দ্য ম্যান হু লাফস

রোজকার মতো ফজরের অনেক আগেই ঘুম ভেংগে গেলো মুহ্‌সিন সাহেবের। যিকর করে উঠে বসলেন। মিসওয়াক ওযু সেড়ে তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে গেলেন। তালহার মাকে উঠানোর জন্যে হালকা পানির ছিটা দিলেন। ১৩ বছর বয়স থেকে মেয়েটা তাঁর সাথে সংসার করছে। ছোট বয়সে গড়ে ওঠা সম্পর্ক সাধারণত দৃঢ় হয়,আল্লাহ সেই দৃঢ়তা তাদের সম্পর্কে দিয়েছেন। এখনো বিয়ের স্মৃতি জীবন্ত লাগে। এইতো সেদিন যেন বউ করে আনলেন পীর সাহেবের মেয়েকে। পীরের মেয়ে বিয়ে করায় বন্ধুদের কী রাগ! সেই পীরের দরবারে এখন বিদআত দূর হচ্ছে, সুন্নাহর আলো প্রবেশ করেছে। শশুর মহাশয় বড় ভালো মানুষ ছিলেন, সহীহ হাদীস সামনে নিয়ে আসলে নিজের ভুল ঠিক স্বীকার করে নিতেন। তারই অনুপ্রেরণায় কত বই লেখা, মানুষটার জন্যে মন থেকে দুআ আসে।

তাহাজ্জুদ শেষে ল্যাপটপ খুলে বসলেন মুহসিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কাজ বাকি আছে, লেটেস্ট বইটারও কিছু এডিটিং বাকি। এই বইগুলোই তার সদকায়ে জারিয়াহ হবে ইন শা আল্লাহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বই না লিখে কেন প্রাইভেট পড়ান তিনি বুঝতে পারেন না। তাঁর নিজের জ্ঞানও বেশি নয়,কিছু কিতাব মুখস্থ করার তৌফিক দিয়েছেন আল্লাহ। সৌদি আরবে যে ১৮ বছর ছিলেন জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি দাওয়াহ কাজ করেছেন। বন্ধুরা বলতো, “এতো পড়ে কি হবে, কালই তো মারা যেতে পারিস।” মুহ্‌সিন হেসে বলতো,”আমি এতো পড়ি না ভাই। কাল যদি মারা না যাই, তাই অল্প একটু পড়ে রাখছি।” ওই অল্প একটু পড়াতেই আল্লাহ বারাকাহ দিয়ে দিতেন, দেশি বিদেশি ছাত্রদের মধ্যে হাই স্কোর পেতেন। ছেলেটাও এখন পড়ছে সৌদিতে, বড় শখ তাঁর ছেলেটা আলেম হোক। নাইনে উঠার পর ছেলেটা আসলো সাইন্স পড়ার অনুমতি চাইতে। সাইন্সের পড়ার চাপে আলেম হওয়া সম্ভব না তিনি জানেন, ছেলের কথা আমলে নেননি। ডাক্তার -ইঞ্জিনিয়ার অবশ্যই দরকার আছে, কিন্তু একজন আলেমের সম্মানের কাছে দুনিয়াবি জ্ঞানীর সম্মান বলতে গেলে কিছুই না।

মেইল খুলতেই লম্বা একটা মেইল পেলেন মুহসিন। এক তরুণ ৩০ বছর বয়সে এসে দুনিয়াবি পড়াশোনা,চাকরি-বাকরি ছেড়ে দিয়ে দ্বীনের পড়াশোনা করতে চায়, পরামর্শ দরকার। নতুন নতুন দ্বীন বোঝার আবেগে বোকামি করতে যাচ্ছে তরুণ। এই মূহুর্তে সব ছেড়ে দিয়ে দ্বীনি জ্ঞান অর্জন শুরু করলে দ্রুত হতাশ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তখন কোনো বিষয়েই স্পেশালাইজড হতে পারবেনা, না দ্বীন না দুনিয়া। সুন্দর করে বুঝিয়ে একটা মেইল লিখলেন মুহ্‌সিন। তাঁর টাইপিং স্পিড ভালো,নিজের বই নিজেই টাইপ করেন।

