মা হওয়া -৪ চাকুরীজীবি মা

অনেক মায়েরা বাচ্চা হওয়ার পরে চাকরি ছেড়ে দেন, পড়াশোনা ছেড়ে দেন। অনেকে ছাড়েন না। কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ সেই আলোচনায় না গিয়ে শুরু করি এভাবে যে, অনেকের জন্য নানা কারণে সেসব সম্ভব না। আমার জন্য সব ছেড়ে দেয়া সম্ভব ছিল না। মেয়েটার জন্মের পরে ছয় মাস ছুটি নিয়েছিলাম, তারপরে আবার চাকরিতে ফিরেছি সপ্তাহে দুই দিন করে। আল্লাহর কাছে দোআ করি, কখনও যেন এমন পরিস্থিতির তৈরি না হয় যার জন্য আমাকে ফুল টাইম চাকরি করতে হয়, আমার বাচ্চা(রা) ছোট থাকা অবস্থায়।

ছয় মাস ছুটির শেষের দিকে খুব অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম সপ্তাহে দুই দিন বাসায় না থাকার কথা ভেবে। অনেক গল্প শুনেছি চাইল্ড কেয়ারের। যদিও নিয়ম কানুন অনেক কড়াকড়ি, তবু এখানে সেখানে নানা গল্প বের হয়। একজন কেয়ারার আন্টি আমাকে বলে দিলেন, ’বাচ্চাটা একটু ইন্ডিপেন্ডেন্ট না হওয়া পর্যন্ত, নিজের ভালো মন্দ একটু না বুঝার আগ পর্যন্ত দিও না। যত যাই হোক, আমি তোমাকে সত্যি করে বলছি, বেশি ছোট বাচ্চাদের যত্নটা আসলে ওভাবে হয় না’।

এভাবে শুনলে আসলে সাহস থাকে না। আল্লাহর অশেষ রহমত, বোনের সাথে এমন ব্যবস্থা করতে পারলাম যে, যে দুই দিন আমি বাসার বাইরে থাকবো, সেই দুই দিন ও মেয়েটাকে দেখবে।

বোনের কাছে রেখে যাবো, নিজের বাসায়, অনেকটুকু দুশ্চিন্তা কমলো, কিন্তু পুরাপুরি যায় নি। ছয় মাস তো অনেক ছোট! তাও বাইরে থাকবো সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা, পুরা বারো ঘন্টা। মেয়েটা আমার সাথে রাগ করবে না তো? ইনসিকিওর অ্যাটাচমেন্ট হবে না তো? সিকিওর অ্যাটাচমেন্টের বাচ্চারা মা বাইরে থেকে আসলে খুশি হয়, কিন্তু খুশি প্রকাশ করার কিছুক্ষন পরেই আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়, নিজের মত করে খেলতে থাকে। মাকে জাবড়ে ধরে থাকে না। ইনসিকিওর অ্যাটাচমেন্টের বাচ্চারা মা বাইরে থেকে আসলে কান্নাকাটি শুরু করে, যেন অভিযোগ করছে, অথবা পুরাপুরি ইগনোর করে–আমাকে রেখে গিয়েছিলা? এবার মজা বুঝো! এগুলোর দীর্ঘমেয়াদী ফল তো আছেই।

ভয়ে থাকতাম। তখন অনেক মায়েদের সাথে কথা বলেছি যারা নানা কারণে সন্তানদের ঘরে রেখে বাইরে কাজ করা শুরু করেছিলেন। সে সব মায়েদের থেকে কথা বলে আর নিজে পড়াশোনা করে কিছু কাজ করলাম।

১. বোতলের অভ্যাস – চার-পাঁচ মাস থেকে প্রথমে বোতল দিলাম। অনেকে বলেন একদিন ক্ষুধা পেটে একটা বোতল নিয়ে বসলে কাঁদতে কাঁদতে এক সময়ে খেতে বাধ্য হবে। আমি ওসব দিকে যাই নি। বোতলের অভ্যাস করেছি কমলার রস দিয়ে, পানি দিয়ে, যেগুলো ও পছন্দ করে। তারপরে পাম্প করা বুকের দুধ দিয়েছি আস্তে আস্তে, তাও নিজে না। আমার মাকে দিয়েছি দিতে। একটু বিরক্তি প্রকাশ করলেই সরিয়ে ফেলে যেন, বার বার বলে দিয়েছি। একটু একটু করে দিতে দিতে কখনও আধা বোতল, কখনও পুরা বোতল খেতে খেতে আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। এরপরে যখন চাকরিতে যাওয়া শুরু করলাম, তখন সলিডের সাথে সাথে পুরা বুকের দুধটুকু ও পেত আলহামদুলিল্লাহ।

২. দিনের রুটিন – যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে মোটামোটি চার-পাঁচ মাস থেকে আরেকটা জিনিস করেছি, ওকে মোটামোটি একটা রুটিনে নিয়ে এসেছি। তারপরে সেই রুটিন কাগজে লিখেছি বিস্তারিত। কখন খাবে, কি খাবে, কখন ঘুমাবে, কতক্ষন ঘুমাবে। এক ঘন্টা এদিক ওদিক হলে অসুবিধা নেই, কিন্তু মোটামোটি একটা আউটলাইন। তারপর মেয়ের বাবা আর আমার বোনকে ওই রুটিনের সাথে ভালো ভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। সারা দিন, বারো ঘন্টা ভাবলে অনেক লম্বা সময়। কিন্তু তার মধ্যে দুইটা ঘুম, দুই বোতল দুধ, তিন বার খাওয়া হিসাব করতে গেলে দিনটা অনেকগুলো ছোট ছোট অংশে ভাগ হয়ে যায়।

