সময় ব্যাবস্থাপনার অদ্যোপান্ত

যোবায়দা হোসেন

আজকাল আমরা সবাই কমবেশি একটা কমন রোগে আক্রান্ত, যার নাম “সময় পাইনা” রোগ। কিছুটা সত্য, কিছুটা অসত্য মিলিয়ে আমাদের এই রোগ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আসলেই কি আমরা এতটাই ব্যস্ত? আসলেই কি আমরা সময় পাই না? নাকি সময় পেতে চাইনা?

আল্লাহ প্রদত্ত যে সব সম্পদ বা রিসোর্সগুলো আমাদের আছে তার মধ্যে “সময়” অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রিসোর্স। এ এক অদ্ভুত রিসোর্স! ভেবে দেখুন, কোটিপতি থেকে শুরু করে রাস্তার ভিখারী, কোন প্রতিষ্ঠানের প্রধান থেকে শুরু করে কর্মচারী, বাড়ির সবচে ব্যস্ত সদস্য থেকে শুরু করে সবচে inactive সদস্য- সবার দিন কিন্তু ওই ২৪ ঘন্টায়ই হয়, সপ্তাহ হয় ৭ দিনে। কিন্তু দেখা যায়, কেউ ২৪ ঘন্টায় কেউ তার ন্যুনতম বেসিক কাজগুলো সামলাতেও হিমশিম খায়, ওই এক ২৪ ঘন্টায় কেউ আবার অনেক বেসিকের পরেও অনেক কাজ করে ফেলতে পারে। আমরা বলি, “কিভাবে সম্ভব?” সম্ভব, যদি সময় ব্যবস্থাপনার কাজ টা সুন্দরভাবে করা যায়।

“টাইম ম্যানেজমেন্ট’ লিখে নেট এ সার্চ দিলে পাবেন অসংখ্য ডকুমেন্ট, মিস্টার গুগল খুঁজে আনবেন অসংখ্য আর্টিকেল, ইউটিউব এনে দেবে নানা ভাষার নানান ভিডিও। সেসব কিছুর সমন্বয়ে আমি আজকে আমার মতো করে “টাইম ম্যানেজমেন্ট” ব্যাখ্যা করবো। আমি সময় ব্যবস্থাপনায় একেবারেই কাঁচা। তাই নিজের জন্য গাইডলাইন হিসেবেই এই লেখা লিখতে বসেছি। আমার এই লেখা পড়ে কেউ যদি তার টাইম ম্যানেজমেন্টে কিছুটা উপকৃত হন কিংবা এ নিয়ে নতুন করে ভাবেন, সেটাই হবে আমার জন্য অনেক বড় একটা পাওয়া।

আমি ব্যক্তিগতভাবে টাইম ম্যানেজমেন্টের বহুল প্রচলিত একটা টুল বিশেষভাবে পছন্দ করি, তার নাম “আইজেনহাওয়ার ডিসিশন ম্যাট্রিক্স” (Eisenhour Decision Matrix)। এই ম্যাট্রিক্স এর নাম রাখা হয়েছে Dwight D. Eisenhour এর নামে যিনি ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৪ তম রাষ্ট্রপতি। এক জীবনে তিনি আরো অনেক গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন মার্কিন সেনাবাহিনীর আর্মি জেনারেল, ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষের হয়ে ইউরোপে সুপ্রিম কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং উত্তর আফ্রিকা, জার্মানি ও ফ্রান্সের আক্রমণে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, ছিলেন ন্যাটোর সুপ্রিম কমান্ডার, ছিলেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টও। একজীবনে এতগুলো কাজ করেছেন, সময়ের সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই।

আপনার জীবনের সমস্ত কাজকে সময় অনুযায়ী গুছানোর মূলসুত্র হলো কাজের গুরুত্ব বোঝা এবং প্রায়োরিটি সেট করা। “আইজেনহাওয়ার ডিসিশন ম্যাট্রিক্স” অনুযায়ী, আপনার সমস্ত কাজকে প্রধানত দুইটা ভাগে ভাগ করে ফেলতে হবে- এক হলো গুরুত্বপূর্ণ বা Important, দুই হলো জরুরী বা Urgent. এবার সমস্ত কাজকে আইজেনহাওয়ার ম্যাট্রিক্স এর চারটি ভাগের কোন একটিতে সেট করতে হবে, এবং সেই অনুযায়ী এগুতে হবে।

