মাতৃত্ব

ডেলটা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওটিতে ঢুকতেই কোরআন তিলাওয়াতের সুমধুর ধ্বনি শুনতে পেলাম, মুহূর্তেই মনটা ভালো হয়ে গেল, এন্যাস্থেশিওলজিস্ট স্যার ওটি বেডের মাথার কাছে রাখা টুলের উপর বসে কোরআন পড়ছিলেন,

যদিও 2nd issue তবুও একটু একটু ভয় পাচ্ছিলাম, ওটি বেডে বসলাম, একটু পর spinal cord এ anesthesia দিয়ে দিল (ওহ, এই প্রক্রিয়াটা খুব ভয়ানক )

তারপর শুয়ে শুয়ে সব দেখছিলাম, ইন্টার্নীর কিছু ছেলে মেয়ে অপারেশনের ট্রে সাজাচ্ছিল, ঠিকমত সাজানো হয়নি বলে এক মেয়েকে ডাক্তার ম্যাডাম ঝাড়ি দিয়েছে, মেয়েটা পাংশু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে, আমার কেন যেন মেয়েটার জন্য খারাপই লাগছিল।

একটু পর শুচি ম্যাডাম এসে ঢুকলেন, ‘সুমনা’ বলে জোরে ডাক দিলেন, আমি হাসলাম,আলো জ্বলে উঠল, আমার মাঝ বরাবর একটা পর্দা সব আড়াল করে দিল,

আমি দোয়া পড়তে শুরু করলাম, একটু উৎকণ্ঠা কাজ করছিল, pregnancy তে growth restriction ধরা পড়েছিল, ও সুস্থ হবে তো ? weight 2.5kg হবে তো?

আল্লাহ্‌, incubator এ যেন রাখতে না হয়, কোন complexity যেন তৈরি না হয়,দোআ ইউনুস আর কালিমা পড়ছিলাম..

একেকটা সেকেন্ড যেন একেকটা কাল……
আর কতক্ষণ………
কখন শুনতে পাব……
.
.
.
তারপর একটা ধ্বনি……প্রতীক্ষিত কান্নার আওয়াজ…কান্নার আওয়াজ এত মধুর……মনে হচ্ছে হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নেই, কী নাড়ির টান ………কত মায়া, কত ভালোবাসা না দেখা একটা ছোট্ট মানুষের জন্য, নয় মাস যার আমার ভিতরে বসবাস, হঠাৎ যেন ছিন্ন হলো………

ইন্টার্নি মেয়েগুলো ফিসফিস করছে, “আরিফ স্যারের মেয়ে হয়েছে…”

পুরো অপারেশন শেষ হতে আরো সময় লাগল, তারপর পোস্টঅপারেটিভ রুমের বিছানায়,

পাশে ছোট্ট মেয়েটা……কী মায়াবী নিষ্পাপ মুখ, ছোট্ট ছোট্ট চোখ, একটু একটু করে তাকায়, ঠোঁট নাড়িয়ে ক্ষুধার কথা জানান দেয়, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কী অদ্ভুত সুন্দর সৃষ্টি, আমার চোখ সরছে না, আমি দেখছি আর হাসছি…কৃতজ্ঞতার হাসি……আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়ার হাসি।

“আরে মা তো হাসছে, খুব expected baby মনে হচ্ছে?” বাবুকে চেক করতে আসা শিশু বিশেষজ্ঞ বললেন।

মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া আল্লাহ্‌ সুবহানা তায়ালার এক বিশাল নিয়ামত, দীর্ঘ নয় মাস কষ্টের পর অপারেশনের কষ্ট, তবুও সব ছাপিয়ে এক বেহেস্তি আনন্দ যেন আমাকে আবিষ্ট করে রেখেছিল আর মুখে এক চিলতে হাসি এনে দিয়েছিল……

যার মুখ দেখে হেসেছিলাম, সে হলো আমার দ্বিতীয় কন্যা মারইয়াম ফারিহা।
…………………………………………………………………..

আজকে মারইয়াম কে নিয়ে প্রতিবেশীর শিশুপুত্রকে দেখতে গিয়েছিলাম।

সিজারিয়ান পেশেন্ট, তবুও মায়ের মুখে সেই এক চিলতে বেহেস্তি সুখের হাসি দেখে আমি পুলকিত হলাম…

আমার পরিচিত অনেক নিঃসন্তান বোনদের দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখেছি, তাদের করুণ মুখ গুলো আমাকে কষ্ট দিয়েছে

সেই বোনদের মুখে আল্লাহ্‌ যেন এইরকম বেহেস্তি হাসির ব্যবস্থা করে দেন সেই দোআ করি…

সন্তান থাকা না থাকা দুইটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। ঈমানের ৬ নাম্বার পিলার হল – তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস।

তাকদীরের ভালো বা মন্দের নিয়ন্ত্রণকর্তা মহান আল্লাহ। যে ব্যক্তি ঈমান আনে অর্থাৎ একজন ‘মুমিন’ বিশ্বাস করে, আমার উপর যা কিছু ভালো বা মন্দ সব কিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত।

আর যাই আসুক না কেনো, আমাদের ভালো লাগুক বা খারাপ লাগুক, পরিণামে (হয় দুনিয়াতেই অথবা আখেরাতে) তা আমাদের জন্য উপকার নিয়ে আসবে, আর সেজন্য আপাতত সেটা তার ভালো না লাগলেও সে আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট থাকে – এটাই হলো তাকদীরের প্রতি বিশ্বাসের বাস্তবতা।

আল্লাহ একেকজনকে একেকভাবে পরীক্ষা করেন, কাউকে ধন-সম্পদ বা সন্তান-সন্ততি দিয়ে পরীক্ষা করেন আবার কাউকে এগুলো না দিয়ে পরীক্ষা করেন।

“নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব আল্লাহ তা’আলারই। তিনি যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা-সন্তান এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে পুত্র ও কন্যা সন্তান উভয়ই দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল।”
(সুরা আশ-শূরাঃ ৪৯-৫০)

—————————–
মাতৃত্ব
ড. উম্মে বুশরা সুমনা