৩. বলে কয়ে যাওয়া – আরেকটা ব্যাপার আমি করতাম একেবারে শুরু থেকে, পাশের রুমে যেতে হলেও কখনও চুপি চুপি বের হতাম না। সব সময় ওকে বলে, জানান দিয়ে, বুঝিয়ে, হাত নেড়ে তারপরে বের হতাম। অনেক সময় এই কাজটা করার জন্য পরিস্থিতি অযথা কঠিন হয়ে যেত। এমন ভাবে পা ধরে ঝুলা শুরু করতো, যে বাথরুমেও নিয়ে যেতে হতো। কিন্তু আমি এই ব্যাপারটা ছাড়ি নি। তারপরে যখন বাসা থেকে বের হওয়া শুরু করলাম, তখনও ব্যাপারটা জারি রাখলাম। আমি বাসা থেকে বের হই সকাল সাতটায়। এর আগেই মেয়েকে তুলে, ওর সাথে ভালো একটা সময় কাটিয়ে নেই। তিন ক্বুল পড়ে ফুঁ দিয়ে, দুধ খাইয়ে, খেলাধূলা করে, ঘষাঘষি করে, খিল খিল করে হাসিয়ে, তারপরে বের হওয়ার জন্য তৈরি হই। দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় সব সময় ওকে দেখিয়ে বের হই, হাত নাড়ি, আল্লাহ হাফিজ বলি, চুমু দেই অনেকগুলো। এখন প্রায় এক বছর, ও খুব ভালো করেই বুঝে যে মা চলে যাচ্ছে সারা দিনের জন্য। খুব খুশি হয় না, কিন্তু অনেক বেশি মন খারাপও করে না। হালকা একটু ঘ্যান ঘ্যান করে, একটু লুকোচুরি খেলতে খেলতে দরজা দিয়ে বের হলেই সে সমস্যার সমাধান হয়ে যায় আলহামদুলিল্লাহ।

এই কাজটা করার কারণে মেয়েটা আমার আল্লাহর রহমতে জানে যে মা গেলেও আবার চলে আসবে। মা আমাকে ঠকিয়ে কোথাও যাবে না। আমি একটু বেশি কাঁদলে মা যাবে না। আর সে কারণেই মনে হয়, আমি বাসায় ফিরে সব সময় মেয়েটাকে হাসি খুশি পাই। আমাকে দেখেই প্রচন্ড খুশি হয়ে আমার বুকে এসে ঝাপিয়ে পড়ে। কি শান্তি, কি শান্তি!

৪. বেড টাইম রুটিন – শুরু থেকেই পই পই করে বাসায় বলে দিতাম, আমি বাসায় এসে গোসল করাবো, অন্য কেউ যেন ওকে গোসল না করায়। বাসায় ফিরেই কোন মতে কাপড় পাল্টে মেয়েকে নিয়ে বসি। ওর সাথে খেলি, ওকে খাওয়াই। তারপরে শুরু করি আমাদের ’বেডটাইম রুটিন’।
মেয়েকে খুব মজা করে গোসল করাই, এই সময়টা ওর খুব প্রিয়! গোসল করতে করতে ওর কত গান, কত খেলা!

গোসল শেষে আয়নার সামনে বসে বসে মেয়ে খেলে আর আমি ওর গায়ে তেল মেখে দেই। জামা কাপড় পাল্টে দেই। তারপরে দুই জনে মিলে বই পড়ি। মেয়েটা বই পড়তে এত পছন্দ করে! আপাতত ওর পছন্দের বই হচ্ছে–হোয়ার ইজ দ্যা গ্রীন শীপ। প্রতিটা পৃষ্ঠা সে মনযোগ দিয়ে দেখে, একটুও বিরক্ত হয় না! আর বইয়ের শেষ পাতায় আসলেই সাথে সাথে একটা চিৎকার দেয়!

এর পরে লাইট নিভিয়ে দুধ খাওয়া আর দিন শেষের তিন ক্বুল পড়া, সূরা মূলক, সূরা বাকারার শেষ তিন আয়াত, সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত, ইত্যাদি সূরা পড়ে যাওয়া। সূরা শুনতে শুনতেই মেয়ে আমার গায়ে হেলান দিয়ে, আমার মুখে হাত বুলাতে বুলাতে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে।

আমি মনে করি, গুণগত, মানসম্মত সময় দেয়া সবচেয়ে জরুরি। তাই যত তাড়াহুড়াই থাকুক না কেন, চেষ্টা করি চাকরিতে যাওয়ার আগে মেয়েটার সাথে খেলে নিতে, আর তারপরে, আমি যত ক্লান্তই থাকি না কেন, চেষ্টা করি ঘুমাতে যাওয়ার আগে আধা ঘন্টা থেকে এক ঘন্টা খুব ভালো একটা সময় মেয়েটাকে দিতে।

আরেকটা আশা করি, দোআ করি মনে মনে, এই যে ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রস্তুতি নিয়ে ঘুমাতে যাওয়া, দিনের হিসাব শেষ করে ঘুমাতে যাওয়া, এই ব্যাপারটা যেন মেয়ে আমার বড় হয়েও ধরে রাখতে পারে।

আলহামদুলিল্লাহ মেয়ে আমার চোখের আড়ালে থাকে বেশ লম্বা একটা সময়। এই সময়ের অবলম্বন আমার একটাই, আমি প্রতিদিন সকালে আর রাতে মেয়েটার গায়ে তিন ক্বুল পড়ে ফুঁ দেয়ার চেষ্টা করি। কত রকম অনিষ্ঠের সম্ভবনা প্রতিদিন, আমরা যদি সেই সব অনিষ্ঠের বিপরীতে আল্লাহকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারি, তাহলে আমরা সন্তানদের থেকে যত দূরেই যাই না কেন, কোন চিন্তা করতে হবে না।