পরম বন্ধু

এমন একটা দিন ছিলো বন্ধু-বান্ধব ছাড়া কল্পনাই করা যেতো না। মা কতো বলত, “কোথায় হারিয়ে যাবে এসব বন্ধুত্ব দেখিস নে”।

কে শুনতো কার কথা! আমরা মাকে উল্টা বলতাম, ‘’তোমাদের মত বন্ধুত্ব নাকি আমাদের টা, আমরা ঠিকই সারাজীবন কাছের বন্ধু থাকবো।’’ মা হাসতেন।

স্কুল লাইফে যেনো বন্ধু-বান্ধব ছাড়া কোন কিছুই করতে পারতাম না। কোন অনুষ্ঠান; এই তুই চল না আমার সাথে। বাসায় কোন গেস্ট আসছে; এই আজকে চলে আয় ভালো মন্দ রান্না হবে আর আমার আত্নীয়রা ও তোকে দেখবে। কোথাও ঘুরতে যাওয়া তো বেষ্ট ফ্রেন্ড; মানে কাছের বান্ধুবি ছাড়া কল্পনাই করা যেতো না।

দিনে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তো মনে হয় তেইশ ঘন্টাই হয় ফোনে কথা না হয় ফেসবুক চ্যাটিং। প্রতি মূহুর্তের, প্রতি ঘন্টার, সেকেন্ডের কথা না বললেই নয়! কথায় আছে না, পেটের ভাত হজম হয় না। এরকম অবস্থা ছিলো!

ঝগড়া মন খারাপ তো হতোই, কিন্তু আবার কীভাবে যেনো ঠিক হয়ে যেতো। কেও কিছু মনেই নিতো না! আহারে কত্ত ভালোবাসা। কলেজে উঠে আবার নতুন বান্ধবিরা হলেও বেষ্ট তো স্কুল জীবনের বন্ধুরাই, তাই না! কারণ তারা তো ছোট্ট কালের সাথী! সারাজীবনের সাথী! ইউনিভার্সিটিতেও নতুন সার্কেল। কিছুটা দূরত্ব হয়ে যায় বন্ধুত্বে। কারণ হিসাবে দেখানো হয় ব্যাস্ততা। আগে তো আমরা ছোট ছিলাম, ব্যাস্ততা শব্দটার মর্মাথ কই আর বুঝতাম।

সময়ের সাথে সাথে বন্ধুর সাথের সময় গুলা আস্তে আস্তে ভাগ হয়ে যেতে থাকে এসাইনমেন্ট ও পারিবারিক ব্যাস্ততার চাপে! ঝগড়া, মন খারাপ গুলোও আর ঠিক হয় না কোন দিন। যা থাকে সবই নিজেদের ইগো রক্ষার্থে টিকিয়ে রাখা ঠুনকো এক সম্পর্ক। কি অদ্ভুত এই পরিবর্তন!

দিন শেষে একদিন আমার মনে আল্লাহ্ এর ভয় আল্লাহ্ এর প্রতি এক ধরণের বিশ্বাস, ভালোবাসা প্রকট আকার ধারণ করল। এ এক অন্যরকম অনুভূতি ছিলো। আগে যে আল্লাহ্ এর ভয় ছিলো না বা বিশ্বাস ছিলো না তা না। তবে সে সময় মনে হতে লাগলো আমি কীভাবে চলছি।

আল্লাহ্ কি আমাকে এভাবে চলতে বলেছেন? আমি কি পড়ছি? আমার পড়ালেখা কি শুধু দুনিয়ার জন্য হয়ে যাচ্ছে না, যে দুনিয়ার গুরত্ব কতটা নিম্নস্তরে তা বুঝাতে নবী কারীম (সাঃ) একটা মৃত ছাগলের কানের সাথে তুলনা করেছেন দুনিয়াকে? আমার চলাফেরা, আমার ভালোবাসা আমার বন্ধুত্ব কি শুধু দুনিয়ার জন্য হয়ে যাচ্ছে না? যেখানে সবকিছু হওয়া দরকার শুধুমাত্র আল্লাহ্ এর ই জন্য!?

