ডিজিটাল ড্রাগ

১.
সাঈফের বয়স দশ বছর। বেশ কিছুদিন ধরে আব্বুর কাছে বায়না ধরেছে একটা মোবাইলের জন্য। বন্ধুদের মোবাইল আছে, ট্যাব আছে। স্কুলে ওরা যখন গেইমস আর apps নিয়ে আলোচনা করে, সাইফকে তখন বোকার মতো চুপ করে বসে থাকতে হয়। কাজেই জন্মদিনে ছোটখাটো একটা ট্যাব গিফট পেয়ে সাঈফের খুশির সীমা রইল না।

তখনও কেউ জানতো না, আব্বুর দেয়া এই নিরীহ উপহারটি কত বড় সর্বনাশ ডেকে আনবে এই ছেলের জীবনে।

দেড় বছরের আঈশার আম্মুর অনেক কাজ। সারাদিন সারাক্ষণ একমাত্র মেয়ে আঈশাকে সময় দেয়া সম্ভব হয় না। একরকম বাধ্য হয়েই মেয়েকে নিজের মোবাইলটা দিয়ে বসিয়ে রাখে সে। কিছু এডুকেশনাল apps ডাউনলোড করে দিয়েছে, ইউটিউবে রাইমস দেখতেও পছন্দ করে মেয়ে। এতে বিরক্ত করে কম, খাওয়ানোর সময়েও হাতে মোবাইলটা ধরিয়ে দিলে চুপচাপ খেয়ে নেয়।

আঈশার আম্মু জানে না এই নির্দোষ শিক্ষনীয় শিশুতোষ apps আর ভিডিও ভবিষ্যতে তাকে কী শিক্ষা দিতে যাচ্ছে।

২.
“আমি কয়েকশো হেরোইনে আসক্ত মানুষকে নিয়ে কাজ করেছি, আমি বরং বলি যে একজন সত্যিকারের স্ক্রিন-আসক্ত ব্যক্তির চিকিৎসা করার চাইতে একজন হেরোইনে আসক্ত ব্যক্তির চিকিৎসা করা সহজ।”

কথাটা ড. নিকোলাস কারদারাসের, যিনি বাচ্চাদের স্ক্রিন আসক্তি নিয়ে লেখা বিখ্যাত “গ্লো কিডস” বইটির লেখক।

একটানা প্রযুক্তির ব্যবহার আর স্ক্রিনের উপর নির্ভরতা মাদকাসক্তির মতই একটি শিশুর উন্নয়নশীল মস্তিষ্কের (developing brain) স্নায়বিক ক্ষতি সাধন করে। স্ক্রিন আসক্তি ধরা পড়েছে এমন শিশুদের নিয়ে ব্যাপক গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, এসব শিশুরা তাদের সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলে। তারা সহজে কারো সাথে মিশতে পারে না, গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। স্কুলের পড়াশোনাতেও পিছিয়ে থাকে। একসময় একাকীত্ব, অস্থিরতাসহ নানা রকম মানসিক সমস্যায় ভোগে।

দু’শোর বেশি পরীক্ষায় দেখা গেছে অতিরিক্ত স্ক্রিন দেখার কারণে আসক্তির পাশাপাশি বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি (clinical disorder) দেখা যায়। সম্প্রতি ব্রেইন-ইমেজিং রিসার্চে জানা গেছে স্ক্রিন আসক্তি মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল কর্টেক্সে কোকেইন বা হেরোইনের মত মাদকদ্রব্যের ন্যায় কাজ করে।

স্টিভ জবস আর বিল গেটস দু’জনই তাদের নিজ নিজ সন্তানদের প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখতেন। বিল গেইটস তার মেয়েকে ৪৫ মিনিটের বেশি গেইমস খেলার অনুমতি দিতেন না। ১৪ বছর বয়সের আগে তাকে মোবাইল দেয়া হয়নি। স্টিভ জবসের বাসায় বাচ্চাদের আইপ্যাড ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। কেন? কারণ তারা শিশুদের উপর এসবের ভয়াবহ প্রভাব সম্পর্কে অন্যান্য বাবা-মার চাইতে বেশি জানতেন।

