাগলো মুবাশ্বিরার। স্টেথোস্কোপটা জায়গামতো চেপে ধরে মেয়েটাকে কানে লাগাতে ইশারা করলো, “শুনতে পাচ্ছো?তোমার বাবুর হার্টবিট। ও তোমাকে বলছে যে ও ভাল আছে। এখন তুমি কাঁদলে ওরও কষ্ট হবে। ভয়ের কিছু নাই।”
মেয়েটা স্টেথোস্কোপটা কানের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে আছে চোখ বন্ধ করে, গড়িয়ে গড়িয়ে পানি ওর চুলের মাঝে ঢুকে যাচ্ছে- আহারে মা! মুবাশ্বিরা নিজেও এমন করে কাঁদছিল বুঝি অবজারভেশনে ঢুকানোর আগে। একা একা কি অসহায় লাগছিল ওর! বেশিক্ষণ না, খবর পেয়ে আসতে যেটুকু দেরি সবার- তাও খুব লম্বা মনে হচ্ছিল সেই সময়টুকু। আর কষ্ট! সে তো বাদই দিলো ও।

নতুন আরেক রোগী আসছে, তাকে এডমিট অর্ডার দিতে হবে- ওইদিকে যেতে যাবে, মেয়েটা হাত চেপে ধরলো। “আপু, প্লিজ আপনি থাকেন?”

-” রোগী দেখতে হবে বাবা! আমাদের ডিউটিটা আগে, তাই না? এই যে, এই খালা বসে থাকবেন তোমার কাছে, কেমন? কি খালা,পারবেন না?” মাটিতে বিছানা পেতে শুয়ে থাকা গ্রামের বয়স্কা মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল মুবাশ্বিরা- যিনি একটু আগে মেয়েটাকে স্বান্তনা দিচ্ছিলেন পাশে থাকবেন বলে৷
-“হ হ! পারুম মা, পারুম।”

৫.
মুবাশ্বিরার ডিউটি শেষ হলো সকাল ৮টায়। সব কিছু গুছিয়ে রাউন্ড শেষ করে বের হতে হতে সকাল ৯.৩০টা। ওয়ার্ড থেকে বের হতে গিয়ে মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল। বাকি রাত এত ব্যস্ত ছিল দুইটা খারাপ ওটি এসিস্ট করা নিয়ে যে ওর কথা ভুলেই গেছিল।

আর এই কেস গুলো ইন্টার্নরা হ্যান্ডেল করে, কম্পলিকেশন হলে ওকে জানায়। বেডের কাছাকাছি এসে দেখে দুইজন বয়স্কা একটা পুটুশ বাচ্চা কোলে নিয়ে আদর করছে, দুইজনের একজন রাতের সেই গজগজানি বাড়িওয়ালী- এখন মুখে সোনা ঝরে পড়ছে! আরেকজনের সাথে মেয়েটার চেহারার মিল আছে- মা সম্ভবত। আর মেয়েটার মাথায় হাত রেখে চোখে ছলছল পানি নিয়ে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে যে মানুষটা বসে আছে সে নিশ্চিতভাবে ওর হাজবেন্ড।

আর দুই বেডের মাঝে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে নিজের নাতিকে গীত গাইতে গাইতে তেল মালিশ করছে পরোপকারী খালাটা। সে যে একটা বড় সময় মেয়েটার কাছে ছিল আর তা যে সে কোন প্রতিদানের আশায় করেনি এটা ভেবেই মনে মনে শ্রদ্ধায় বিনম্র হলো মুবাশ্বিরার। এমন মানুষেরা সমাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বলেই মানুষের উপর বিশ্বাস পুরো উঠে যায়নি ওর হাজার প্রতিকূলতা দেখেও। বরং এই নগন্য মানুষের কাছেই মানবতা শিখে ও প্রতি নিয়ত।

বিরক্ত করলো না আর ছোট্ট পরিবারটাকে মুবাশ্বিরা, পাশ দিয়ে আসতে আসতে কানে আসলো বাড়িওয়ালীর খোঁচা মারা বাক্যবাণ- ” দেখছেন ভাবী, আজকালকার ছেলে মেয়ে! সবার সামনে কেমন বেহায়ার মত মাথায় হাত রেখে বসে আছে। আমরা আর বাচ্চা জন্ম দেইনি!”

এমার্জেন্সির বাইরে এসে মুবাশ্বিরা দেখলো তার পুত্র, পিতার বুকের কাছে বাঁদর ঝোলা হয়ে ক্যারিয়ারে ঝুলছে। সুহাইলের হাতে সকালের এক চিলতে রোদ এসে পড়েছে ছাউনির ফাঁক গলে। পরম বিস্ময় নিয়ে সে বার বার হাত মুঠো করছে, আর খুলছে- রোদের সাথে খেলা করছে। আর মুখ দিয়ে বিচিত্র গি গি শব্দ বের করে বাবাকে দেখাচ্ছে- যেন রোদের সাথে কত কথা তার!

