বার্ধক্য 

আফিফা রায়হানা

আমি যে এলাকায় থাকি, এখানে বয়স্ক লোকজন থাকে বেশী। এখানকার বয়স্ক লোকজন ঠেকায় পড়ে হোক, আর যেভাবেই হোক, বেশ এক্টিভ। নিজের সমস্ত কাজ, বাজার-সদাই, ঘোরা-ফিরা সব একা একাই করেন। উইল চেয়ারে করেও লোকজন ছুটে বেড়াচ্ছে।

আমাদের দেশী যে কেউ দেখলে ভাববে, আহারে, ছেলে-মেয়েরা কেউ কাছে নাই, নাতি-নাতকুর নাই, কি কষ্ট। কেউ সাথে থাকে না ঠিকই, কিন্তু আমাদের দেশী সত্তোর্ধ যে কারো তুলনায় এরা অনেক অনেক বেশী স্ট্রং, ফিজিক্যালি-মেন্টালি। একটা বয়সের পর আমাদের দেশী লোকজন পুরা বসে পড়ে। না নিজ থেকে কিছু করতে চায়, না করার আগ্রহ দেখায়, এই যেমন বাজার সদাই, নিজের ডাক্তার নিজে দেখানো, মিনিমাম হেলথ মেইনটেইন করা। এজ ইফ, এইবেলা এগুলা অন্য কেউ করে দিক।

যারা শারীরিক ভাবে অক্ষম, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু সক্ষমতা থাকার পরও অনেকে খালি বয়সের দোহাই দিয়ে করেন না বা করতে চাননা। অনেক ক্ষেত্রে মনে হয়, নিজের ব্যক্তিগত কাজের জন্য অন্যের উপর নির্ভর হয়ে থাকাটাই জীবনের লক্ষ্য মনে করেন। এমন একজন বয়স্ক মানুষের কথা শুনছিলাম, উনি যখন দেশের বাইরে ছেলের সাথে থাকতে আসেন, নিজে হাঁটাচলা থেকে সব কাজ নিজেই করেন, উনার সেই জোরও থাকে, কিন্তু দেশে গেলেই উইল চেয়ার আর হেল্পিং হ্যান্ড ছাড়া চলতে পারেন না।

অনেক কিছুই পারস্পেক্টিভের উপর ডিপেন্ড করে। আমাদের সোসাইটাল ফ্রেমওয়ার্কেও আমরা বুড়োদের জরাগ্রস্ত দেখে অভ্যস্থ। অনেক সময় আদর করে বলি, থাক, সারাজীবন অনেক পরিশ্রম করেছে, এখন এভাবেই কাটাক বাকী জীবন। কিন্তু এতে ক্ষতি বৈ, লাভের কিছু হয় না। এখানে অনেক বয়স্ক লোকজন সাইক্লিং করে, লাঠিতে ভর দিয়ে হলেও হাঁটতে বের হয় নিয়ম করে, একটা বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে টুকটুক করে বাজার করে ফেরে, বাগান করে, লন পরিস্কার কর্‌ শারীরিক পরিশ্রমের কাজগুলোও ২০ বছুরের মতো না হলেও ধীরে সুস্থে নিজের মতো করে করে, কোন অভিযোগ নাই। স্পাউস বেঁচে থাকলে, দুইজন হাত ধরাধরি করে হাঁটতে বের হয়, বিকালে বারান্দায় বসে চা খেতেখেতে গল্প করে। এদের দেখতেই ভালো লাগে।

যে পরিমান এক্টিভ জীবন যাপন এরা করে, এই এক্টিভনেসই এদের রেষ্ট অফ দ্যা লাইফ সতেজ রাখে। হ্যাঁ, এদের ছেলেমেয়েরা এদের সাথে থাকে না, বা এদের সোশাল লাইফ অনেক লোনলি, কিন্তু এইগুলা ফ্যক্টর কেন আমাদের দেশী সমবয়সী একজন মানুষকে স্থবির করে ফেলবে! যেখানে তাকে আরো চাঙ্গা করার কথা!

