পুরনো কাসুন্দি

একটা মেয়ে যখন পর্দা শুরু করে তখন চারপাশে সবাই তাকে লাল গালিচা সম্বর্ধনা দেয় না। দু’পাশ থেকে ফুল ছিটাতে থাকে না। ঘরে বাইরে সব জায়গায় তার অবস্থান পরিস্কার করতে যথেষ্ট সংগ্রাম করতে হয়।
ফেসবুকে ইসলাম পালনের যে চিত্র আমরা দেখতে পাই, বাস্তবতা তার থেকে অনেকটাই ভিন্ন। বাস্তবে ইসলাম পালন মানে কেবল হালাকায় যাওয়া নয়। দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করা নয়। রান্না বান্না বাদ দিয়ে প্রোডাক্টিভ মুসলিমাহ হওয়া নয়। দামি দামি ইসলামি বই কিনে টাকার অংকসহ ফেসবুকে পোস্ট দেয়া তো নয়ই!
বাস্তবে একজন দ্বীনদার মেয়ের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিজাব পালন করা।

মেয়ে অবিবাহিত হলে তার হিজাব পালনে সংগ্রাম এক ধরণের, বিবাহিত হলে আরেক ধরণের। একটা আরেকটার সাথে তুলনা করা বোকামী।

বিয়ের আগে নিজের পরিবারকে মানাতে অনেক সময় লেগে যায় একটা মেয়ের। স্কার্ফ পরার সাথে সাথে তদন্ত শুরু হয় বয়ফ্রেন্ড আছে কি না, নিক্বাব পর্যন্ত যেতে যেতে বয়ফ্রেন্ডের গুজব ফুলে ফেঁপে বলার অযোগ্য কদাকার রূপ ধারণ করে। আল্লাহর আদেশ হিজাব করা, এটুকু যারা জানে তারা সরাসরি হিজাবের বিরোধিতা করে না। তবে হিজাব করা মেয়েটার প্রতিটা পদক্ষেপ আতশ কাঁচের নিচে রেখে প্রমাণ করা হতে থাকে হিজাব করলেও আদতে সে এক নিকৃষ্ট প্রাণী।
এটা হিজাব সংগ্রামের সবচেয়ে সবচেয়ে সহজতর ধাপ। সবচেয়ে কঠিন ধাপ কোনটা? কঠিন ধাপ হচ্ছে বাড়ির ভেতর গাইর মাহরামদের সামনে পর্দা করা।
একে তো পর্দা করার জন্য আপনি সবার চক্ষুশূল। আপনার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দোষগুলো সবার সামনে বেরিয়ে এসেছে, আপনার মুখোশ উন্মোচন হয়ে গেছে। এখন বাড়িতে গাইর মাহরাম আসলে নিজ ঘরের দরজাটা চাপাতে গেলেও, বোরকাটা পরতে গেলেও অনেকের বিরক্তির কারণ হবেন আপনি। মানবিকতার খাতিরে কেউ আপনাকে বোরকাসহ রান্নাঘরে কাজ করতে ডাকবে না, কিন্তু আপনি যে পর্দার দোহাই দিয়ে আরাম করে ঘরে বসে আছেন সেটা মনে করিয়ে দিতেও ভুলবে না।

গ্রাম থেকে অবুঝ কোনো মেহমান দীর্ঘদিন থাকার জন্য আসলে আপনাকে বোরকা পরেই রান্নাঘরে কাজ করতে হবে। কারণ যেকোনো সময় সে রান্নাঘরের দরজায় চলে আসতে পারে। বোরকা পরে তার সামনে দিয়ে ওয়াশরুমে যেতে হবে, কারণ সে ঠিক করেছে সারাদিন ঘরে বসে টিভি দেখবে।

এখানে কারো কিছু বলার নেই। সবাই পরিস্থিতির শিকার। যে পর্দা করছে না, তারও অস্বস্তিতে পড়তে হয় এমন অবুঝদের পাল্লায় পড়ে।

তবে আশার কথা এই যে মেহমান চিরকাল থাকে না। এই সান্তনা নিয়ে হিজাবি মেয়েরা একটু কষ্ট করতেই পারে।