এই ম্যাট্রিক্সের ৪টা কোয়াড্রেন্ট বা ৪টা ভাগ আছে, একে একে ভাগগুলোয় আসি,

1st quadrant বা প্রথম চতুর্ভাগ
এই ভাগে পড়বে সেই কাজগুলো যেগুলো আপনার জন্য একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ (Important) এবং জরুরী (Urgent). অর্থাৎ সেই কাজগুলো যেগুলো ইমিডিয়েটলি শেষ করতে হবে, এবং যেগুলো আপনি ছাড়া আর কেউ করতে পারবেনা।
উদাহরণস্বরুপ- একজন স্টুডেন্ট এর জন্য সবচে জরুরী আর গুরুত্বপূর্ণ তার আসন্ন পরীক্ষা, অথবা তার থিসিস, আসন্ন ডেডলাইন; একজন চাকরীজীবির ক্ষেত্রে তার অফিসিয়াল কোন ডেডলাইন, রিপোর্ট সাবমিশন; গৃহকর্ত্রীর জন্য তার বাড়ির সংসারের নৈমিত্তিক কাজগুলো যেগুলো তিনি আর কারো কাছে ডেলিগেট করতে পারবেন না ইত্যাদি।

এই লিস্টের জন্য স্ট্র্যাটেজি হলো – Do, এই কাজগুলো সবসময়ই থাকবে প্রায়োরিটি লিস্ট এর শীর্ষে, এবং এই কাজগুলো সবার আগে শেষ করতে হবে। তাই এই লিস্টটা করতে হবে বুঝেশুনে। একগাদা অর্থহীন কাজ দিয়ে এই লিস্ট ভরানো যাবেনা, তাহলে আপনি আবারো সেই “সময় পাইনা” চক্রে পড়ে যাবেন।

2nd quadrant বা দ্বিতীয় চতুর্ভাগ
মজার ব্যাপার হলো, এটাকে দ্বিতীয় চতুর্ভাগ বললেও সময়কে সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানোর মূলসুত্র আছে এখানেই এবং এটাই এই ম্যাট্রিক্সের সবচে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।এখানে আপনি এমন সব কাজকে সেট করবেন যেগুলো এই মুহুর্তে সবচে দরকারী না, কিন্তু আপনার জীবনের জন্য দীর্ঘমেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ।
উদাহরণস্বরুপ- এখানে স্থান পাবে আপনার পরিবারের আপনজনদের সাথে যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক তৈরি সম্পর্কিত কাজগুলো। আপনজনরা সবসময়ই গুরুত্বপুর্ণ, তাই হাজার জরুরী কাজের ভীড়েও এই বিষয়ে সবসময় সচেতন থাকা প্রয়োজন।
এখানে আরো স্থান পেতে পারে, আপনার জীবনে কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকলে, সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো। যেমন- আপনি নতুন কোন স্কিল ডেভেলপ করতে চান, কোন নতুন ভাষা কিংবা সফটওয়ার শিখতে চান, কাজের পাশাপাশি ছোটখাট কোন ব্যবসা স্টার্ট করতে চান, সমাজসেবামূলক কিছু করতে চান, আত্মোন্নয়ন করতে চান- ইত্যাদি এই সবই স্থান পাবে এই চতুর্ভাগে।

এই লিস্টের জন্য স্ট্র্যাটেজি হলো – Plan, এই লিস্টের কাজগুলো আপনাকে সম্পন্ন করতে হবে সুপরিকল্পনার মাধ্যমে। সময়ের পরিক্রমায় এই কাজগুলোও একসময় হয়ে উঠবে urgent and Important এবং চলে যাবে প্রথম চতুর্ভাগে।

3rd Quadrant বা তৃতীয় চতুর্ভাগ
এই ভাগে আসবে আপনার সেই কাজগুলো যেগুলো খুব জরুরী, কিন্তু তেমন গুরুত্বপূর্ণ না, অন্য কাউকে দিয়েও করানো যেতে পারে। যেমন- আপনার কোন রিপোর্ট টাইপিং, বা কোন গৎবাঁধা রিপোর্ট লেখার কাজ সেটা বুঝিয়ে দিতে পারেন আপনার সাবঅর্ডিনেট কে, বাসাবাড়ির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ, রুটিন ওয়ার্ক তুলে দিতে পারেন গৃহকর্মীর হাতে, সাপ্তাহিক গ্রোসারি শপিং করতে পারেন অনলাইন/হোম ডেলিভারির সাহায্যে।

