বাবুর প্রথম খাবার

আমার মাতৃত্বের বয়স প্রায় তিন বছর আলহামদুলিল্লাহ্‌। এই তিন বছরে আমার কাছে সবচেয়ে বেশী যে বিষয়ে অন্য মায়েরা জানতে চেয়েছে তা হলো বেবী ফুড। ফেসবুকে আমার কিছু লেখালেখি অবশ্য এর কারণ। ফেসবুকের সেই লেখার অনেক ভালো ফিডব্যাক পাওয়ায় আজকের এই লেখা।

বাচ্চা খেতে চায় না – এটা কম বেশী মা’দের সাধারণ অভিযোগ। মূলত বাচ্চাকে খাওয়ানো নিয়ে বাবা-মা’র যুদ্ধ শুরু হয় বাচ্চাকে সলিড খাবার দেয়ার দিন থেকে। একটা বাচ্চার খাদ্যাভ্যাস অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। তবে সবার আগে আল্লাহর কাছে অনেক অনেক দোয়া করা উচিত যেন বাচ্চা সলিড ভালোভাবে খায়। সাথে বাচ্চার খাদ্যাভ্যাস যেন ভালো হয় ইনশাল্লাহ।

দোয়া করার পাশাপাশি আরেকটা দরকারী কাজ হলো নিজেকে প্রস্তুত করা। কেন প্রয়োজন? অনেক সময় দেখা যায় বাচ্চা না খাওয়া মাত্রই আমরা মায়েরা টেনশানে পরে যাই; সাথে জোরাজুরি তো আছেই। তাই সবার আগে নিজেকে রিমাইন্ডার দিতে হবে আমরা মায়েরা যেন কোনভাবেই টেনশান, জোরাজুরি এসব না করি। মনে রাখতে বাচ্চাকে সলিড খাওয়ানোর পুরা প্রসেসটা আল্লাহ্‌র রহমতের পাশাপাশি অনেক বেশী ধৈর্য্যের আর ট্রায়াল এন্ড এরোর ম্যাথডের উপর নির্ভরশীল।

প্রথম কথা হলো সলিড শুরু করার আগে অবশ্যই আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নেবেন। ডাক্তারের পরামর্শে ৪-৬ মাস বয়সের যেকোন সময় থেকে আস্তে আস্তে সলিড শুরু করা যায়। শুরু করার আগে দেখতে হবে বাচ্চার মধ্যে সলিড শুরু করার কোন লক্ষণ আছে কিনা।

যেমনঃ বাচ্চা দুধ খেয়েও পেট ভরছেনা; বাচ্চা হেলান দিয়ে বসতে পারে; বাচ্চা আপনার খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকে আর খেতে চায় ইত্যাদি। আলহামদুলিল্লাহ্‌, যাইনাবের সলিড শুরুর আগে অস্ট্রেলিয়ার এক বড় চিল্ড্রেন হাসপাতালের চাইল্ড স্পেশালিষ্টের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল।

সেই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আমি প্রথম সলিড শুরু করে দিনে এক বেলা করে খাওয়াতাম। এক সপ্তাহ পর দুই বেলা করে আর তারও ১০ দিন পর তিন বেলা করে সলিড দেওয়া শুরু করেছিলাম। আর যেকোন নতুন খাবার আমি পরপর কমপক্ষে তিনদিন দিতাম যেন এলার্জি বা হজমে সমস্যা হলে বুঝা যায়।
যাইনাবের এক বছর হওয়া পর্যন্ত ডাক্তারের পরামর্শে (সাথে নিজের টুকটাক রিসার্চের ফল ) কোনরকম লবন আর চিনি ব্যবহার করতাম না। লবন বাচ্চার কিডনীর জন্য ভালো না।

আর চিনি অনেক সময় বাচ্চার দাঁত ক্ষয়, চাইল্ড অবেসিটি ও ডায়াবেটিসের কারণ হয়। চিনির পরিবর্তে খাবার মিষ্টি করার জন্য আপনি চাইলে খেজুর, গাজর, মিষ্টি আলু ব্যবহার করতে পারেন। সলিড শুরু করার সময় সবচেয়ে বড় যেই ভয়টা কাজ করেছে আমার তা হলো চোকিং। এই ভয় দূর করতে ইন্টারনেট থেকে ভিডিও দেখেছিলাম চোকিং এর সময় বাচ্চাকে কিভাবে সাহায্য করতে হয় যা আমার অনেক উপকার করেছিলো। তাই এই ব্যাপারটা সবার জেনে নেওয়া উচিত।

সলিডের শুরুতে আরেকটা বড় সংশয় কাজ করে হোমমেইড ফুড নাকি দোকানের রেডি ফুড?? অতি অবশ্যই হোমমেইড ফুড অনেক দিক দিয়ে উপকারী। প্রিজার্ভেটিভ ছাড়া, নিজ হাতে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি খাবার অনেক উপকারী সাথে খরচের দিক দিয়েও সাশ্রয়ী।

আমি যদি বলি সময়ও বাঁচে অনেক তাহলে কি অবাক হবেন? বাচ্চার সলিড খাওয়ানোর সময়ে দেখলেন কেনা ফুড শেষ; এখনই দোকানে গিয়ে কিনে আনতে হবে। এর বদলে খাবার টেবিলের ফলের ঝুড়ি থেকে কলা বা অ্যাভোকাডো নিয়ে হাত বা কাঁটা চামচ দিয়ে স্ম্যাশ করে খাইয়ে দিন। ব্যস সময়, টাকা, কষ্ট সব দিক দিয়ে সাশ্রয়ী।