এবার আসুন দেখে নিই এই মেয়েটা যখন বিয়ে করে নতুন সংসারে যায় তখন তার কী অবস্থা হয়। মেয়েটা চায় এমন এক পরিবারে যেতে যেখানে পর্দার জন্য তাকে সংগ্রাম করতে হবে না। অবশ্য এমন মেয়েও আছে যারা প্রতিকূল পরিবেশে গিয়ে বিপ্লব সাধন করতে চায়। তারা সংখ্যায় কম, আমার আলোচনার আওতামুক্ত। অধিকাংশ মেয়েই পর্দার ক্ষেত্রে সহজতা চায়। এই মেয়েরা প্রথম ধাক্কাটা খায় বিয়ের দিন। হবু স্বামীর আগে থেকে দেয়া আশ্বাসের সাথে কাজের মিল থাকে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। বিয়েতে ফ্রি মিক্সিং নিয়ে স্বামী নির্বিকার থাকে। চোখের সামনে স্বামীর কাজিনরা স্ত্রীর নিক্বাব খুলে ফটোসেশন শুরু করে দেয় এমন ঘটনাও কম নয়।

এরপর মেয়েটাকে নতুন করে সব শুরু করতে হয়। ঐ যে প্রথম প্রথম হিজাব করার সংগ্রাম, বাড়িতে অশান্তি, বাইরে কটুক্তি সব অনুভূতি আবার ফিরে আসে শশুরবাড়িতে। চাচা শশুর এসে বলে, মুখটা দেখলাম না এ কেমন অভদ্রতা? চারদিকে একই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়- এ কেমন অভদ্রতা?

ধ্বনি প্রতিধ্বনি থেমে যেত যদি স্বামী দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে বলত তার স্ত্রী সবার সামনে আসবে না, সবাইকে চেহারা দেখাবে না। কয়টা ছেলে স্ত্রৈণ উপাধির ভয়কে উপেক্ষা করে এ দায়িত্ব নেয় সে পরিসংখ্যানে যাব না। আপনারাও যাবেন না, পাছে লজ্জা পান!

মেয়ে যেহেতু শশুরবাড়িতেই থাকছে, শশুরবাড়িরই খাচ্ছে, তখন তাকে ঘরের কাজও করতে হয়। এখানে মানবিকতা দেখানোর কেউ নেই। পর্দা করে তাকে রান্না করতে হয়। কারণ যেকোনো মুহূর্তে দেবর এসে পড়তে পারে। এ বাড়িটা মেয়েটার নয়। এ বাড়িটা তার দেবরের, ননদের, ভাসুরের। মেয়েটার জন্য একটা ঘর বরাদ্দ রেখে তার স্বামী ফরজ আদায় করে ফেলেছেন। সে ঘরে মেয়েটা রাতে ঘুমানো ছাড়া আর কখনোই থাকার সময় পায়না। ঘরের কাজে তাকে ডাইনিং রুমে, রান্নাঘরেই কাটিয়ে দিতে হয়।

নিজ ঘরে এটাচড বাথরুম থাকলে তো ভালোই, যদি না থাকে তাহলে সবার সামনে দিয়ে ওয়াশরুমে যাতায়াতে মেয়েটা মরমে মরে যায়। স্বামীর ফরজ আদায়ে আর তুষ্ট থাকতে পারে না। সে তখন মুখ ফুটে আলাদা বাসার কথা বলে ফেলে। ফেসবুক তার গায়ে আগেই ইসলামি ফেমিনিস্ট তকমা দিয়ে ফেলেছে। এবার অপবাদটা আসে দুনিয়ায় একমাত্র ভরসাস্থল স্বামীর পক্ষ থেকে।