সূর্য উঠার পর দুই রাকাত সলাহ পড়ে নিল রেশমা। এই আমলটা নিয়মিত করতে পারে না, কিন্তু আজ একটা বিশেষ দিন। আজ ওর বিয়ে। একটু পর নিজ হাতে এক পাতিল বিরিয়ানি চড়াবে সে। প্রিয় শায়েখ খুতবা দিবে তাঁর বিয়েতে, শায়েখকে নিজের হাতের বিরিয়ানি খাওয়াবে সে। বাবুর্চির রান্না করা খাবার অন্য সবাই খাক। রেশমার রান্নার হাত যে খুব ভালো তা নয়। কিন্তু জীবনের নানা ক্রান্তিকালে যার কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক প্রশ্নের উত্তরে জীবনকে গুছিয়ে নিতে পেরেছে তাঁকে নিজ হাতে খাওয়ানোর শখ। কিছুটা পাগলামো করেই ভাইকে দিয়ে পাত্র পক্ষকে বলিয়েছে শায়েখের যেদিন সময় হবে সেদিন বিয়ের দিন ফেলতে। একজন গায়ের মাহরামের প্রতি মুগ্ধতা নয়, জ্ঞানীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হিসেবেই দেখেছে ছেলেপক্ষ বিষয়টাকে। পাত্র নিজে ডঃ মুহ্‌সিনকে শ্রদ্ধা করে, তিনি বিয়েতে থাকলে সম্মানিত বোধ করবে সে। যদিও বাবার কাছে বকা খেয়েছে রেশমা।রেশমার বড় চাচা সচিব মানুষ, প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছের লোক। তার সুবিধামত দিন তারিখ ঠিক না করে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে কেন এতো গুরুত্ব দিতে হবে। ভাইকে দিয়ে শায়খকে রাজি করিয়েছে রেশমা। সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটা অচেনা মুসলিম ভাইয়ের দাওয়াতকে অগ্রাহ্য করেননি।

রান্নার আগে সব গুছিয়ে নেয় রেশমা। দুআ পড়ে রান্না শুরু করে। আত্মবিশ্বাসী রেশমার নার্ভাস লাগছে! সব ঠিকঠাক হবে তো আজকে? বিয়ে একটা ইবাদাহ। আল্লাহ যেন সব সহজ করে দেন।

মায়ের থেকে বিদায় নেন মুহ্‌সিন। আজ ঢাকায় যাবেন। কিছু জরুরি কাজ আছে আর একটা বিয়েতে খুতবা দিতে হবে। বাংলাদেশের ৯৯% মানুষেরই আক্বীদায় ত্রুটি আছে। যে ১% এর আক্বীদা বিশুদ্ধ, তাদের জজবা ২০০%। যে মেয়েটার বিয়ে পড়াবেন তার বাবা ধর্ম কর্ম তেমন করেন না, পছন্দও না। মেয়েটা বাবার প্রতি উত্তম ব্যবহার আর নিজের ইসলাম অনুশীলনের উত্তেজনার মধ্যে ব্যালেন্স করতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। সন্তানসম আবেগী তরুণদের জন্যে দুআ আছে তাঁর, আল্লাহ সবাইকে ধৈর্য দান করুক। ধৈর্য জিনিসটা আল্লাহ তাকে দান করেছেন, এজন্যে শুকরিয়ার শেষ নাই তাঁর। রাগের মুহূর্তেও হেসে ফেলে সব সহজ করে ফেলতে পারেন তিনি। নিজেরও দুইটা মেয়ে আছে। মেয়েদের আবেগ একটু বেশিই হয়।

