মা হওয়া ১: সন্তান চাওয়ার সিদ্ধান্ত

’বাচ্চা নেয়া’ কথাটা আমার খুব অশ্লীল লাগে। কথাটা শুনতেই চোখের সামনে এমন একটা দৃশ্য ভেসে আসে—ঝাঁকা ভর্তি বাচ্চা নিয়ে ফেরিওয়ালা বাড়ি বাড়ি ফেরি করছে, ইচ্ছুক মা বাবারা সেখান থেকে ঘাড়ে ধরে একটা দুইটা বাচ্চা নামিয়ে নিচ্ছে।

শব্দমালাটা সন্তানের মত পৃথিবীর অন্যতম সেরা উপহারকে যেমন অপমান করে, তেমনি একটা মিসগাইডেড সেন্স অফ সিকিউরিটি দেয়–আমরা যখন ইচ্ছা তখন ফেরিওয়ালা ডেকে একটা বাচ্চা নামিয়ে নিতে পারি।

’জন্ম নিয়ন্ত্রন’ কথাটাকেও সেরকম ভুল বুঝার সম্ভবনা আছে। ’নিয়ন্ত্রন’ মানে কমানোর দরকার পরলে কমাতে পারা আর বাড়ানোর দরকার পরলে বাড়াতে পারা। আমরা মানুষেরা সন্তান সংখ্যা ইচ্ছামত কমাতে পারাটা শিখে গিয়েছি (আসলে হাজার বছর ধরেই মানুষ জানে কিভাবে সংখ্যা কমাতে হয়), কিন্তু সন্তান সংখ্যা কমানো ঠিক যতটা কম খরচে, নির্ঝঞ্জাটে, সহজে সম্ভব, সন্তান চাইলেই যারা পায় না, কিংবা পেতে গিয়ে কিছুটা ভুগে তারা বুঝে এ দু’য়ের পার্থক্য কাঁচা ডিম সিদ্ধ করে আবার সেই সিদ্ধ ডিম কাঁচা করার চেষ্টার মত!

যেহেতু বাচ্চা ’নিতে’ চাইলেই সব সময় ’নেওয়া’ যায় না, সে জন্য আমি ’সন্তান চাওয়া’ বলতে পছন্দ করি। একটা সময় বিয়ে করলেই মানুষ সন্তান চাইবে সেটাই স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু এখন জীবনে এত ভ্যারিয়েবল এসে ঢুকেছে, যে সন্তান চাওয়ার সিদ্ধান্তটাও আলাদা করে নিতে হয় (পৃথিবীর অনেক জায়গায় এখন সন্তান চাইতে গেলে বিয়েও করতে হয় না!)।

অনেক সময় বাস্তবতার জন্যই সম্ভব হয় না। বিয়ের পর পরই সুদীর্ঘ দশ মাস আমি আর নও দুই দেশে থেকেছি দু’জন দু’জনকে মুখোমুখি না দেখে। সেই সময়টায় আমরা দু’জনই ভীষণ ব্যস্ত ছাত্র, অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রায় পুরাপুরি পরিবারের উপর নির্ভরশীল। সেই সময়ে যদি আল্লাহ সন্তান দিতেন, তাহলে সন্তানকে পার্থিব এবং আত্মিক, দুই দিক দিয়েই বঞ্চিত করতে হতো। এটা বাস্তবতা!

বাস্তবতাকে তো মানতেই হবে, কিন্তু অনেক সময় সত্যিকারের সততার সাথে হিসাব করলে অনেক বাস্তবতার সাথে কম্প্রোমাইজ করা যায়। এবং এই হিসাবটা নিজের করতে হয়। আমার একজন বান্ধবী বিয়ের পর থেকে জোরে সোরে টাকা জমানো শুরু করেছে বাড়ি করবে বলে। ও আর ওর স্বামী দিন রাত খেটে যায়, দু’জন দু’জনের মুখ দেখে না, ব্যাংক ব্যালেন্স উঁচু করে আর বিয়ের পাঁচ বছর পার হওয়ার আগে সন্তানের কথা ভাবতেও পারে না… বাড়ি না কিনে কিভাবে সন্তানের কথা ভাববে? আমার ধারণা এরকম ব্যাপারের সাথে কম্প্রোমাইজ করাটা কঠিন না, কিন্তু জীবনটা যেহেতু ওরই, হিসাবটা ওরই করতে হবে।

আবার অনেক সময় স্বামী স্ত্রী দুই জনের মধ্যে ’সন্তান চাওয়ার সঠিক সময়’ সম্পর্কে বিশাল মতপার্থক্য থাকে। মেয়েদের খুব বিচ্ছিরি একটা বাস্তবতা হচ্ছে শরীরের সীমাবদ্ধতা।

