স্ক্রিনমুক্ত শৈশব

বর্তমানে প্যারেন্টিং এর অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো বাচ্চাকে এই স্মার্ট ফোনের লাল-নীল দুনিয়া থেকে দূরে রাখা। আমি সবসময় বাচ্চাকে স্মার্ট ফোন দেওয়ার বিপক্ষে সরব ছিলাম।

আমেরিকান একাডেমী অফ পেডিয়াট্রিকসের গাইডলাইন এর মতে ১৮মাস বয়স পর্যন্ত বাচ্চাদের যেকোন স্ক্রিন টাইম থেকে বিরত রাখা উচিত। এরপরও যদি না দিয়ে থাকা যায় তাহলে খুবই ভালো। আর দিলেও তা কখনই যেন প্রত্যেক দিন না হয়।

২+ বয়সের বাচ্চাদের হাতে স্মার্ট ফোন দিলেও কখনই তা ইন্টারনেট অন অবস্থায় দেওয়া উচিত না। উইকলি ১/২ ঘন্টা বা বাসার বাইরে খুব ট্যান্ট্রাম বন্ধ করতে যদি দিতে চান তবে বাচ্চাকে ওর নিজের ছবি, ভিডিও দেখতে দিতে পারেন। নতুবা আপনি ইউটিউব থেকে বাচ্চার বয়স উপযোগী কোয়ালিটি ভিডিও নামিয়ে বাচ্চাকে দেখতে দিতে পারেন।

যেসব বাবা মা আসলেই ছোট বাচ্চার স্ক্রিন আসক্তি নিয়ে চিন্তিত তাঁদের জন্য আমার এক্সপেরিয়েন্স শেয়ার করতে চাই। আমি যাইনাবের দেড় বছর বয়স পর্যন্ত না দিতেই চেষ্টা করেছি এমনকি খাওয়ার সময়ও না।

অস্ট্রেলিয়া ছাড়ার আগে বাসা বদল, প্রচুর ইন্টারসিটি, ইন্টারস্টেট ট্রাভেলের উপর থাকায় পরিস্থিতির চাপে যাইনাব খাওয়ার সময় স্ক্রিন টাইমে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো। মালয়েশিয়া এসে আমার প্রথম কাজ ছিলো যাইনাবের স্ক্রিন টাইম একদম বন্ধ করে দেওয়া। আমার সবসময়ের অভ্যাসমতো আমি প্রচুর দোয়া করলাম আল্লাহ্‌র কাছে যেন আল্লাহ্‌ আমার এই কাজটা সহজ করে দেন।

স্ক্রিন টাইম বন্ধের প্রথম স্টেপ হিসেবে আমি নিজের মোবাইল ফোন ব্যবহার কমিয়ে দিলাম। যেদিন ঠিক করলাম যে আজকে থেকে স্ক্রিন টাইম ছাড়াই খাওয়াবো, সেদিন সকাল থেকেই আমি মোবাইল লুকিয়ে রাখলাম। যাইনাবকে নিয়ে সকালের নাস্তার পর ঘুরতে বের হলাম। হাঁটাহাঁটি করে ওকে নিয়ে প্লে গ্রাউন্ডে গেলাম। খেলার পর সুইমিং পুলে নিয়ে যেতেই খুব মজা করে পানিতে দাপাদাপি করলো। আমার এই সবগুলো কাজের একটাই কারণ ছিলো তা হলো ওকে কোয়ালিটি টাইম দেওয়া প্লাস ফিজিক্যালি একটিভ রেখে ওর ক্ষুধা লাগানো।

বাসায় ফিরে মেয়েকে দুপুরের খাবার খাওয়াতে বসলাম। যথারীতি মোবাইল দেখে খেতে চাইলে আমি বললাম “মা মোবাইল তো আমার কাছে নেই। দেখো মা সারাদিন মোবাইল ব্যবহার করিনি”। এরপর যাইনাবকে নিয়ে কতক্ষণ মোবাইল খুঁজে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম “যাইনাবের ক্ষুধা লাগেনি? যাইনাব খাবেনা?”