ফিরে যাই সাঈফের কথায়। শুরুর দিকে সাঈফের বাবা ওকে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দিতেন না। কিছু গেইমসের app ডাউনলোড করে একা একাই খেলত সে। কিন্তু বন্ধুদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে তো নেট ছাড়া চলে না। কাজেই বিকেলে খেলতে গিয়ে উপর তলার বড় ভাইয়ের সাথে দেখা হলে, তার কাছ থেকে ওদের ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড চেয়ে নিল সে। এরপর শুরু হলো দল বেঁধে ভার্চুয়াল গেইমস খেলা, দিন-রাত ইউটিউবে বিচরণ, অতঃপর নীলের দুনিয়ায় প্রবেশ।

স্বাভাবিকভাবেই এটা একসময় আসক্তিতে পরিণত হলো। একবার গেইমস খেলা শুরু হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়, বিকেলে আর বাইরে খেলতে যাওয়া হয় না আগের মতো। পড়ালেখার মান ক্রমশ কমে যাচ্ছিল, রাত জেগে ডিভাইস নিয়ে থাকাতে শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের অধঃপতন ঘটতে লাগল। বায়োলজিক্যাল ক্লক ওলটপালট হয়ে গেল। বড় হতে হতে অস্থির, জেদী, অসামাজিক একটা মানুষে পরিণত হলো সে। ব্যাপারটা ভয়ংকর আকার ধারণ করল যখন ডিভাইস আসক্তি থেকে ইন্টারনেট আসক্তি ধীরে ধীরে পর্ন আসক্তিতে পরিণত হলো।

একই রকম ঘটনা ঘটেছিল ছোট্ট আঈশার জীবনেও। শিক্ষণীয় খেলা আর ভিডিও দেখতে দেখতে ওর আসক্তি অন্যরকম পর্যায়ে চলে গেল। মাদকাসক্ত, নেশাগ্রস্থ ব্যক্তি মাদকদ্রব্য না পেলে যা হয় — ডিভাইস দেখতে না দিলে ওর আচরণও সেরকম ছিল। চিৎকার করে গলা ছেড়ে হাত-পা ছুড়ে অনবরত কান্না। কয়েক বছর পর স্কুলে ভর্তি হলে দেখা গেল কারো সাথে ও মিশতে পারছে না, ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না, কমিউনিকেট করতে পারছে না, ইন্সট্রাকশন ফলো করতে পারছে না। অথচ apps দেখে তোতা পাখির মতো কত কিছুই আওড়াতো সে! ধীরে ধীরে অবাধ্য, জেদী, বেয়াদব সন্তানে পরিনত হলে অবশেষে আঈশার বাবা তাকে নিওরোলজিস্ট দেখালেন। সেখানে তারা জানলেন আঈশার ডিভাইস আসক্তির কারণে এমন হয়েছে।

আমাদের চারপাশেই এমন অনেক উদাহরণ দেখা যাবে। তারপরও ভয়ংকর একটা সত্য ঘটনা শোনাই। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় এক দম্পতি তাদের নয় বছরের ছেলেকে সবরকম ডিভাইস থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতেন। তাদের বাসায় টিভি ছিল না। ছেলেকে নিয়ে তারা নৌকা ভ্রমণ, ক্যাম্পিং ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকৃতিতে সময় কাটাতেন। ভদ্র, শান্ত, পশুপাখির প্রতি সদয়, ভালো ছেলেটা বদলে যেতে লাগলো যখন থেকে সে স্কুলে এডুকেশনাল ভিডিও দেখতে আর বন্ধুদের সাথে মিশে গেইমস খেলতে শুরু করল। একসময় সে ডিভাইস-আসক্ত হয়ে পড়ল, দিন রাত স্ক্রিনের মাঝে ডিজিটাল দুনিয়ায় ডুবে থাকল। তার মা যখন ডিভাইস নিয়ে নিলেন, ছেলে তখন প্রচণ্ড আক্রোশে মার গায়ে হাত তুলল। পুরোপুরি মাদকাসক্তের মতো হয়ে গিয়েছিল সে। কম্পিউটার সরিয়ে ফেলার পর ছেলের আচরণে বাধ্য হয়ে মাকে পুলিশ ডাকতে হয়েছিল।