মুবাশ্বিরার সারা পৃথিবীটা চিলতে চিলতে রোদে ভরে গেল, ওর ছোট্ট পৃথিবী। সুখী হতে কি খুব বেশি কিছু লাগে?

নিশ্চয়ই কষ্টের পর প্রশান্তি আসে, অবশ্যই আসে।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ

প্রেগন্যান্সি এবং প্যারেন্টহুডের প্রতিটা পদক্ষেপ খুব সেনসিটিভ ও ভলনারেবল হয়। আমি আমার ব্যক্তিগত ও প্রফেশনাল লাইফে যত ডিল করেছি তত শিখেছি সামান্য থেকে সামান্য সহানুভূতি, মায়া আর শুধু উপদেশ না দিয়ে আন্তরিকতার সাথে সাহায্য করা – অনেক বড় একটা প্রভাব ফেলে যায়, সেটা শারিরীক হোক বা মানসিক বা সামাজিক।

হয়ত মানুষটাকে আপনিও চেনেন না, আর তিনিও আপনার নাম জানবেন না- কিন্তু সারাজীবন তিনি আপনাকে আপনার করা একটা ছোট্ট কাজের জন্যে মনে রেখে দেবেন, মনে মনে শ্রদ্ধা করবেন, অন্যকে আরো পজিটিভভাবে ডিল করবেন।

আপনার করা একটা আপাত “সামান্য” কথা বা কাজ আপনার জন্যে সাদাকায়ে জারিয়া হয়ে যেতে পারে, দু’আ পাওয়ার ওয়াসিলা হয়ে যেতে পারে অথবা একটা জবান বা কাজে দেওয়া ক্ষত- যা বদ’দু আর কারণও হতে পারে৷

যদি কখনও কোন প্রেগন্যান্ট দম্পতী বা নতুন মা বা নতুন প্যারেন্ট হয়েছেন, এমন কাউকে সামান্যতম সাহায্য করার পজিশনে পান- প্লিজ সাহায্য করুন তা আপনার কাছে যতই তুচ্ছ বা অপ্রয়োজনীয় মনে হোক না কেন। হয়ত আপনাকেই আল্লাহ তাদের করা দু’আ কবুলের ওয়াসিলা করছেন। তাই জাজমেন্টাল বা ক্রিটিক্যাল নাহয়ে সহমর্মী হোন, সহানুভূতিশীল হোন- এটা আসলেই বারাকাহ বয়ে আনে।

Simple acts of kindness take us a long way.

প্রেগন্যান্সি বা প্যারেন্টিং বলতে শুধু নতুন মাদেরকেই আমরা বুঝাই, কিন্তু নতুন বাবাদের জন্যেও এটা সমানভাবে প্রযোজ্য। ছেলেরা মেয়েদের মতো ইমোশনালি এক্সপ্রেসিভ না, তাদের আল্লাহ এইভাবেই তৈরি করেছেন। তারমানে এই কিন্তু না যে একজন নতুন মা যখন শারিরীক, মানসিক,সামাজিক কষ্টগুলোর মাঝে দিয়ে যাচ্ছেন- নতুন বাবাটা যাচ্ছেন না!

তিনি হয়ত মা না, কিন্তু তিনি বাবা। তাঁর মাঝেও ন্যাচারাল একটা ইন্সটিংট আছে তাঁর স্ত্রী – সন্তানকে সবরকম সুরক্ষা দেওয়ার। আমাদের সামাজিক নানাবিষয় কেন জানি সেটা এলাউ করে না৷ কিন্তু এইসময় হবু বা নতুন বাবারা যে চাপে থাকেন পারিবারিক বা সামাজিকভাবে, এটা কেউ বুঝতে চেষ্টা করেন না।

তাই শুধু নতুন মা না, নতুন বাবাদের প্রতিও সহানুভূতিশীল হন। কাউকে কোন কথা বা কারো সাথে কিছু করার আগে, একটু থামুন- ভাবুন নিজে সিমিলার পরিস্থিতিতে কি ধরনের ব্যবহার বা সাপোর্ট আশা করতেন৷

জীবনে আঁধারির পাশাপাশি আলোও হাত ধরাধরি করে চলে। আঁধার জীবন পেয়েছি বলে অন্যের জীবন আলোতে কেন ভরতে পারবোনা! কেন একচিলতে রোদ হয়ে প্রচন্ড শীতে কারো জন্যে কোমল উষ্ণতা হতে পারবো না!

————————————
এক চিলতে রোদ

সারওয়াত জাবীন আনিকা