স্মার্ট ফোন – এক ডিজিটাল কারাগার

নাঈমা আলমগীর

ডিজিটাল যুগে আমরা সবাই এখন কম বেশী খুব সচেতন বাচ্চাদের স্ক্রীন টাইম আসক্তি নিয়ে। একে এখন বলা হয় “ডিজিটাল ড্রাগ বা ডিজিটাল হেরোইন”। বাচ্চাদের উপর এর প্রভাব নিয়ে আমরা এখানে সেখানে অনেক সচেতনতামূলক লেখা দেখি। কিন্তু আমরা কি নিজেদের দিকে কখনও তাকিয়ে দেখেছি যে আমরা বড়রাও কম বেশী এই ডিজিটাল ড্রাগে আসক্ত!!!

আমি আপনি যেন এক ডিজিটাল কারাগারে বন্দী হয়ে আছি। আমাদের দিন চলেনা এইসব মোবাইল, ট্যাব, নেটবুক, ল্যাপটপ এইসব ছাড়া। আমি কখনই বলছিনা যে এগুলোর কোন দরকার নেই। কিন্তু পরিমিত আর প্রয়োজনীয় ব্যবহারের বদলে আমরা দিন দিন আসক্ত হয়ে যাচ্ছি এইসব যন্ত্রের প্রতি; বিশেষ ভাবে আমাদের স্মার্ট ফোনের প্রতি। আমাদের সবসময়ের সংগী এই ফোন কখন যে আমাদেরকে কারাগারের মতো বন্দী করে ফেলেছে তা আমরা নিজেরাও বুঝতে পারিনা।

একটি গবেষণার রেজাল্টে দেখা যায়, ৪০% মানুষ দিন রাত ২৪/৭ মোবাইল তাদের সাথে রাখে; ৮৩% মানুষ মাথার কাছে মোবাইল নিয়ে ঘুমায়; ৩৫% মানুষ সকালে উঠে বিছানা ত্যাগ করার আগে মোবাইল ব্যবহার করে। ৫০% এর বেশী মানুষ সমনা সামনি যোগাযোগের চেয়ে মোবাইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করাকে বেশী প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। ৬০% মানুষ সোশ্যাল এক্টিভিটিজ (গেট টুগেদার, ফ্যামিলি ডীনার সহ অন্যান্য কাজ) এ তাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে থাকে।

এই ৬০% মানুষের মধ্যে হয়তো আমি আপনিও কখনও কখনও পড়ে যাই। একটু চিন্তা করে দেখুন তো এমন কি কখনও হয়নি যে ফ্যামিলি ডীনারে বসে গল্প করার বদলে হয়তো স্বামী স্ত্রী স্মার্ট ফোনে ব্যস্ত ছিলেন।

কারাগারে যেমন এক সেলের মানুষ পাশের সেলের মানুষকে দেখতে পায়না। ঠিক তেমনি ডিজিটাল কারাগারে স্মার্ট ফোন নামক অদৃশ্য দেয়ালের জন্য আমরা একে অপরের সাথে থেকেও যেন একে অপরের থেকে দূরে। ইদানীং অনেক সময় পাবলিক প্লেসে দেখা যায় বাচ্চার খেলার আহবানে বাবা মা সাড়া না দিয়ে নিজের মতো স্মার্ট ফোনে মগ্ন আছে কিংবা দিলেও তা হয়তো কয়েকটা ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়াতে আপ্লোডেই সীমাবদ্ধ।

“Distracted Parent Syndrome” কথাটার নাম শুনেছেন? মানে হলো এই সিন্ড্রোমে আক্রান্ত প্যারেন্টস বাচ্চাকে তার চাহিদা মতো এটেনশান দিতে ব্যর্থ হয় স্ক্রীন আসক্তির জন্য। নিজেকে একবার বিচার করে দেখা উচিত যে আমি কিংবা আপনি এই সিনড্রোমে আক্রান্ত নইতো?

অতিরিক্ত ডিভাইস আসক্তির শারীরিক ও মানসিক অনেক প্রভাব আছে। মোবাইল ফোন থেকে বের হওয়া রেডিয়েশান এর সাথে ব্রেইন টিউমার বা ক্যান্সারের সরাসরি কোন সম্পর্ক আছে কিনা তা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও কিছুটা হলেও যে মানুষের ব্রেনে এসবের প্রভাব পড়ে সে বিষয়ে অনেক বিজ্ঞানীরা একমত।

British Chiropractic Association এর স্টাডি মতে অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারে ৪৫% ইয়াং জেনারেশান ব্যাক পেইনে ভুগছে। উদ্বেগ, ডিপ্রেশান, স্ট্রেস, মাথা ব্যথা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, ঘুমের সমস্যা এসব কিছুর পিছনে একটা বড় কারণ হলো এই মোবাইল ফোন আসক্তি।

সত্যিকারের কারাগারে অনেকদিন থাকা মানুষের মধ্যে যেমন আচরণগত অনেক পরিবর্তন দেখা যায়; ঠিক তেমনি মোবাইল নামক ডিজিটাল কারাগারে থেকে মানুষেরা বুঝতেও পারেনা যে আস্তে আস্তে তাঁদের আচরণ অনেক বদলে যাচ্ছে – যা হয়তো সবচেয়ে বেশী টের পায় কাছের মানুষেরা।

পরিশেষে একটা মজার কিন্তু ভয়াবহ তথ্য দেই। University of Arizona এর রিসার্চ অনুযায়ী একটা মোবাইল ফোনে ১০ গুন বেশী ব্যাকটেরিয়া থাকে টয়লেট সিটের তুলনায়!

তাই আসুন সবদিক বিবেচনা করে আমরা এই ডিজিটাল কারাগার থেকে বেরিয়ে আসি। কিভাবে? নিজেই খুঁজে বের করুন এর অল্টারনেটিভ; নিজেকে চিনুন আর বিকশিত করুন; নিজের ক্রিয়েটিভিটি কাজে লাগান; কাজ করুন নিজের মানসিক শান্তির জন্য সোশ্যাল মিডিয়াতে শো অফের জন্য না।