মসজিদের জন্য ভালোবাসা

যখন দেশে ছিলাম ধারণা ছিলো মসজিদ মানে শুধু ছেলেদের নামাজ পড়ার জায়গা। আজ থেকে আট বছরের অধিক আগে যখন দেশ ছাড়লাম তখন থেকে আস্তে আস্তে যেন মসজিদের প্রতি ধারণাটা বদলে যেতে লাগলো।

প্রথম যখন কোরিয়াতে প্রিয় এক আপু আর ভাইয়া মুসল্লায় (উল্লেখ্য উলসান শহরে কোন মসজিদ ছিলোনা) গিয়ে নামাজ পড়ার কথা বললেন, আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। যাই হোক মুসল্লায় নামাজ পরতে গিয়ে আপুকে বললাম জামায়াতে কিভাবে নামাজ পরে আমি তো তাই জানিনা। আলহামদুলিল্লাহ্‌ আপু শিখিয়ে দিলেন কিভাবে ইমামের সাথে নামাজ পরবো।

এরপর একদিন এক ভাই বললেন গেট টুগেদার হবে মুসল্লায়। আমি অবাক গেট টুগেদার তাও মুসল্লায় কিভাবে সম্ভব?? ভাই তখন বুঝিয়ে বললেন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা) এর সময় কিভাবে মসজিদ ছিলো সবকিছুর প্রানকেন্দ্র।

সেই থেকে একটু একটু করে মসজিদের সাথে আমার ভালোবাসার সম্পর্কের শুরু। একসময় সেই ছোট এক রুমের মুসল্লায় আমরা একসাথে নামাজ পরতাম, তাজউইদ ক্লাস করতাম, একসাথে সবাই মিলে খাওয়া দাওয়ার প্রোগ্রাম করতাম, ইফতার করতাম, ইসলামিক আলোচনা করতাম। এভাবে এটাচমেন্ট তৈরি হতে হতে খেয়াল করতাম কোরিয়ার রিসার্চ স্ট্রেস থেকে নিমিষে মুক্তি পেয়ে যেতাম যখন ঐ ছোট মুসল্লার নীল কার্পেটে কপাল ও নাক দিয়ে সিজদাবনত হয়ে আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করতাম।

কোরিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার সময় আমরা জামাই বউ দুইজনই মসজিদে ঢুকে নামাজ পড়তে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে দিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো কিছু ভালো মানুষের সাথে সাথে যেন পরম নির্ভরতার এক জায়গা ছেড়ে যাচ্ছি। সেই জায়গা যেখান থেকে আমাদের দুইজনের প্রত্যাবর্তনের শুরু।

সময়ের পরিক্রমায় একসময় অস্ট্রেলিয়া এসে হাজির হলাম। প্রথম দিনের ইউনিভার্সিটির মুসল্লায় গিয়ে খুব ভালো লাগছিলো। এর সাথে পেলাম স্ল্যাকস ক্রিক মসজিদ – ভালোবাসার আরেক জায়গা। আমার মনে আছে, যাইনাব পেটে থাকতে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে মাঝে মাঝে শরীর খুব ক্লান্ত লাগলে মুসল্লায় গিয়ে একটু রেস্ট নিয়ে নামাজে দাঁড়ালেই অনেক আরামবোধ করতাম।

এই মুসল্লায় আর স্ল্যাকস ক্রিক মসজিদে অনেক দেশের বোন পেয়েছি, অনেকে মিলে একসাথে ইফতার করেছি, ইসলামিক প্রোগ্রাম করেছি। সবচেয়ে বড় কথা হলো খুব কষ্ট নিয়ে গিয়ে যখন এইসব জায়গার লাল, নীল কিংবা সবুজ কার্পেটে সিজদা দিয়েছি, মনে হয়েছে এক নতুন শক্তি নিয়ে কষ্টকে জয় করেছি।

যাইনাব হওয়ার পর থেকেই ওকে নিয়ে আমরা মসজিদে যাই। মসজিদের কার্পেটে যাইনাব ঘুমিয়েছে, হামাগুড়ি দিয়েছে, হেঁটে বেড়িয়েছে আর এখন তো রীতিমতো হিজাব পরে দৌড়ে বেড়ায় আর মন চাইলে এক/দুইটা সিজদা দেয়। অস্ট্রেলিয়াতে স্ল্যাকস ক্রিক মসজিদে আমি একদিন এক প্রিয় বোনকে বলছিলাম “তোমার টেনশান লাগেনা সাফওয়ান যে এইভাবে দৌড়াদৌড়ি করে। যদি পার্কিং লটে চলে যায়”। তখন আমাকে বোন উত্তর দিয়েছিলো “মসজিদেই তো আছি নাঈমা। তাই আসার সময় দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দেই। ব্যস আমার কাজ শেষ। এখন আল্লাহই দেখে রাখবেন”। তখনের প্রেগন্যান্ট আমি এখন নিজেও দোয়া পড়ে মেয়েকে ছেড়ে দেই। কারণ এটা মসজিদ। আল্লাহ্‌র প্রিয় জায়গা – আমাদের ভালোবাসার জায়গা।

মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে মারা গিয়েছে যারা তাঁরা আসলে বেঁচে গিয়েছেন। নামাজ পড়তে গিয়ে মসজিদে শুক্রবারের মৃত্যু, সুবহানাল্লাহ। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তাঁদেরকে শহীদ হিসেবে কবুল করে নিবেন। তাঁদের জন্য দোয়া করার পাশাপাশি আরেকটা কাজও করতে হবে তা হলো ভয় পেলে চলবেনা। মসজিদ যেমন আমাদের সবকিছুর প্রানকেন্দ্র ছিলো তেমনই থাকবে।

আমাদের বাচ্চারা এই মসজিদকে মায়ের গর্ভ থেকে চিনবে, এই মসজিদে হাঁটবে, দৌড়াবে, কুরআন শিখবে। আমরা মায়েরা দোয়া পড়ে বাচ্চাদের নির্বিঘ্নে ছেড়ে দিবো। আমাদের বাচ্চারা মসজিদের সাথে আত্মার সম্পর্ক গড়ে তুলবে, মসজিদকে ভালোবাসবে, মসজিদ কেন্দ্রিক হবে তাঁদের জীবন ইন শা আল্লাহ্।

আল্লাহ্‌ আমাদেরকে শক্তি দিক। আমীন।


মসজিদের জন্য ভালোবাসা
-নাঈমা আলমগীর

(১৬/০৩/২০১৯)