৩.
শিশুদের স্ক্রিন দেখানোর ব্যাপারে পেডিয়াট্রিক এক্সপার্ট থেকে শুরু করে বয়ঃসন্ধিকাল বিষয়ক গবেষকরা আজকাল কঠোরভাবে সমালোচনা করছেন। তা সত্ত্বেও app store গুলোতে ডাউনলোডের জন্য বাচ্চাদের শত শত আকর্ষণীয় apps আর গেইমস পাবেন আপনি। অধিকাংশ বাবা-মা আর app ডেভেলপাররা কোন সতর্কবাণীতেই কান দিচ্ছে না। ফেইসবুকসহ বিভিন্ন সোশাল মিডিয়াতেও আজকাল ছোট ছোট ভিডিওক্লিপের মাধ্যমে এর ভয়াবহতা তুলে ধরা হচ্ছে। এতে বেশ কিছু সচেতন অভিভাবকগণ ইদানিং শিশুদের সবরকম ডিভাইস থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছেন।

সিংগাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হসপিটালের চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট ইউনিটের দু’জন গবেষক ড. রামকুমার এবং ড. ল কয়েকশো পরিবারের শিশুদের স্ক্রিন দেখার অভ্যাসের উপর গবেষণা চালিয়েছেন। তাদের কথায়, একটি এক বছরের শিশু যত বেশি সময় টিভি দেখে কাটায়, সাড়ে চার বছর বয়সে সেই শিশুটির IQ ততো কম থাকে।

ড. ল এর মতে, যে শিশুটি ছোট থেকেই স্ক্রিন আসক্তির স্বীকার — সে ক্লাসে স্থির হয়ে বসতে পারে না, সহপাঠীদের বিরক্ত করে, শিক্ষককেও পড়ানোতে সমস্যার সৃষ্টি করে। এর ফলশ্রুতিতে হতে পারে পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল, নিম্ন আয়ের চাকরী/বেকারত্ব, রুগ্ন স্বাস্থ্য ও সমাজে অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া।

শিশুদের মস্তিষ্কের নার্ভাস সিস্টেমে নিউরন থেকে নিউরনে সাইনাপ্সের (synapses) মাধ্যমে তথ্য পৌঁছে যায়। এভাবে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে একটা নেটওয়ার্ক তৈরি হয়।

চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট এক্সপার্ট গেইল গ্রস হাফিংটন পোস্টে লিখেছিলেন, এই নেটওয়ার্কের ফলে সৃষ্ট সংযোগ একটি শিশুর বুদ্ধিবৃত্তি, আচার-আচরণ, কথাবার্তা, হিসেব করার ক্ষমতা এবং সবচেয়ে বেশি তার নিজস্ব জগত সম্পর্কে ধারণা রাখা ও পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

শিশুরা যদি অন্য কিছু, যেমন বাবা-মার সাথে কথা বলা বা বাইরে খেলাধুলোর মত কাজ কম করে এবং শুধু একটা জিনিসের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দেয়, তাহলে মস্তিষ্কে অনেক “সংযোগ” সৃষ্টি না-ও হতে পারে।

সময়ের সাথে সাথে অব্যবহৃত সংযোগগুলো গাছের ডালের মতো কাটা পড়ে। সাইনাপসের এই কেটে সাফ হওয়ার ঘটনা (synaptic pruning) সবচেয়ে বেশি ঘটে চার বছর বয়সের আগে, যা আর কখনো আগের অবস্থায় ফিরে আসে না।

