মা হওয়া ৭: টিভি দেখা, না দেখা

আমাদের বাসায় টিভি না রাখা (কিংবা না ছাড়া) এবং টিভি/ইউটিউব/আইপ্যাড/স্মার্টফোন এসব আমাদের মেয়েটার দৈনন্দিন জীবনের অংশ না করার সিদ্ধান্তটা
নিয়েছিলাম ইউ টিউবে ছোট্ট একটা ভিডিও দেখে।

যার মূল কথা হচ্ছে, বক্তা বললেন, ছোট বেলা থেকে টিভি দেখলে মানুষের ব্রেইনের সার্কিটগুলো পার্মানেন্টলি বদলে যায়, তাই দুই বছরের নিচে কোন টিভি দেখাদেখি উচিত না, এর পরেও ‘লিমিটেড’।

টিভিতে বাচ্চাদের প্রোগ্রামগুলোতে অনেক রং, খুব দ্রুত সীন বদলায়, যেগুলো বাস্তব জীবনে হয় না। ফলশ্রুতিতে আমরা একটা ‘বোরড’ প্রজন্ম তৈরি করছি, বাস্তব জীবন যাদের জন্য টু স্লো। এই লাইনের কিছু একাডেমিক পড়াশোনা আছে, তাই আর্লি প্রোগ্রামিং একজন মানুষের পরবর্তী লাইফস্টাইল, চিন্তার ধরন, জীবনের ছোট খাট সিদ্ধান্ত নেয়ার পদ্ধতি কতটা বদলে দিতে পারে সে সম্পর্কে কিছুটা ধারনা ছিলো।

তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, টিভি বা ইউটিউব আমাদের প্রতিদিনের অংশ হবে না। মেয়ে বড় হয়ে নিজের জন্য কি পথ বেছে নিবে, তাতে আমার হাত নাই। কিন্তু ছোট বেলার জীবনটা গড়ে দেয়ার জন্য তো আল্লাহ আমাকে বেছে নিয়েছেন।

সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম প্রায়ে তিন বছর আগে। এবার এ তিন বছরের অভিজ্ঞতা বলি।

খেয়াল করলাম, মায়েরা মূলত টিভি/ ইউটিউব দেখানো শুরু করেন ৮/৯ মাসে বাচ্চারা যখন প্রথম খাওয়া দাওয়া নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা শুরু করে। ইউটিউব ছেড়ে দিলেই টপটপ গিলে ফেলে।

আমার মেয়েটাও স্বেচ্ছাচারিতা শুরু করল সময় মত। কিন্তু এই পথে পা দিলাম না। কারন দেখলাম একই মন্ত্র বেশিদিন কাজ করে না। সেই মন্ত্র বদলাতে হয়ই। তাতেও অনেক বেশি লাভ যে হয় তা না। একটা এক সপ্তাহের অসুস্থতাই বাচ্চাদের স্বাস্থ্যকে দুই মাস পিছিয়ে দেয়। কি কাজে লাগলো তাহলে অত সব কারসাজি?

খাওয়ানো শুরু করলাম দুআ পড়ে, আর মেয়ের বুকের হাড্ডি গোনার সময় নিজেকে মনে করিয়ে দেই, ‍পৃথিবীর অনেক ভালো মানুষেরা ছোটবেলা এমন স্বাস্থ্যের ছিলো! আল্লাহ যেন ওকে সুস্থ রাখে!

খেয়াল করলাম, আরেকটু বড় হলে, মোটামোটি দুই বছর হতেই টিভি, ইউটিউব বা স্মার্টফোন এপ মানুষ তিনটা কাজে ব্যবহার করে।

*এক, একটু খানি সময় কেনা।

আমাদের সময়ের মায়েদের বাচ্চা বড় করার একটা বড় অংশ নিজের করতে হয়, চারিদিকে সাহায্যের হাত খুব বেশি নাই, সে সময়টায় ইউটিউব বা টিভি ছেড়ে দিয়ে একটু খানি কাজ সারার লোভ অনেক বড় লোভ!