ছোট্ট একটা পরিসংখ্যান দেই: ২৮ বছর বয়সে কেউ মা হতে চাইলে পুরাপুরি নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে সব কিছু হয়ে যাওয়া সম্ভব হয় মাত্র ৭০ শতাংশের। ৪২ হতে হতে মাত্র ২৭ শতাংশ সুস্থ, স্বাভাবিক প্রেগনেন্সি পায়। ছেলেদের জন্য কিন্তু এই ’জৈবিক জানালাটা’ এত ছোট না। পঞ্চাশ বছর বয়সেও দিব্যি ঝামেলা ছাড়া বাবা হয়ে যেতে পারেন বেশির ভাগ পুরুষই।
স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সন্তান চাওয়ার সময়ের ব্যাপারে মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা খুব কাজ করে।

যেহেতু ২৮ বছর বয়সে সদ্য গ্র্যাজুয়েট করা একটা ছেলের চোখে জীবন তখন মোটে ’শুরু’, সে ভাবতেও পারে না, তার সমবয়সী স্ত্রী অনায়েসে সেই ৩০ শতাংশ মেয়ের মধ্যে পরে যেতে পারে যাদের জীবনে সন্তান খুব সহজে আসে না। শুধু তাই না, যত দিন যায়, এই হার তত বেড়ে যায় (মাত্র চোদ্দ বছরে ৪২ শতাংশ…)।

এক্ষেত্রে আসলে আমাদের প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বাস্তবতার তিতা ট্যাবলেট গুলে খাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

অনেক সময় সন্তানেরা পৃথিবীতে আসলে আস্তে আস্তে অনেক কিছু আগে যেগুলোকে কঠিন মনে হতো, সেগুলোও সহজ হয়ে যায়। সব হিসাব আসলে মিলবেও না, সব হিসাবের ভার নিজের কাঁধে নিলে জীবনও কঠিন হয়ে যাবে। তাই ভারী ভারগুলো আল্লাহর হাতে তুলে দিলেই ভালো।

যেই সময়টা নিজের কাছে ’পারফেক্ট’ সেই সময়টাতে যে সন্তান চাইলেই পাওয়া যাবে, তার কোন গ্যারান্টি নেই। সন্তানেরা ’চোখের শীতলতা’ হতে পারে, ’সদকায় জারিয়াহ’ হতে পারে, দুনিয়া আখিরাত দুই জায়গাতেই খুব ভালো বন্ধু হতে পারে। এই আশা থেকেই হতে চাইতাম মা, কিন্তু ভয় যে পাই নি, তা তো না। এই ভয় থেকে নিরাপদ অনুভব করার উপায় একটাই খুঁজে পেয়েছিলাম: আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে দোআ করা, যেন আল্লাহর কাছে যেই সময়টা ভালো মনে হয়, সেই সময়টাতেই তিনি দিয়ে দেন সন্তান।

আমার খুব কাছের একাধিক মানুষেরা সন্তান খুব চেয়েও পাচ্ছেন না। ঠিক বয়সেই আল্লাহর কাছে চেয়েছেন, লাইফ স্টাইলও উল্টা পাল্টা না, শরীর স্বাস্থ্য সুস্থ, কিন্তু তবু পাচ্ছেন না। ওদের যে কি ভীষণ কষ্ট, প্রতিদিনের জীবনটা কি ভীষণ ভারি, পুরাপুরি অনুভব করতে পারি না, কিন্তু যতটুকু পারি, তাতে নিজে মা হতে পেরে কেমন একটা অপরাধবোধ হয়!

যারা সন্তান চাওয়ার সময়টা নিয়ে দেরি করে ফেলেন, তারা অনেক সময় এধরণের মানুষদের কাছ থেকে দেখলে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন। আবার অন্য দিকে, এ ধরণের পরিস্থিতিতে একবার পরে গেলে মানুষ নিজেকে ’অপূর্ণ’ ভাবা শুরু করেন, তেমনটা ভাবারও কোন যুক্তি নেই।

আয়েশা (রা) কে আল্লাহ সন্তান দেন নি, অথচ তিনি রাসুলের ভীষণ প্রিয় স্ত্রী ছিলেন, তাঁর বদৌলতে পেয়েছি আমরা অনেক কিছুই। আল্লাহ প্রতিটা মানুষকে এক একটা উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্টি করেন, হতে পারে সন্তান না দেয়ার কারণ আল্লাহ জানেন তারা চাইলেই তাদের জীবনের সময়টাকে আরও অনেক মূল্যবান কোন কিছুতে দিতে পারবেন!