ভিডিও গেইমগুলোকে যত বেশি সম্ভব আকর্ষণীয় ও আসক্তি-সৃষ্টিকারী করার জন্য গেইম ডেভেলপাররা ডোপামিন ও এডরেনালিন হরমোন নিঃসরণের মাত্রা পরিমাপের মাধ্যমে পরীক্ষা করে নেয়। স্ক্রিন আসক্তি শিশুদের মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল কর্টেক্স (frontal cortex) এর বিকাশকে বাধা দেয়, যা শিশুর সামাজিকীকরণে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

পেন্টাগন আর ইউ.এস নেভির এডিকশন রিসার্চের হেড ড. এন্ড্রু ডোন ভিডিও গেইমসের উপর ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছেন। তিনি বলেন, আজকের গেইমগুলো হলো মাল্টি বিলিওন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি, যা যত বেশি সম্ভব আসক্তি-সৃষ্টিকারী করার জন্য শ্রেষ্ঠ নিওরোসায়েন্টিস্ট আর মনোবিজ্ঞানীদের নিয়োগ দেয়। ভিডিও টেকনোলজি দ্বারা সৃষ্ট নিওরোবায়োলজিক্যাল এফেক্ট সম্পর্কে বোঝাতে তিনি টিভি/মোবাইল/ট্যাব ইত্যাদির স্ক্রিনকে বলেন “ডিজিটাল ফার্মাকিয়া” (ফার্মাসিউটিক্যালের গ্রিক শব্দ ফার্মাকিয়া)।

বর্তমানের ভিডিও গেইমস অত্যন্ত উত্তেজনাকর হয়ে থাকে। এসব গেইমস খেললে শিশুর ডোপামিন ও এড্রেনালিন হরমোনের নিঃসরণ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। গবেষনায় প্রমাণিত হয়েছে যে মাদকদ্রব্য গ্রহণের ফলে যে মাত্রায় এই হরমোন নিঃসরণ ঘটে, ভিডিও গেইমসের ক্ষেত্রেও তা একই মাত্রায় ঘটে। এটা কোকেইন বা মরফিনের চাইতেও ক্ষতিকর।

ভেবে দেখুন, আপনার সন্তানের হাতে ডিভাইস ধরিয়ে দিয়ে আপনিও হয়ে পড়ছেন না তো, ডিজিটাল ড্রাগ ডিলার?
_______________________

রেফারেন্স:
It’s ‘digital heroin’: How screens turn kids into psychotic junkies
https://nypost.com/2016/08/27/its-digital-heroin-how-screens-turn-kids-into-psychotic-junkies/amp/

The signs your child might have a screen addiction, revealed
https://www.independent.co.uk/life-style/child-screens-addiction-signs-symptoms-health-study-a8087851.html

People who are addicted to their phones and the internet have too much of a dangerous neurotransmitter
https://www.independent.co.uk/life-style/gadgets-and-tech/news/smartphone-internet-addiction-phone-imbalance-brain-anxiety-tiredness-study-research-a8084146.html

How Screen Addiction Is Damaging Kids’ Brains
https://www.vice.com/en_us/article/5gqb5d/how-screen-addiction-is-ruining-the-brains-of-children

Why children are more entitled than generations before
https://www.yourmodernfamily.com/less-patient-more-lonely/

Why did Bill Gates and Steve Jobs guard their kids from tech?
https://www.weforum.org/agenda/2017/10/why-gates-and-jobs-shielded-their-kids-from-tech

Is e-learning making your children dumb? Experts sound a warning
https://cna.asia/2AH8yDk

ভিডিও রেফারেন্স:
An experiment done with a pair of 4-year-old twins
https://youtu.be/KZ5YvSmX7io

Bill Gates didn’t let his kids have a mobile phone
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10155034575516479&id=7746841478

_________________________________________
বিঃদ্রঃ ডিভাইস আসক্তির প্রতিরোধ ও প্রতিকার নিয়ে থাকছে পরবর্তী পর্ব, ইনশাআল্লাহ্‌।
____________________________________

ডিজিটাল ড্রাগ
সিহিন্তা শরীফা

মে ০৪, ২০১৮ইং