বাচ্চাকে রাত জেগে দুধ খাওয়ানো, চাকরি, ঘরের কাজ, পিএইচডির থিসিস লেখা, একটা সময়ে আমি সব এক সাথে করেছি, তাই জানি, বাচ্চারা স্বার্থপর, বুঝতে পারে না মায়ের কখন আর চলার মত একটুও শক্তি নাই বা তখনি হাতের কাজটা সারা দরকার। মাঝে মাঝে বাধ্য হয়ে মেয়ের হাতে নিজের ফোনটা তুলে দিয়েছি, স্বীকার করছি। কিন্তু ফোনে কিছু লিমিট রেখেছি সবসময় আলহামদুলিল্লাহ।

প্রথমত, ইউটিউব দেই নি।

দ্বিতীয়ত, ভিডিও দেখাতে হলে কেবল আগের করা ওর নিজের ভিডিওগুলো দিয়েছি, যেগুলো স্মৃতিচারনের মত আর দ্রুত রং, সীন বদলানোর ব্যাপারটা নেই।

তৃতীয়ত, হাতে দেয়ার সময় এলার্ম দিয়ে দেই, ৫ মিনিটের বা আরেকটু বেশি। ও জানে এলার্ম বাজলেই মাকে ফোন দিয়ে দিতে হবে।

চতুর্থত, কোন “শিক্ষামূলক” এপ ইন্সটল করে দেই নি, শুধু ছবি আকার জন্য ডুডলের মত একটা এপ দিয়েছি। এটার পিছনে চিন্তা ছিল একটা আর্টিকেল যাতে টেক্নলজি শুধু কনজিউম করা আর ‘কাজে’ ব্যবহার করার মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেছে। আমি চাই না আমার মেয়ে শুধু কনজিউমার হোক!

*দুই, বোরড বাচ্চাকে রিলিফ দেয়া।

মেয়ের ছোট বেলা থেকেই আমি চাইতাম বাসায় থাকলে ওকে সময় দিতে। কাজগুলো করার সময় ওকে নিয়ে করার চেষ্টা করি। হাঁটতে শিখার পর থেকে বাইরে হাঁটতে নিয়ে যেতাম। রেইনকোট কিনেছি বৃষ্টি চেনাতে। গাদা গাদা বই কিনেছি, আমার বেতনের একটা বড় অংশ ওদিকে চলে যাচ্ছে দেখে সেকেন্ড হ্যান্ড বই কেনা শুরু করলাম।

ঘরে খেলার জন্য ব্লকস ইত্যাদি। ওকে কিভাবে ব্যস্ত রাখি, সেটা আরেকটা পোস্ট হতে পারে, কিন্তু আস্তে আস্তে খেয়াল করলাম, এগুলো স্বাভাবিক সময়ে কাজে লাগে, কিন্তু অস্বাভাবিক সময়ে না! একবার মেয়েকে হাসপাতালে এক ঘরে বন্দী থাকতে হলো টানা এক সপ্তাহ, হাতে ক্যানুলা! সব নিয়ম ভাংতে হয়েছিল ওই কয় দিনে।

আর বাংলাদেশ! মেয়ের বাবা ছাড়া ৫ সপ্তাহ! ঢাকার ফ্ল্যাট, মানেই সূর্যের আলো ঢুকে না, বাসা থেকে বের হয়ে খেলার মত সবুজ ঘাস নাই। ওর নিয়মিত খেলনাগুলো নেই! সুবাহানাল্লাহ, এক বই মানুষ কতবার পড়তে পারে! তখন বুঝেছি, বাচ্চাদের অন্টারনেটিভ না দিতে পারলে বাচ্চারা তো টিভি দেখবেই!

তারপরেও সে সময় আমার আড়াই বছরের মেয়েটা খেলা উদ্ভাবন করে নিত আলহামদুলিল্লাহ। প্রথম দিন সিএনজি চড়ে এসে, লেপ বালিশ দিয়ে শুধু ‘সিএনজিজি’ বানাতো। তখন মনে হয়েছে, বাচ্চাদের অল্টারনেটিভ দেয়া না হলে ওরা পথ তৈরি করে নেয়।