সন্তান চাই না চাইনা করে অনেকে এত দূর যান যে সন্তান পেটে চলে আসার পরেও অ্যাবরশনের কথা চিন্তা করেন। কেউ ধর্ষিতা হলে তা আলাদা কথা, কিন্তু যখন সেরকম কোন ব্যাপার থাকে না, তখনও অনেকে খুব তুচ্ছ সব কারণে অনায়েসে অ্যাবরশনের কথা ভেবে ফেলেন।

আমার মা খুব অল্প বয়সে, আমার ভাইয়ের সাথে সময়ের খুব অল্প ব্যবধানে আমাকে গর্ভে ধারণ করে ফেলেছিলেন। সেই সময় মা বাবা দু’জনেই বিদেশে, সব ধরণের সাপোর্ট থেকে অনেক দূরে। সেই সময়ে অনেক ’শুভাকাংখী’ পরামর্শ দিয়েছিলেন আমাকে ’ফেলে’ দেয়ার।

আলহামদুলিল্লাহ মা তা করেন নি। আখিরাতের হিসাব বাদ দিয়ে শুধু দুনিয়ার হিসাব করলেও সেই কাজটা না করে তিনি ঠকেন নি।

আসলে শারিরীক এবং মানসিক দিক দিয়ে মা হওয়ার জন্য যেই সময়টা সবচেয়ে ভালো, সেই সময়টাই আবার ক্যারিয়ার গঠনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। যাদের ক্যারিয়ারের দিকে বেশি একটা আগ্রহ নেই তাদের কথা আলাদা। কিন্তু অনেক মেয়েরাই ক্যারিয়ারের বাড়তি চ্যালেঞ্জ পছন্দ করে। আমি চ্যালেঞ্জ পছন্দ করি, তাই আমার পড়াশোনা, চাকরি দুইটাই খুবই ভালোবাসি।

কিন্তু নায়ীমা এসে গেল পিএইচডির ফাইনাল ইয়ারের আগে দিয়ে। সুপারভাইজারকে বলতে বেশ কষ্ট হলো! হাজার হোক, ওর কাছে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কানাডায় যেই কাজগুলো করেছি সেগুলো থেকে দুইটা পেপার এক্সেপটেড হলো দুইটা কনফারেন্সে। একটা হচ্ছে বস্টনে। প্লেন ভাড়া, হোটেল ভাড়া, সবই দিবে ইউনিভার্সিটি। কিন্তু ততদিনে আমি সাত মাসের অন্ত:সত্ত্বা, সেই অবস্থায় চব্বিশ ঘন্টা প্লেইনে চড়ে বস্টনে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না! বুকে পাথর বেঁধে না করে দিলাম।

তারপর আছে চাকরি। সুদীর্ঘ আড়াই বছর চাকরি করছি ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চ এসিসটেন্ট হিসেবে। আমাদের ইউনিটে আগে ছিল দুই জন। ভিকি আর আমি। ভিকির স্বামী হার্ট অ্যাটাক করায় ও হঠাৎই লং সার্ভিস লীভে গেল। দ্বিতীয় জন আমি ছিলাম, সুতরাং স্বাভাবিক নিয়মেই ওর জায়গায় আমার যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তখন যে নায়ীমা পৃথিবীতে আসবো আসবো করছে! শূন্যস্থান পূরণ করতে আরেকটা মেয়েকে নেয়া হলো, যার যোগ্যতা আমার চেয়ে মোটেই বেশি না, কিন্তু ও যেহেতু ইউনিটের বিপদের সময় হাল ধরবে, ওর বেতন বছরে আমার চাইতে বিশ হাজার ডলার বেশি হয়ে গেল।

চিনচিনে একটা কষ্ট নিয়ে সেদিন বাসায় ফিরলাম! তারপর হিসাব করে দেখলাম, মা হচ্ছি মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে। আগামী দশ বছরও যদি পার্ট টাইম কাজ করি, তারপরেও বয়স পঁয়ত্রিশ হবে। যদি রাসুলের উম্মত হিসেবে তেষট্টি বছরও বাঁচি, তাহলে কিন্তু বাচ্চাকাচ্চা একটু বড় হয়ে গেলেও প্রায় তিরিশ বছর পাচ্ছি ক্যারিয়ার গড়তে এবং উপভোগ করতে। আলহামদুলিল্লাহ, এই দশ বছরে আমি ইনশাআল্লাহ জীবনে যা পাবো, ক্যারিয়ারে একটু পিছিয়ে পড়ার সাথে তুলনা করতে গেলে সেই সময়টা কিছু না! তাছাড়া যেই মেয়েটা এখন একটু এগিয়ে গেল, আর পাঁচ/দশ বছর পরে তো ওকেই আবার থামতে হবে সন্তানদের জন্য। সেই সময়টায় তো আমার আবারও এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ আসবে!

দুনিয়া আখিরাতের পরিপূর্ণ প্রশান্তির জন্য কোনটা বেশি লাভজনক, সেটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল! আমি খেয়াল করেছি আখিরাত ব্যাপারটা ইকুয়েশনে চলে আসলে অনেক কিছুর হিসাব করা সহজ হয়ে যায়!

————————————————-
মা হওয়া ১: সন্তান চাওয়ার সিদ্ধান্ত

সাদিয়া হোসাইন