অন্তঃপুরের কাব্য

মানুষের কয়েকটা ভিন্ন লার্নিং সিস্টেম আছে–কেউ হয়তো যা শুনে তা সহজে মনে রাখতে পারে (অডিটরি), শুধু দেখলে ওভাবে মনে রাখতে পারে না। কেউ যা দেখে তাই মনে রাখে (ভিজুয়াল)। কেউ নিজ হাতে কিছু না করা পর্যন্ত যতই দেখুক বা শুনুক, মনে রাখতে পারে না (কিনেসথেটিক)।

আমি ভিজুয়াল লার্নার। ছোট বেলা থেকে কখনও বাক্য গঠন করে ‘নোট’ করে পড়ি নি, জোরে জোরে মুখস্ত করি নি। শুধু মনে মনে পড়ে বিচিত্র সব ছবি, ফ্লো চার্ট আর ডায়াগ্রাম আঁকতাম, আঁকি, কাজ হয়। 

লার্নিং সিস্টেমের জন্যই হবে হয়তো, আমার কল্পনা শক্তি প্রবল। কোন কিছু পড়ার সময় সেই জায়গাটাকে মনের চোখে দেখতে পারি, গন্ধ পাই। বাকি সব ভুলে যাই, কিন্তু মন থেকে ওই ছবিটা যায় না। এটা গল্প উপন্যাস পড়ার সময় যেমন হয়, কুরআন, হাদিস পড়ার সময়ও হয়। আয়েশা (রা) এর অনেক লম্বা একটা হাদিস আছে, উনাকে নিয়ে অপবাদ দেয়া হয়েছিল যে, সেই হাদিসটা। হাদিসটা গল্পের মত, অনেক কিছু শিখা যায়। কিন্তু যা লেখা আছে, সেগুলোর বাইরেও আমার বুকের ভিতর গুড়গুড়িয়ে থেকে যায় কিছু দৃশ্য। 

হাদিসটা শুরু হয় কিশোরী আয়েশার মুহাম্মাদ (সা) এর সাথে ভ্রমনে যাওয়ার ঘটনা দিয়ে। তখনকার দিনে আরবে ভ্রমন মানেই তো বিশাল মরুভূমির মাঝখান দিয়ে ভ্রমন। সারা দিন ভ্রমন আর রাত হলে ক্যাম্পিং, বিশ্রাম। তখন তো আর টয়লেট ছিল না, মানুষ একা একা বা আরেকজনকে সাথে নিয়ে সবার থেকে অনেক দূর হেটে গিয়ে কাজ সেরে আসত।

হাদিসে এই টয়লেটে যাওয়ার ব্যাপারটা অন্ততঃ দুইবার এসেছে। প্রথমবার কিশোরী আয়েশা যখন অন্যদের সাথে অনেক দূর হেঁটে গিয়ে টয়লেটে যায়, আসার পথে গলার হার হারিয়ে ফেলে। দ্বিতীয়বার মদীনার কাহিনী–সবাই কানাকানি করছে, কিন্তু ঘটনা কি, আয়েশা জানে না। তখন একদিন গভীর রাতে অন্য এক মহিলার সাথে বহুদূর হেঁটে টয়লেটে যাওয়ার সময় জানতে পারে আসল কাহিনী। 

মরুভূমিতে আয়েশার একলা হাঁটার কথাও একবার এসেছিল হাদিসটাতে। হার হারিয়ে যখন খুঁজতে বের হয়ে গেলেন একা একা, তখন। 

কত আগে পড়া হাদিসটা, কিন্তু এই তিনটা দৃশ্য আমি ভুলতে পারি না। 

সুবিস্তৃত মরুভূমিতে এক কিশোরী… আপনি কখনও মরুভূমি দেখেছেন? আমি সত্যিকারের মরুভূমি কেবল গাড়ি থেকে দেখেছি, এয়ারকন্ডিশনড কাঁচের ওপার থেকে। এখন হজের সময় মরুভূমিতে রাত কাটানোর সময়ও তাবু বা বড় বড় স্টেডিয়াম লাইটের জন্য মরুভূমি ওভাবে অনুভব করা যায় না। কিন্তু অন্য দেশে, মরুভূমির কাছাকাছি যা কিছুই দেখেছি–সুবিস্তৃত প্রান্তর, বিশুদ্ধ বাতাস, মাথার উপর খোলা আকাশ–সে সব থেকে মনে হয়েছে, সারা দিনের বিভিন্ন সময় প্রকৃতি দেখা গেলে জীবনটাই অন্য রকম হয়ে যায়। 
একদম ভোরের প্রকৃতি এক রকম। আকাশটা আস্তে আস্তে ফিঁকে হতে থাকে, তারাগুলো মিলিয়ে যায়, বিশাল বড় সূর্যটা অবিশ্বাস্য গতিতে উঠে যায় দিগন্তের প্রান্ত থেকে। 

আবার বিকাল হতেই, দুনিয়া বদলে যায়। তেছড়া হলুদ আলোতে সব কিছু অপার্থিব সুন্দর লাগে। 
সূর্য্য ডুবার পনের মিনিট আগে থেকে পুরা আকাশটা আবার অন্য রকম হয়ে যায়। কত রঙ! মেঘ থাকলে একরকম, পরিষ্কার আকাশ আরেক রকম। আকাশের প্রান্তে চলে গেলে কেন জানি সূর্য্যটা খুব বড় দেখায়। টুপ করেই ডুবে যায়।