গাড়ি স্টার্ট না দিতেই ফোন শুরু। এই ফোন জিনিসটা সুবিধা আবার যন্ত্রণাও। সময়ে অসময়ে বেজে উঠবে, ভদ্রতার খাতিরে কথা সেরে সাথে সাথে রাখাও যাবে না,কখনো তো ঠিকমতো শোনাও যায় না ঔ পাশের কথা। এভাবে আর যাই হোক ইসলামি প্রশ্নোত্তর দেয়া কঠিন। ফোনে কথা বলে চিন্তায় ডুবে গেলেন মুহ্‌সিন। তাঁর জেলার এক এলাকায় হানাফি-আহলে হাদীস মারামারি হয়েছে, তাঁকে মধ্যস্ততা করে দিতে হবে। হায় উম্মাহ! সারা বাংলাদেশে খ্রিস্টান মিশনারিরা তাদের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, গ্রামকে গ্রাম খ্রিস্টান হয়ে যাচ্ছে আর আমরা ঝগড়া করি “জোরে আমীন-আস্তে আমীন” নিয়ে! মজা করে বলে দিয়েছেন, “মারামারি করতে থাকো তোমরা, যে জিতবে আমি তার পক্ষে।” ঢাকা থেকে ফিরে মিটমাট করা যাবে ইন শা আল্লাহ।

ড্রাইভার গাড়ি থামালো হঠাৎ। বাস আর প্রাইভেট কারের সংঘর্ষ, বাস ড্রাইভারকে গণপিটুনি দেয়া হচ্ছে। 
“তাড়াতাড়ি গাড়ি ছাড়ো। একটা মানুষকে বিচারের আওতায় না এনে মারা হচ্ছে, এখানে আল্লাহর লানত পড়তে পারে। আমরা যেহেতু এদের থামাতে পারবো না, চলে যাওয়াই ভালো।”

হাইওয়েতে প্রাইভেট কার আসলেও ঝুঁকিপূর্ণ, অনেকেই তাঁকে না করে এভাবে যাতায়াত করতে। সবসময় হয়ে উঠে না আসলে। অস্থিরতা কমাতে তালহার মাকে ফোন দেন তিনি। এই মহিলার খোঁজ একটু পরপর না নিলে ভালো লাগে না।

খবরটা পেয়েছে সাকিব,রেশমার ছোট ভাই রেহান জানানোর আগেই৷ রেশমাকে বিষয়টা এখনি জানতে দেয়া যাবে না। তাড়াহুড়ো করে একজন মুফতিকে বিয়ে পড়ানোর জন্যে নিয়ে গেল। রেশমা বুঝবে না ইন শা আল্লাহ, খুতবা তো হবে ছেলেদের অংশে। এখন নিশ্চয়ই ওর মোবাইল খুলে নিউজ পড়ার সময় নেই। মেয়েদের জোনে কেউ বোকামি না করলেই হবে। রেশমার ছোট ভাই রেহান সবাইকে “ম্যানেজ” করে রেখেছে নাকি!

বিয়ে ঠিকঠাক সম্পন্ন হলো। খুতবা রেকর্ড করা হয়েছে কিনা, শায়েখের বিরিয়ানি মজা লাগলো কিনা এমন হাবিজাবি প্রশ্নে রেশমা রেহানকে জেরবার করছে। রেহান মেকি ব্যস্ততায় “হু -হা” করছে! ডঃ মুহসিনের রোড এক্সিডেন্টের খবর বেশিক্ষণ লুকানো গেল না। পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় স্পট ডেড ড্রাইভার ও শায়েখ। স্থির বসে ছিলেন গাড়িতে, কপাল বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়েছে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবীতে। কান্না নয়, শোক সামলে ম্লান হাসে রেশমা। আল্লাহ চাইলে এই মৃত্যু শহীদের। যে মানুষটা দুনিয়ায় সারাজীবন হাসলো, আখিরাতেও সেই হাসি বন্ধ হবে না ইন শা আল্লাহ।

[সব চরিত্র কাল্পনিক হয় না! কিছু চরিত্র ওতপ্রোতভাবে জীবনের সাথে জড়িয়ে যায়। আলেমরা ভুল ত্রুটি মুক্ত নন। আল্লাহ যেন আমাদের সবার ভুল ত্রুটি মাফ করেন, চেষ্টা কবুল করে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন। ]

দ্য ম্যান হু লাফস
উম্মে লিলি

জুন ০৮, ২০১৯ইং