কোন উত্তর নেই। মেয়ের মন খারাপ। তখন আমি মোবাইল থেকে মনোযোগ অন্যদিকে সরাতে কটনবাডের প্যাকেট হাতে দিলাম। উল্লেখ্য ওর সবসময় আগ্রহ ছিলো এই জিনিসের প্রতি। কিন্তু কানে খোঁচা দিতে পারে ভেবে কখনই তাঁকে ধরার অনুমতি দেওয়া হয়নি। যাইনাব প্রচন্ড খুশি হয়ে কটনবাড নিয়ে খেলতে খেলতেই ভাত খেয়ে নিলো। সেদিন রাতের বেলাও এক কটনবাড আর স্টিকার বুক দিয়ে যাইনাবকে ব্যস্ত রাখতে পেরেছিলাম আলহামদুলিল্লাহ্‌।

এরপরের দিনও আমি ওকে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে এসে দুপুরের খাবার টাইমে অন্য জিনিস দিলাম। ঐদিন আমি বিভিন্ন জিনিস দিয়ে একটা বাক্সে ভরে দিলাম। জিনিসের মধ্যে ছিলো স্টিকার, ছোট খেলনা, এক দুইটা কালারফুল মাথার ক্লিপ, ছোট ক্রিমের কৌটা এমন বিভিন্ন হাবিজাবি জিনিস। এইসব জিনিস একটা একটা করে বের করে দেখতে দেখতে ওর খাওয়া হয়ে গেলো। রাতেও একই কাজ করলাম শুধু বক্সের কিছু জিনিস বদলে দিলাম।

তৃতীয় দিন আমি যাইনাবকে নতুন এক্টিভিটি করার মতো খেলনার প্যাকেট দিলাম। সেই খেলনা নিয়েই ব্যস্ততায় দুপুর ও রাতের খাবার খাওয়া হয়ে গেলো। পরেরদিন অবাক হয়ে দেখলাম যাইনাব নিজেই তাঁর খেলনা আর বই নিয়ে আসলো খাওয়ার সময়ে, আলহামদুলিল্লাহ্‌।

আমার কাছে মনে হয়েছে আপনি যদি আসলেই বাচ্চাকে স্ক্রিন টাইম থেকে দূরে রাখতে চান তাহলে কিছু জিনিস মাথায় রাখতে হবেঃ

১) অতি অবশ্যই বাচ্চাকে সময় দিতে হবে। বাচ্চার সাথে কোয়ালিটি টাইম কাটানোর মাধ্যমে বাচ্চাকে স্ক্রিন থেকে দূরে রাখুন সাথে সুন্দর মেমোরি তৈরি করুন।

২) নিজেরা খাওয়ার সময়, পারিবারিক সময় কোনভাবেই মোবাইল ব্যবহার করবেন না।

৩) বাচ্চাকে বিভিন্ন রকম এক্টিভিটি করার সুযোগ করে দিন। তাঁকে পাজল, ক্র্যাফটিং, লেগো, ব্লক কিনে দিয়ে সাথে বসে সময় কাটান। আপনি কিছুক্ষণ খেললে এরপর বাচ্চা নিজেই ব্যস্ত থাকবে ইনশাল্লাহ।

৪) আপনার সব কাজে বাচ্চাকে অন্তর্ভুক্ত করুন। রান্না করার সময় টডলার বাচ্চাকেও একটা ছোট পাতিল আর চামচ দিয়ে আপনার পাশেই খেলতে দিন। বাচ্চাকে নিয়ে খেলনা গুছানো, ঘর গুছানো সহ টুকটাক ঘরের কাজ করুন।

৫) এই বেড়ে উঠার সময়ে বাচ্চার জন্য অন্য দরকারি কাজ হচ্ছেনা এমন না ভেবে বাচ্চাকে সবচেয়ে দরকারি ভাবুন। বাচ্চাকে সময় দিতে গিয়ে যদি ঘর ছবির মতো সুন্দর না হয় সমস্যা নেই; তার সাথে খেলতে গিয়ে যদি নিয়মিত এক/দুই তরকারির বেশী রাধঁতে না পারেন তাহলে সেটাই মেনে নিন।

মোট কথা গ্যাজেট না দিয়ে বাচ্চাকে নিজে সময় দেওয়ার জন্য কাজের প্রায়োরিটি লিষ্ট আপডেট করুন। বাচ্চা বড় হয়ে গেলে গোছানো ঘর আর টেবিল ভর্তি খাবারের কথা মনে রাখবেনা বরং মনে রাখবে একসাথে কাটানো এইসব সময়ের কথা ইনশাল্লাহ।

স্ক্রিনমুক্ত শৈশব 
নাঈমা আলমগীর

জুন ১০, ২০১৯ইং