এই কাজগুলোর ক্ষেত্রে আপনার স্ট্রাটেজি হবে Delegate করা বা অন্য কাউকে বুঝিয়ে দেয়া।এই লিস্টের কাজ সম্পন্ন করতে আপনার ম্যানেজমেন্ট স্কিল খুব ভালো কাজে লাগবে।

4th Quadrant বা চতুর্থ চতুর্ভাগ
স্বভাবতই এই গ্রুপে পড়বে সেই কাজগুলো যেগুলোর আদতে কোন urgency বা importance নেই, সর্বোপরি যেগুলোর মাঝে কোন কল্যাণ নেই। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আমাদের জীবনে এইরকমই অসংখ্য কাজ রয়েছে যার পিছনে আমরা আমাদের মূল্যবান অনেকটা সময় ব্যয় করে ফেলি, কিন্তু টেরই পাইনা।

উদাহরণ দিবো? ঘণ্টার পর ঘন্টা ফেসবুক নিউজফিড স্ক্রল করে যাওয়া, ইউটিউবে একের পর এক অর্থহীন ভিডিও দেখে যাওয়া, অতিরিক্ত আড্ডায়, পরচর্চা-গসিপে সময় পার করা, অর্থহীন তর্ক-বিতর্ক করা, oversleeping, আলসেমিতে সময় কাটানো ইত্যাদি। ভেবে দেখুন তো এই কাজগুলোর পিছনে আপনি প্রতিদিন ঠিক কতটা সময় নষ্ট করছেন, এবং তাতে আদৌ কোন কল্যান পাচ্ছেন কি? পাচ্ছেন না তো?
এরকম কাজগুলোর জন্য একটাই স্ট্র্যাটেজি-Delete. এই লিস্টের কাজগুলো যথাসম্ভব জীবন থেকে ডিলিট করে ফেলুন। যদি একবারে ডিলিট করতে নাও পারেন তাহলে অন্তত কন্ট্রোল করুন, খেয়াল রাখুন এর পেছনে কত সময় ব্যয় হচ্ছে, সেই অনুযায়ী সময় ব্যয় কমিয়ে ফেলুন। দেখবেন, হাতে অনেকটা বাড়তি সময় চলে এসেছে।

এতক্ষণ অনেক কথা বলে ফেললাম, আমাদের জীবনের কাজগুলোকে মোটাদাগে এই ৪টা ভাগে ভাগ করে প্ল্যানিং করাই যেতে পারে। শেষ করবো কিছু সাধারণ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট দিয়ে-

১। নিজের জীবনের একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করা প্রয়োজন সবার আগে, আপনি জীবনে কি হতে চান?কি করতে চান? লক্ষ্য স্থির হলে তখন কাজের প্রায়োরিটি সেট করা সহজ হয়, এবং সেই অনুযায়ী টাইম ম্যানেজমেন্ট করাও সহজতর হয়।

২। আপনার নিজের শরীরের যত্ন নেয়া, সময়মতো খাওয়া, পরিমিত ঘুম, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন এসব কাজ সবসময়ই আপনার জন্য Urgent and Important। নিজেই যদি সুস্থ না থাকেন তাহলে আর এত টাইম ম্যানেজমেন্ট করে কি হবে বলুন?

৩। জীবনের প্রতি সবসময় সবারই পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গী থাকা প্রয়োজন, আশাবাদী হওয়া প্রয়োজন। একজন নেগেটিভ মানুষ, হতাশবাদী মানুষ খুব ভালো আউটপুট দিতে পারেনা।

জানি, বলা সহজ কিন্তু করা কঠিন। তাই হয়তো জীবনের সব কাজকে একেবারে খাপ খাপে মিলিয়ে এভাবে প্ল্যানিং করা যাবেনা। আমাদের সময়কে ঠিকভাবে কাজে লাগালে লাভবান হবো আমরাই, অযথা সময় নষ্ট করলেও ক্ষতিগ্রস্থ হবো কিন্তু আমরাই। তাই নিজের কিছুটা চেষ্টা, আন্তরিকতা, সদিচ্ছার মাধ্যমেই জীবনের এই অমূল্য সম্পদ সময়ের সঠিক ব্যবস্থাপনা করার চেষ্টা করি, জীবন অনেকাংশেই সহজ হয়ে যায়।