এটা ছিল পটভূমি। এবার মূল কথায় আসি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে অধিকাংশ ছেলের পক্ষেই স্ত্রীর জন্য আলাদা বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়ত সম্ভব না। কিন্তু কিছু ব্যাপারে অর্থের থেকে সদিচ্ছার অভাব প্রকট।
উপরে যে চিত্র আমরা দেখলাম, স্বামীর যদি সীমিত ইনকাম থাকে, মা বাবা ভাইবোনের প্রতি অর্থনৈতিক দায়িত্ব যদি থাকে তাহলে কোনোভাবেই তার পক্ষে আলাদা বাসস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব না। কিন্তু তাই বলে কি স্বামী তার পরিবারের সদস্যদেরকে স্ত্রীর পর্দার গুরুত্ব বোঝাতেও অপারগ? এটুকু বোঝাতে কত টাকা ব্যয় হয়? ভাইকে একটু বুঝে শুনে ঘরের মাঝে চলাফেরা করতে বললেই মেয়েটার পর্দা করা অনেকটাই সহজ হয়ে যেত। সে তো আর গ্রাম থেকে আসা অবুঝ মেহমান নয়! কিন্তু স্বামীদের ভাবটা এমন থাকে- তোমার পর্দা তুমি কর, আল্লাহর পথে চলা কি এতই সহজ নাকি!
অস্বীকার করব না, ‘আমার সব চাই, কিছুতেই কম্প্রোমাইজ করব না’ এমন দীক্ষা নিয়ে আসা মেয়েরা এদেশে আছে। লীভিং স্ট্যান্ডার্ড মেন্টেইনের নাম করে স্বামীকে নিঃস্ব করে দেয়া মেয়েও আছে। কিন্তু তারা সংখ্যায় কতজন? তারা কি আমাদের সমাজের অধিকাংশ মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব করে? করে না। কিন্তু ভাইয়েরা পারলে পশ্চিমা সমাজ থেকেও এমন মেয়ের উদাহরণ টেনে এনে প্রমাণ করে দেন এদেশের মেয়েরা ইসলাম পালনের নাম করে ফেমিনিস্ট হয়ে যাচ্ছে।
এ সমাজের অধিকাংশ মেয়ের ত্যাগ তিতিক্ষা আর মানিয়ে চলার ক্ষমতার উপর ভর করে সংসারগুলো
এ সমাজের অধিকাংশ মেয়ের ত্যাগ তিতিক্ষা আর মানিয়ে চলার ক্ষমতার উপর ভর করে সংসারগুলো টিকে আছে। মেয়েদের এ অবদান এক নিমেষে গুড়িয়ে যায় যখন তখন ফেমিনিস্ট অপবাদে। তাদের জীবন যাপন সহজ করতে চাওয়া হয়ে যায় ইসলামের সীমানা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মত অপরাধ!

ভাইয়েরা যখন আলেমদের কাছে স্ত্রীর আলাদা বাসস্থান দেয়ার ব্যাপারে জানতে চান, তখন কি খুলে বলেন স্ত্রীকে কতটা বৈরি পরিবেশে থাকতে হয়? দিনের অধিকাংশ সময় পর্দা করে থাকতে হয়? দেবরের সামনে, ভাসুরের সামনে দিয়ে প্রতিদিন বোরকা পরে ওয়াশরুমে যেতে হয়?

প্রতিদিন পর্দা করে চুলার আঁচে সেদ্ধ হতে হয়?
যদি তাঁদেরকে একটু জানাতেন, যদি একটু খুলে বলতেন ভাইয়েরা, কখনোই আলেমরা একটা ঘর দিলেই ফরজ আদায় হয়ে যায় এ কথা বলে থেমে থাকতেন না।

ফতোয়া শপিং করে আপনারা সুখেই আছেন, ফলস পজিশনে পড়ে গেছে সম্মানিত আলেম সমাজ। আপনার বেদ্বীনি পরিবার আর আলেমদের দ্বীনি পরিবার এক নয়। আপনারা না জানালে তাঁদের কল্পনায়ও আসবে না দ্বীন মানে না এমন পরিবারে একটা মেয়েকে কীভাবে সংগ্রাম করতে হয়। আপনাদের এই ফেমিনিস্ট-ফেমিনিস্ট খেলায় দ্বীনদার মেয়েরাও বীতশ্রদ্ধ।

যে আপনারা স্ত্রীর প্রতি যুলুম হবে বলে তাকে চাকরি করতে দিচ্ছেন না, সেই আপনারাই স্ত্রীকে এমন স্থানে রাখছেন যেখানে সারাদিন পর্দা করে চলতে হয়। ইসলামিক পরিবেশে চাকরির সুযোগ থাকলেও হয়ত তাদের একটু রিলিফ হত, যে রিলিফ তারা শশুরবাড়িতে পায় না।

ছেলে বুড়ো খোকা সবাই জানে আলাদা ফ্ল্যাট মেয়ের অধিকার নয়। এক রুমের বন্দোবস্ত করলেই অধিকার আদায় হয়ে যায়।

কেবল জানা বাকি একটা মেয়েকে পর্দার জন্য কীসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সে কথা জানাতেই পুরানো কাসুন্দি নিয়ে এত ঘাঁটাঘাঁটি করা!

পুরনো কাসুন্দি
আনা আমাতুল্লাহ