সাইকোলজি বলে, এক্টিভনেস একজন মানুষের লাইফে প্রান এনে দেয়। আপনি সারাজীবন চাকরি-বাকরি করেছেন? এখন রিটায়ার্ড লাইফ কাটাচ্ছেন ভালো কথা, কিন্তু মিনিংফুল কাজে আত্ননিয়োগ করুন। এমন কাজ করুন, যেটা আপনার লাইফের মিনিং ক্রিয়েট করবে। নইলে অন্য কেউ না হলেও নিজেই নিজেকে মূল্যহীন মনে করতে থাকবেন। সেটা শারীরিক বা মানসিক কোন দিক থেকেই কাজের কিছু না।

সব সময় সবকিছুর মূল্য যে টাকায় হতে হবে, এমন না। আপনার মানি ইনকামিং না হলেও যদি আপনি কোন কাজে আত্মতৃপ্তি পান, সেটাই বড় কথা (তাই বলে খালি আড্ডা, গল্প-গুজব, অন্যের সমালোচনায় টাইম পাস না, বরং এমন কাজ যাতে গোটা সমাজ উপকৃত হয়)। সেজন্য আসলে প্রিপারেশন নিতে হয় অনেক অনেক আগে থেকে। তরুন বয়স থেকেই এমন কিছু স্কিল অর্জন করা, যেগুলো একটা বয়সে যেয়ে তাকে আর্থিক দিকে থেকে সচ্ছলতা না দিলেও মানসিকভাবে ভালো রাখবে।

বয়স্ক মানুষ যারা সারাজীবন নানা রকম অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তারা চাইলেই সোসাইটিতে কন্ট্রিবিউট করতে পারেন। এখানে পয়সার বিনিময়ে চাকরীর কথা বলা হচ্ছে না, আপনি কোথাও ভলিন্টিয়ারিং করতে পারেন, পড়াতে পারেন, শেখাতে পারেন। একটা সময় যে পয়সা উপার্জনের চেয়ে মেন্টাল স্যাটিসফেকশন বেশী কাজে লাগে, এটা আমরা সময় থাকতে থাকতে ভুলে যাই দেখে, বয়সকালে অন্যদের উপর নির্ভরতা আশা করতে থাকি আর না পেলে হা-হুতাশ করি। এখানে লোনলি বুড়োদের নিজের কাজ নিজে করার জন্য যে আত্মতৃপ্তিময় চোখ দেখি, আমাদের দেশের অনেক বয়স্ক হতাশাময় চোখের থেকে তা ঢের ভালো। আল্লাহ যতদিন হায়াত রেখেছেন, বাঁচার মতো বাঁচার চেষ্টা হওয়াই উচিত।

একজন ১০৫ বছর বয়সী জাপানী ডাক্তারের কথা শেয়ার করেছিলাম একবার, যার হেলদি লাইফের জন্য অনেকগুলো টিপসের মধ্যে একটা ছিলো- কাজ থেকে দেরী করে অবসর নিন। ভদ্রলোক নিজেই মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে অবসর নিয়েছিলেন। দেরী করে অবসর নেওয়ার অর্থ এই না, যে আরো কিছু টাকা ইনকাম করেন, আরো গোটা দুই বাড়ী-গাড়ী করেন, বরং এর অর্থ- জীবনকে সচল রাখুন, ভ্যালু এড করুন সোসাইটিতে, আপনি দুনিয়ায় না থাকলেও যা আপনার জন্য সাদকায়ে জারিয়া হিসেবে কাজ করে। সেখানে আমাদের দেশে ৬৫ প্লাস হলেই লোকজনের যে হাহাকার শুরু হয়, ১০৫ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে থাকতে আশেপাশের মানুষজনকে অস্থির বানিয়ে ফেলে। কারন একটাই। লাইফের কোন স্পেসিফিক মিনিং নাই।

দুনিয়াতে আমাদের জীবনটা আল্লাহ খালি জৈবিক চাহিদা পূরন আর অর্থ উপার্জনের জন্য বানান নি। এর মধ্যে সীমিত থাকলেই খালি একটা বয়সে পয়সা কামাই, সময়মতো বিয়ে-শাদী, বাচ্চা-কাচ্চা বড় করা, একসময় নাতি-নাতনীর মুখ দেখা আর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা, এর বাইরে আর কিছু থাকে না। অবশ্যই মানুষের জীবন তার চাইতেও অনেক অনেক বেশী মূল্যবান।

কোন কাজ যদি খুঁজে নাও পাই, অন্তত যতদিন বেঁচে আছি, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মজবুত করার চেষ্টা করি, অন্তত মৃত্যু আসার আগ পর্যন্ত জীবনের মানে খুঁজে বেড়াই, তাও বা কম কিসে!