সুন্দরীতমা

আমার নানুর মুখে বসন্তের কিছু দাগ আছে । নানুকে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, এই দাগগুলো কি নানুর বিয়ের আগে না পরে । নানু বললেন এগুলো বিয়ের আগের । খুব ছোটবেলায় চিকেন পক্স হয়, সে থেকেই দাগগুলো উনার নিত্যসঙ্গী । নানুকে বললাম, আপনার এই দাগগুলো দেখেও নানা ভাই আপনাকে বিয়ে করলো ! নানু হেসে বললেন – “তোর নানা বড় আলা ভোলা কিসিমের (ভালো) মানুষ, আল্লাহর ওয়াস্তে (সন্তুষ্টি) উনি আমাকে বিয়ে করেছেন তা না হলে হয়তো এ জীবনে কুমারী অবস্থাতেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতাম “।

মানুষ ফিতরাতগত ভাবে সুন্দরের পূজারী । আর তাই বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে গেলে প্রথমেই নিশ্চিত করতে চান মেয়ে উঁচা, ফর্সা, সুন্দরী …ইত্যাদি ইত্যাদি । এ ব্যপারে বেদ্বীন পরিবারগুলো বেশ সরস থাকলেও দ্বীনি পরিবারগুলোও যেন থেমে নেই । অথচ স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বিয়ের ক্ষেত্রে দ্বীনদারিতা কে প্রাধান্য দিতে ।

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, চারটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে মেয়েদেরকে বিয়ে করা হয়ঃ তার সম্পদ, তার বংশমর্যাদা, তার সৌন্দর্য ও তার দ্বীনদারী । সুতরাং তুমি দ্বীনদারীকেই প্রাধান্য দিবে নতুবা তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। [সহিহ বুখারী, ৫০৯০]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জন্মের পর থেকে দেখা-শোনা করা আবিসিনিয়ান কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েটির নাম ছিলো ‘বারাকাহ্’ , পরবর্তীতে যাঁকে ‘উম্মে আইমান’ (রাঃ) নামে ডাকা হতো । তাঁর ব্যপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন “তোমাদের মধ্য হতে কেউ যদি জান্নাতের কোন রমনীকে বিয়ে করতে চাও তবে সে যেন উম্মে আইমান কে বিয়ে করে ।”

উম্মে আইমান (রাঃ) তখন পঞ্চাশোর্ধ সদ্য বিধবা । তাঁকে বিয়ে করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের পালিত পুত্র যা’ইদ বিন হারিসা (রাঃ) । তাঁদের দু’জনের মধ্যকার বয়সের ব্যবধান, উম্মে আইমানের গায়ের রং এবং বয়সের ছাপ কোনওটি যেন বাঁধা হয়ে দাঁড়তে পারলোনা । দাম্পত্য জীবনে তাঁরা (রাঃ) ছিলেন বেশ সুখী এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা থেকে প্রতিদান স্বরুপ তাঁদের কোল জুড়ে আসে উসামা বিন যা’ইদ – এর মত নেক সন্তান ।

এ তো গেলো পুরুষদের পছন্দ অপছন্দের কথা । নারীরাও বিয়ের জন্য পটেনশিয়াল পাত্রের ব্যপারে যে জিনিসের ছাড় কোন ভাবেই দেয়না তা হলো, সম্পদ ও সামাজিক মর্যাদা । ছেলের আয়-রোজগার একটা বড় ফ্যাক্টর হলেও তার পাশাপাশি ছেলের পরিবার, সামাজিক স্ট্যাটাস এগুলো বিশাল ভূমিকা রাখে দ্বীনি এবং বেদ্বীন উভয় পরিবারে । বেকার ছেলে কিংবা সামাজিক মর্যাদা নিচু স্তরের এরকম ছেলে আল্লাহ ভীরু হলেও কোন পরিবার পাত্রস্থ করতে চায়না । কিছু কিছু পরিবারের জন্য তো পাত্র আল্লাহ ভীরু কিংবা দ্বীনি হলে সাথে সাথে বাদের খাতায় চলে যায় ।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় একজন সাহাবী ছিলেন যাঁর নাম ছিলো ‘জুলাইবিব’ । তিনি (রাঃ) দেখতে মোটেই সুশ্রী ছিলেন না এবং শারীরিক গঠন ছিলো কিঞ্চিৎ বেঁটে প্রকৃতির । তাঁর বাহ্যিক গঠন কিছু লোকজনের নিকট এতটাই বিরক্তির কারন ছিলো যে মদীনায় বসবাসকারী এক লোক তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, জুলাইবিব কে বলবে আমার সামনে না আসতে । যদি আসে আমি বোধ হয় নিজের রাগ কে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ওকে মেরেই বসবো । কোন মর্যাদাবান বংশের অধিকারীও তিনি ছিলেন না অর্থাৎ সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে তিনি (রাঃ) ছিলেন একেবারেই নিচের দিকের । এরুপ একটা লোক কে কোন বাবাই নিজের মেয়ের হাত সঁপে দিবেন না এটা নিশ্চিত ।

