হেদায়েত, অতঃপর

আল্লাহ হেদায়েত দান করার পর একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, যারা আগে আমার বন্ধু-বান্ধবী ছিল, তারা অনেকেই আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলো। আগের মতো আড্ডা মারি না, ছেলে-মেয়ে মেশা পরিবেশে যেতে চাই না, গান শুনি না, টিভি দেখি না। আরো নানা ধরণের ধর্মীয় নিয়ম-কানুন মেনে চলতে চাই এবং অন্যদেরকেও সেগুলো করতে বলি।

তাই তারা ধরেই নিলো, আমি ‘ব্যাকডেটেড’ হয়ে গেছি। হাসি-তামাশা কিছুই আর বুঝি না। হুজুর বা হুজুরনি মানেই হলো অনুভূতি আর রসকষহীন মাথামোটা কিছু বস্তু, যাদের জীবনে আনন্দ-বিনোদনের কোনো স্থান নেই।


কথাটা কতবড় ভুল, সেটা যে তাদেরকে বোঝাব সে উপায়ও রইল না। যেহেতু তাদের ধারণা, বাই ডিফল্ট হুজুরদের মধ্যে চিন্তাশক্তির অভাব। সে গ্র্যাজুয়েট হোক বা পিএইচডি ডিগ্রিধারী হোক, ইট ডাজন্ট ম্যাটার, এই যুগে হুজুর হওয়া মানেই সে গোড়া। তাছাড়া হুজুরদের বাকশক্তি বলেও কিছু নেই, কাজেই কেউই হুজুরদের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলার পরিশ্রম করে না। দ্বীনের পথে পা বাড়াতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এতদিনের বন্ধুবান্ধবীরা আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলো।


প্রথম দিকে বিষয়টা বেশ কষ্ট দিতো। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ এর কয়েক বছর পর একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করলাম। আগের তুলনায় এখন মানুষ আমাকে অনেক বেশি বিশ্বাস করে। মানুষ তার ঘরের খবর, পরের খবর, পেটের খবর, পিঠের খবর, পারিবারিক বা ব্যক্তিগত এমন অনেক সমস্যার কথাই শেয়ার করে, যা নিজের আপন লোকের কাছেও বলার আগে দশ বার ভাববে।

আলহামদুলিল্লাহ, যারা নিজেরা দ্বীন মেনে চলে না, তারাও দ্বীনী লোকদের ব্যাপারে এটুকু আশা রাখে যে, আমরা অন্তত ওদের গোপন খবর মানুষকে বলে বেড়াবো না। আমাদের কাছে ওদের আমানতগুলো হেফাজতে থাকবে।


দ্বীনের লেবাসওয়ালা মানুষগুলোকে যে সবাই একটু বেশি বিশ্বাস করে এটা আরো অনেকেই বুঝে। এক শ্রেণির ধোঁকাবাজ আছে, যারা মানুষের আস্থা অর্জন করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে দ্বীনি মুখোশ ধরে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে।

তবে যাদের মনে আল্লাহর ভয় আছে, আর যারা সত্যিই আল্লাহর পথ বেছে নিয়েছে, তারা আমানত রক্ষা করতে সবসময় সচেষ্ট থাকে। তাই যারা দ্বীন মেনে চলতে আগ্রহী, তাদের উচিত মানুষের কথা রাখার ব্যাপারে সবসময় সতর্ক থাকা এবং আমানত রক্ষা করার ক্ষেত্রে সচেতন হওয়া। মানুষ আমাদেরকে যেমন বিশ্বস্ত মনে করে, আমরা যেন সেই বিশ্বস্ততার দাম দিই।

মনে রাখা দরকার, আল্লাহর রাসূল (সা) কে যখন মক্কার লোকেরা জানে মেরে ফেলার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, তখনও নিজের ধন-সম্পদের ব্যাপারে তাকেই সবাই বিশ্বাস করেছে। সত্যবাদিতা আর বিশ্বস্ততা অনেক বিশাল ব্যাপার। আল্লাহর রাসূল (সা) যদি সবসময় সত্যি কথা না বলতেন, এবং বিশ্বস্ত হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত না হতেন, তাহলে তাঁর নবুওয়াত আর রিসালাতকে কখোনোই কেউ বিশ্বাস করত না।

তাঁর মাত্র একটা কথায় মানুষ তাঁর উপর ঈমান এনেছে– এর একটাই কারণ। লোকে তাকে বিশ্বাস করতো। তাই তাঁর কথা আর দশজনের কথার মতো ফেলনা ছিল না। তবুও রাসূলুল্লাহর দাওয়াতি জীবনের প্রথম অনেকগুলো বছরে খুব অল্পসংখ্যক লোকই ইসলাম গ্রহণ করেছে।

কেননা অনেকের মনেই ছিল নির্যাতিত হবার ভয়। মুসলিম হওয়া মানেই সে যুগে অত্যাচারিত, নির্যাতিত হওয়া। আর অনেকে ক্ষমতার আসনে টিকে থাকার জন্যেও ইসলাম পালন করতে রাজি হয় নি। কেননা ইসলাম গ্রহণ এবং সঠিকভাবে পালনের অর্থই হল মিথ্যা ক্ষমতা আর নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়ে এক আল্লাহকে মেনে নেওয়া।

ইহুদি পণ্ডিতেরা তো দিনের আলোর মতো পরিষ্কার বুঝতে পারছিল, ইনিই সত্য নবী! কিন্তু তারা হিংসাতেই তাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তবে তারা সবাই বুঝতে পেরেছিল, উনি (সা) যা বলছেন, সেটাই সত্যি– তিনিই আল্লাহর পাঠানো শেষ রাসূল এবং আখিরাতে সফল হতে চাইলে একমাত্র তাকেই অনুসরণ করতে হবে।


আজকের অবস্থাও অনেকটা একই রকম।

হুজুরদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হলেও, মানুষ আসলে নিজের অন্তরে ঠিকই জানে কোনটা সঠিক, কোনটা করা উচিত। কিন্তু লোকলজ্জা বা কষ্ট করার ভয়ে সেটা মানতে চায় না। ভাবে, “লোকে কী ভাববে! লোকে কী বলবে! না, না, আমি এত কষ্ট করতে পারব না।” অথচ আল্লাহ মানুষের অন্তরের খবর খুব ভালো করেই জানেন। তাঁর কাছ থেকে কি কেউ নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারবে? এই যে আমাদের অন্তরগুলো, এগুলোই রোজ হাশরের ময়দানে আমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে। সেদিনকার জন্য কি আমরা প্রস্তুত?

——
হেদায়েত, অতঃপর 
আনিকা তুবা

জুন ২০, ২০১৯ইং