সময় বাঁচানোর আরও কিছু টিপস দেই। আজকাল এই যুগে মায়েদের ঘরে বাইরে অনেকসময় বাধ্য হয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। আমি নিজেও পিএইচডি করার পাশাপাশি এইসব টিপস কাজে লাগিয়ে সম্পূর্ণ হোমমেইড ফুড দিয়েছি আলহামদুলিল্লাহ্‌। পিউরি সহ অন্যান্য বেবী ফুড চাইলে কয়েকদিনের জন্য রান্না করে ডিপ ফ্রিজে সংরক্ষণ করা যায় (তবে ভাত, খিচুড়ি, ওটস এইগুলো প্রতিদিন রান্না করাই ভালো। )

একদম প্রথম যখন সলিড শুরু করি তখন আইস কিউব বক্সে অথবা ছোট ছোট বেবি ফুড স্টোরেজ বক্সে করে ফ্রিজ আপ করা যায়। যখন আস্তে আস্তে খাওয়ার পরিমান বাড়বে তখন একটু বড় বক্স ব্যবহার করা যায়।

বেবি ফুড স্টোরেজ করার জন্য সিলিকন ফ্রিজার বক্স অনেক কাজে দেয়। এই বক্সের সুবিধা হলো খুব সহজে ফ্রোজেন আইটেম বের করা যায় সাথে পরিষ্কার করতেও সহজ। খাবার জমে বরফ হয়ে গেলে বক্সে করে রেখে দিতে পারেন। সাধারণত হোমমেইড খাবার এক সপ্তাহের বেশি না রাখাই ভালো। এছাড়াও খিচুড়ির জন্য ৭দিনের হিসাব করে মুরগীর বুকের মাংস ধুয়ে ফ্রিজে প্যাকেট করে রাখলে প্রতিদিন খিচুড়ি রান্না সহজ হয়ে যায়। একইভাবে চাইলে ৫/৬দিনের সব্জিও কেটে ডিপে রেখে দিতে পারেন যেন খিচুড়ি রান্না সহজ হয়।

বাচ্চাকে স্ম্যাশ/ভর্তা করে খাওয়াবেন নাকি ব্লেন্ড করে তা আপনার বাচ্চার উপর নির্ভর করে। ব্লেন্ড করে খাওয়াতে অনেকেই নিষেধ করে কিন্তু অনেক বাচ্চা আছে যারা ব্লেন্ড করা ছাড়া ছাড়া খেতে পারেনা, কারণ খাবার গলা আটকে যায়। সেই ক্ষেত্রে প্রথমে ব্লেন্ড করে খাওয়ানো শুরু করে পর্যায়ক্রমে খাবারের ঘনত্ব বাড়িয়ে আস্তে আস্তে একটু আস্ত নরম খাবার খাওয়ানোর অভ্যাস করানো যায়।

হোমমেইড ফুডের ক্ষেত্রে আরেকটা ব্যাপার খেয়াল রাখতে হয়। বাচ্চার ফুড চার্টে যেন অবশ্যই দুধ, শাক-সব্জি, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট এর কম্বিনেশান থাকে। ৬ মাস হয়ে গেলে বাচ্চার আয়রন যুক্ত খাবার খুব দরকার। তাই চাইলে আয়রনযুক্ত সিরিয়াল দেওয়া যায় আর নয়তো আয়রন সমৃদ্ধ ফল বা সবজি যেমন আপেল, নাশপাতি, মটরশুটি, মিষ্টি আলু, মিষ্টি কুমড়া এমন অনেক কিছুই দেওয়া যায় পিউরি করে।

মায়েদের আরেকটা অভিযোগ আমি শুনেছি যে বাচ্চা খিচুড়ি না খেলে কি করা যায় তা নিয়ে চিন্তা। অনেক বাচ্চা আছে যারা খিচুড়ি পছন্দ করেনা। সেই ক্ষেত্রে ভাতের সাথে মুরগী-সব্জির তরকারী দেওয়া যায়। আমি বিভিন্ন কম্বিনেশানে বাচ্চার জন্য তরকারি রান্না করতাম যেমনঃ বিভিন্ন সবজি দিয়ে চিকেন, কিংবা লাউ দিয়ে মুরগী এমন বিভিন্ন ভাবে যাইনাবের জন্য অল্প মসলার ঝাল ছাড়া তরকারি রান্না করতাম।

এইভাবে তরকারি রান্না করে দুইদিন ফ্রিজে রেখে ফ্রেশ রান্না ভাত দিয়ে খাওয়ানো যায়। আমি অন্যান্য বেবী ফুডও রান্না করে দিতাম যেমন আপেল-চিকেন স্টিম করে স্ম্যাশ করে দিতাম, কিংবা ৮মাস থেকে বেবী বিরিয়ানি করে দিতাম হালকা মসলা দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ্‌।

এত চেষ্টার পরও যদি বাচ্চার খাওয়া নিয়ে অনেক পরীক্ষা দিতে হয় তাহলে মনে রাখতে হবে সবার রিযিক নির্দিষ্ট। আপনি কাউকে রিযিকের বাইরে কিছু খাওয়াতে পারবেন না। চেষ্টা ও দোয়া চালিয়ে যান ইনশাল্লাহ রেজাল্ট এই পৃথিবীতে না পেলেও আখিরাতে নিশ্চিত।


বাবুর প্রথম খাবার
– নাঈমা আলমগীর