একদিন পথিমধ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তাঁর (রাঃ) দেখা হয় । সালাম ও কুশলাদি বিনিময়ের পর তিনি (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করেন “ ইয়া রাসুলাল্লাহ ! আমার কি এ জীবনে আর বিয়ে হবেনা “ ? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথা শুনে সোজা চলে যান মদীনার তৎকালীন সম্ভ্রান্ত বংশের বিবাহ যোগ্য এক সুন্দরী কন্যার পিতার কাছে । লোকটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে দেখে আনন্দিত হয়ে জানতে চাইলো, কিসে তাঁকে (সাঃ) আজ তার বাড়িতে নিয়ে এসেছে । রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাবে বললেন “ তোমার কন্যার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি “। লোকটি আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন “ এ তো আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের “। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন “ এ প্রস্তাব আমার জন্য নয় । এটি বরং জুলাইবিবের জন্য “। লোকটির চেহারা নিমেষেই মলিন হয়ে গেলো । তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট ভেতরে গিয়ে কন্যার মায়ের সাথে পরামর্শের অনুমতি চাইলেন । কন্যার মা জুলাইবিবের কথা শুনে রাগান্বিত হয়ে প্রস্তাব তৎক্ষনাত নাকোচ করে দিলেন । রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা শুনতে পেয়ে সাথে সাথে প্রস্থান করলেন । কন্যা আড়াল থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার পিতা-মাতার মধ্যকার আলাপগুলো শুনছিলো । সব শুনে সে তার পিতা-মাতার উদ্দেশ্যে বিস্ময় ভরা কন্ঠে বললো – “ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে এসে একজনের হয়ে আমার জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন আর আপনারা তাঁকে (সাঃ) ফিরিয়ে দিলেন ?!!! আল্লাহর কসম, আমি যদি কাউকে বিয়ে করি তবে সে হবে শুধু জুলাইবিব “।

বিয়ের দিন জিহাদের ডাক আসায় বিয়ে ফেলে রেখেই জিহাদে ছুটে যান সাহাবী জুলাইবিব (রাঃ) যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের নজরে আসে । জিহাদ শেষে সবাই সবার পরিবারের লোকজনদের খুঁজছিলেন । রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুঁজছিলেন তাঁকে । অবশেষে জুলাইবিব (রাঃ) কে আবিষ্কার করেন জিহাদের ময়দানে শহীদ অবস্থায় । এই সেই জুলাইবিব (রাঃ), মৃত্যুর পর যাঁর বিছানা হয়েছিলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুটো হাত । তিনি (সাঃ) অঝোরে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন “ জুলাইবিব আমার (পরিবার), আমি জুলাইবিবের (পরিবার) “।

দুনিয়াবী দৃষ্টিতে সামাজিক মর্যাদাহীন, কুশ্রী একজন সাধারন মানুষ কে আল্লাহর নবী (সাঃ) ভালোবেসে তাঁর জন্য চোখের পানি ফেলেছেন, তাঁকে নিজ পরিবারের অংশ মনে করেছেন এবং তাঁকে মৃত্যুর পর নিজ হাতে দাফন করেছেন ।

আমরা বাহ্যিক সৌন্দর্য, সম্পদ ও সামাজিক মর্যাদা কে এত বেশি প্রাধান্য দেই অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে তার সিকি ভাগ মূল্যও থাকেনা । আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের দেহ এবং তোমাদের আকৃতি দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন।’’ [ বুখারী, মুসলিম ]

আর যারা নিজের শারীরিক গঠন নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগেন তাদের জন্য একটি রিমাইন্ডার দিয়ে শেষ করছি । কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা বলে দিয়েছেন –

“ আমি মানুষ কে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম অবয়বে “
[ সুরা আত-তীন, ৪]

সারা দুনিয়ার মানুষ আপনার দিকে আঙ্গুল তুলুক, আপনাকে অপছন্দ করুক, কিন্তু আপনি জেনে নিন – আপনার রব যখন বলেছেন, তিনি আপনাকে সুন্দর করে বানিয়েছেন তবে আপনি সুন্দর, আপনি অবশ্যই সুন্দর ।

……………

সুন্দরীতমা
-নুসরাত জাহান

(২৩/০৩/২০১৯)