তখন আরেকটা কথা খুব মনে হত… গাজ্জার বাচ্চাগুলোর শৈশব কেমন? আর সিরিয়ার রিফিউজি ক্যাম্পে! সুবহানাল্লাহ, এক্ষেত্রে কি করা যায় আমি জানি না। আমি আমার জামাইকে সবসময় বলি আমাদের খুব হাইফাই কোথাও থাকার দরকার নাই। আমাকে শুধু এমন জায়গায় রেখো যেন আমার মেয়েটা দৌড়াতে পারে, ঘাসের গন্ধ নিতে পারে, পাখির ডাক শুনতে পারে। আল্লাহ যেন আমাদের এই তৌফিক দেন আর আমাদের বাচ্চাদের সুস্থ্য শৈশব দেন।

*তিন, শিক্ষামূলক কিছু শিখানো।

এই ব্যাপারটা অনেক আধুনিক বাবা মায়ের মধ্যে দেখলাম। কিন্তু আমার নিজের পড়াশোনা থেকে এবং কিছু পর্যবেক্ষন থেকে আমার খুব মনে হয় শিশুরা এপ বা কার্টুন থেকে অনেক শিক্ষামূলক কিছু শিখে বিশাল পন্ডিত হয়ে যায় না।

হ্যাঁ, ওরা এক একজন ইনফরমেশনের ঢিপি হয়ে যায়। এবিসিডি, কখগঘ, ১২৩৪, নানা রকম এলিয়েনের গল্প, সুপারহিরোদের গল্প, ফিরাউনের গল্প, ইউনুস (আ) এর গল্প, কয়েকটা সূরা, হিন্দি বাংলা ইংলিশ গান, সবই জানে। কিন্তু ইনফরমেশন জানা আর জ্ঞানী হওয়ার মধ্যে যে বিশাল ফারাক, তার সবচেয়ে বড় উদাহরন তো আমাদের প্রজন্মই!

গুগল সার্চের বদৌলতে অনেক ইনফরমেশন আমাদের আংগুলের ডগায়, কিন্তু তাই বলে কি আমরা সত্যিই জ্ঞানী মানুষ? ইনফরমেশন = জ্ঞান না, বরং জ্ঞান = ইনফরমেশন প্লাস এটিচুড, আদব, ইনফরমেশনের সঠিক ইন্টারপ্রিটেশন।

দ্বিতীয়টা কেবল সরাসরি গাইডেন্স দিয়েই সম্ভব, টিভির সামনে বসিয়ে দিয়ে না। আমি জানি আমার আদব, এটিচুডে ইনেক ঘাটতি আছে, কিন্তু নিজের যা আছে, অন্তত ততটুকু দেয়ার চেষ্টা করি, আল্লাহ যেন বাকিটুকু পূর্ণ করে দেন।

সঠিক ইনটারপ্রিটেশন্টা ছোট বেলা থেকেই দরকার। মেয়েকে গল্প বলার সময় কিংবা কয়েক দিন পর ও ওই গল্প নিয়ে অদ্ভূত সব প্রশ্ন করে। জানি ও একা একা কিছু দেখে শিখতে নিলে এই সুযোগটা পেত না। তাই ইচ্ছা আছে, আরেকটু বড় হলে আস্তে আস্তে ভালো কোন মুভি বা ডকুমেন্টারি মেয়েকে নিয়ে একসাথে দেখা, যেন প্রশ্নগুলো সাথে সাথে করতে পারে। আল্লাহ যেন আমার সময়ের বারাকাহ দেন।

আল্লাহ জানেন দৈনন্দিন জীবনে টিভি না রাখার সিদ্ধান্ত আসলে শেষমেষ কতটুকু ঠিক প্রমানিত হবে, তবে আপাতত আমি নিজের পড়াশোনা থেকে যা ভালো মনে হয়েছে তাই করছি।

জানি এক একজন বাবা মায়ের নিজেদের সিদ্ধান্তের পিছনে অনেক কারন থাকে, অনেক দিক দিয়ে হাত পা বাঁধা থাকে। তাই এও জানি, অনেকে অনেক রকম শৈশব পার করেও জীবনের পরীক্ষায় এগিয়ে যায়। দরকার শুধু আল্লাহ এর উপর ভরসা করে নিজের বেস্ট চেষ্টাটুকু করার। আল্লাহ নিশ্চয় সঠিক নিয়তে কেউ চেষ্টা করলে, তার উত্তম প্রতিদান দেন।

———————————————

মা হওয়া ৭: টিভি দেখা, না দেখা

সাদিয়া হোসাইন