আমার বন্ধুত্ব কি আল্লাহ্ এর কারণে; না দুনিয়ার জন্য? এই যে এতো সব কিছু যে বন্ধুদের জন্য, তারা কি আমাকে দেখাচ্ছে জান্নাতের পথ? বলছে রাসুল (সাঃ) এর কথা?

কেয়ামত দিবসে আল্লাহ্ যখন বলবেন, ‘আমার মর্যদার (আনুগত্বের) কারণে পরস্পরে বন্ধুত্বকারীরা কোথায়? আজ আমি তাদের আমার ছায়াতলে ছায়া দিব, যেদিন আমার ছায়া ব্যতীত কোনো ছায়া নেই।’ (মুসলিম, অধ্যায়, বির ওয়াস্ সিলা, হাদিন নং : ২৫৬৬)।

তখন এসব বন্ধুরা যারা আল্লাহ্ এর রাস্তার পথিক না তারা কি দিবে আমাকে আল্লাহ্ এর আরশের ছায়া? এসব প্রশ্নের উত্তর খুব দেরিতে হলেও এখন খুঁজে পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ্। আসলে জান্নাতের পথ দেখানোর বন্ধুর আজ বড়ই অভাব। আজ বন্ধু মানে আমরা দুনিয়ার সব থেকে গুরত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিসত্তাকে বুঝি।

আসলে আমরা কতটুকু সচেতন এই বন্ধু নির্বাচনে? এখন অনেকে বলবে, আগে যখন বুঝতাম না তখন থেকে বন্ধুত্ব; যত যাই হোক বন্ধু তো! ছেড়ে দিই কীভাবে। কেনো ছেড়ে দিবো। তাকে আল্লাহ্ এর পথে ডাকবো। তাকে বুঝাবো বন্ধুত্ব হবে শুধুই আল্লাহর জন্য। কিন্তু নাহ, এতো সহজ না।

আল্লাহ্ এর পথে আহ্বান করতে যেয়ে হারিয়ে ফেলেছি দুনিয়ার বন্ধু গুলোকে। আলহামদুলিল্লাহ! তাহলে তারা কি আদৌ ছিলো পরম বন্ধু? যারা আল্লাহ্ এর পথে চলতে কুন্ঠাবোধ করে? আর আল্লাহ্ এর পথে আহবানকারী বন্ধুকে ত্যাগ করে? আল্লাহ্ আমাদের প্রতিটা সময়, ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করেছেন, করেন এবং করবেন। দুনিয়ার এসব বন্ধুদের কি কোন ক্ষমতা আছে? না আছে ইচ্ছা সাহায্য করার। পরম বন্ধু তো আল্লাহ্ ই!

সঠিক বন্ধু নির্বাচন করলে হাশরের ময়দানে আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান পাওয়ার ঘোষণা এসেছে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সাত ব্যক্তিকে কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহ তার আরশের ছায়ায় স্থান দেবেন। (এর মধ্যে) ওই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর জন্য একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেছে। [বোখারি]।

বন্ধুত্ব তো অনেক কারণে অনেক উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে, কিন্তু কেবল এক প্রকার বন্ধুত্ব রয়েছে যা মানুষের ইহকাল ও পরকালের জন্য কল্যাণকর। সেটা এতই মহৎ, যার বিনিময় জান্নাত। সেই বন্ধুত্ব হচ্ছে, আল্লাহর কারণে বা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সম্পর্ক।

অর্থাৎ কোন মুসলিম অন্য মুসলিম ভাইর সঙ্গে এই কারণে বন্ধুত্ব স্থাপন করে যে, সে আল্লাহকে ভালবাসে, আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলে। তার মাল-সম্পদ, মান-সম্মান, সৌন্দর্যতা ইত্যাদির কারণে নয়। আজ হয়ত আল্লাহ্ এর পথে চলার কারণে হারিয়েছি অনেককে; কিন্তু আল্লাহ্ তো তার বান্দাকে নিরাশ করেন না কোন দিন। আল্লাহ্ ঠিকই মিলিয়ে দিয়েছেন আল্লাহ্ এর পথে চলা কিছু মানুষকে! যারা আমাকে ভালোবাসে আল্লাহ্ এর ই জন্য। আর বিশ্বাস করে আল্লাহ্ ই পরম বন্ধু!


পরম বন্ধুত্ব
উম্মে সালমা হুসাইন

(১৬/০৫/১৯)