আর রাতের আকাশ! আমাদের মত দূষিত শহরের ভারি, অস্বচ্ছ বাতাস ভেদ করে দেখা আকাশ না, আয়েশা (রা) এর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাওয়ার সময় নিয়মিত দেখা মরুভূমির পরিচ্ছন্ন আকাশ। তারার আলোকে নিষ্প্রভ করার জন্য যখন কোন কৃত্রিম আলো ছিল না। কত অসংখ্য তারা! এতগুলো তারা এক সাথে দেখতে আমার বয়স একতিরিশ হওয়া লাগল। তারাগুলো সব দলবেঁধে থাকে মিল্কিওয়ে। 

এত সুন্দর দৃশ্য দেখলে, একা একা বা কারো সাথে, বুকের ভিতর যা কিছু জট বেঁধে থাকে, আস্তে আস্তে সব জট খুলে যায়। হাত পা ঝরঝরে হয়ে যায়। 

এই দৃশ্যগুলো মাথায় থাকে বলেই হয়তো হিজাব শুনলে আমার কখনও ‘অন্তঃপুরের’ বাসিন্দা কথাটা মনে হয় না। ওদের আকাশ ছিল, পরিষ্কার বাতাস ছিল, বিশালত্বে নিয়মিত যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। আপনি যদি মানসিক আর শারিরীক সামগ্রিক স্বাস্থ্য নিয়ে একটু পড়াশোনা করেন, তাহলে দেখবেন, সুস্বাস্থ্যের জন্য এগুলো কত দরকার। আমাদের এখানে এক মনরোগ বিশেষজ্ঞ ডিপ্রেশনের রোগীদের খুব সাধারন একটা কাজ দেন – প্রতিদিন সকাল বেলা খালি পায়ে সবুজ ঘাসে হাঁটা। 

বিজ্ঞানীরা মানুষদের আন্ডারগ্রাউন্ড ঘরে দিনের পর দিন রেখে দেখেছে ওদের কি অবস্থা হয়। আমাদের মাথার ভিতর ছোট একটা গ্ল্যান্ড আছে, পিনিয়েল গ্ল্যান্ড। এই গ্ল্যান্ডের কাজ হচ্ছে বাইরের, প্রাকৃতিক আলোর সাথে শরীরের ঘুম-জাগা ঠিক করে দেয়া। মানুষ দিনের পর দিন প্রাকৃতিক আলো না দেখলে দিন রাতের ঘুম, মন মেজাজ, সব উলটে পাল্টে যায়।

শীত প্রধান দেশে ডিপ্রেশনের হার গরম দেশের চাইতে বেশি। এর একটা বড় কারন হচ্ছে বাইরের প্রকৃতিতে দিনের পর দিন না যাওয়া। 

সব মিলিয়ে যখন আমি ঢাকা-বাসিন্দা, বা অনেক দেশের শহুরে ফ্ল্যাটে বাস করা, ঘরে থাকা মহিলাদের কথা চিন্তা করি, তখন ওদের সাথে কথা বললে, জীবনের হতাশা, ছোট খাট কারনে মন খারাপের অন্যতম কারন হিসেবে লাইফস্টাইল দেখতে পারি।

বিশেষত পর্দানশীল হলে তো কথাই নাই, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, সেই পর্দা টানা এক/একাধিক ঘর আর বাথরুম। তখন খুব ইচ্ছা হয়, উনাদের আশে পাশের পুরুষদের বসিয়ে হাদিসটা পড়াই। দেখাই, যে আমাদের সবার আদর্শ, নবীর স্ত্রীরাও প্রতিটা দিন, প্রতি দিন পরিচ্ছন্ন বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারতেন, খোলা আকাশের নিচে দিনে, রাতে, হাঁটতে পারতেন। মনে হতে পারে এটা সামান্য ব্যাপার, কিন্তু আমার মনে আছে, আমার বাচ্চা হওয়ার পরের সময়টায়, শুধু প্রতিদিন সকালে আধা ঘন্টার জন্য একা একা বাইরে হেঁটে আসলে আমি সারা দিন চলার মত শক্তি পেয়ে যেতাম। অনেক চিন্তার জট খুলে যেত। বুকের পাথর সরে যেত। মাথা ঠান্ডা হতো। 

আল্লাহর দেয়া নিয়মগুলো এমন, যে নিয়মের পরিসীমা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে, নিয়মের দোহাই দিয়ে বেসিক রাইটগুলো না দিলেই জুলুম। পর্দা, নন-মাহরাম পুরুষদের জন্য, প্রকৃতি থেকে না, আল্লাহর অন্য কোন সৃষ্টি থেকে না। এইটুকু বুঝে প্রতিদিনের/মাসিক/বাতসরিক লাইফস্টাইলে একটু একটু পরিবর্তন আনলে আমার মনে হয় অনেক মেয়েরা শরীর আর মনের দিক দিয়ে অনেক সুস্থ থাকতো। খুব ছোট খাট ব্যাপার দিয়েই শুরু করা যায়–দিনে একবার ছাদে উঠা। সপ্তাহে একদিন রাতের আকাশ দেখা। মাসে একবার দূরে কোথাও প্রকৃতির কাছে যাওয়া। ছোট খাট ব্যাপার, কিন্তু শুরু হিসেবে এগুলোই হোক।

………………………….

পরিশিষ্ট :

সহীহ বুখারী

…………………………………..

অন্তঃপুরের কাব্য
সাদিয়া হোসেন
(৮ মার্চ ২০১৮)