মুকুন্দ বাবুর ক্ষুধামন্দা

বহুকাল আগের কথা…..
কোন এক গ্রামে বাস করিতেন মুকুন্দ বাবু নামে এক লোক। স্ত্রী-পুত্র লইয়া সুখেই বসবাস করিতেছিলেন আমাদের মুকুন্দ বাবু। অকস্মাৎ তাহার সুখময় জীবনে এক উপদ্রব আসিয়া হানা দিল। সেই উপদ্রবে অতিষ্ঠ হইয়া উঠিলেন মুকুন্দ বাবু। তাহার সকল শান্তি তিরোধান করিল।

পাঠকবৃন্দ জানিতে চাহিবেন না কী সেই উপদ্রব? সবুর করুন, বলিতেছি। সেই উপদ্রবের নাম হইল ক্ষুধামন্দা। ক্ষুধা না লাগার কারণে মুকুন্দবাবু কিছুই খাইতে পারেন না! স্বল্প আহারের ফলে তাহার মুখখানা দিন দিন কেমন মলিন থেকে মলিনতর হইতে লাগিল। তাহার এহেন অবস্থা প্রত্যক্ষ করিয়া মুকুন্দ বাবুর স্ত্রী আর থাকিতে না পারিয়া বলিলেন-

“ওগো, চক্ষুর সুমুখে তোমার এ চেহারা আর দেখিতে পারিতেছি না। তুমি বদ্যি বাড়ি যাও।”

মুকুন্দ বাবু প্রথমটায় সম্মত না হইলেও স্ত্রীর পিড়াপিড়ি আর মাথার দিব্যির কাছে হার মানিতে বাধ্য হইলেন।

এক দিন তিনি বদ্যি বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করিলেন। তাহাদের গ্রাম হইতে বদ্যি বাড়ি প্রায় দু- তিন ক্রোশ পথ। সেই সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটা সুবিধাজনক ছিল না মোটেও। আমাদের মুকুন্দবাবু পায়ে হাঁটিয়া যাত্রা করিলেন। দীর্ঘ পথ চলিতে চলিতে বেলা দ্বিপ্রহর অতিক্রম করিল। হঠাৎ আকাশ মেঘে কালো হইয়া উঠিল। সজোরে বাতাস বহিতে লাগিল।

অবস্থা বেগতিক দেখিয়া মুকুন্দবাবু একটি ঘরে আশ্রয় লইলেন। ঘরটি ছিল এক দরিদ্র লোকের। সে বেচারা মুকুন্দবাবুকে কোথায় বসাইবে তাহা লইয়া অস্থির হইয়া উঠিল।

বেলা গড়াইতে লাগিল। বৃষ্টির বেগও বাড়িতে লাগিল। লোকটি এতক্ষণে জানিতে পারিয়াছে যে, মুকুন্দবাবু ক্ষুধামন্দা হেতু বদ্যি বাড়ি যাইতেছেন। দ্বিপ্রহরে ভোজনের সময় লোকটি অত্যন্ত কাঁচুমাচু করিয়া বলিল-

“মহাশয়, আমি দরিদ্র মানুষ। বাড়িতে খাবার আয়োজন অতি সামান্য। তবু যা হয় দুটো অন্ন মুখে দিন। শুধু মুখে কী করিয়া বিদায় দিই?”

বেশ জোড় করিতেছে দেখিয়া মুকুন্দবাবু বলিলেন-
“এত করিয়া বলিতেছেন যখন তখন নাই বা করি কোন মুখে? তা আনুন….. খাইতে তো পারিব না কিছু। তবুও…. আতিথেয়তা গ্রহণ না করাও তো পাপ। জানিয়া শুনিয়া পাপ করা তো ঠিক হইবে না।”

দরিদ্র লোকটি গামলায় করিয়া অন্ন লইয়া মুকুন্দবাবুর সামনে রাখিয়া ব্যঞ্জন লইতে গেলেন অন্দরমহলে। ডাল লইয়া ফিরিয়া আসিয়া তিনি দেখিলেন অন্নের গামলা শূন্য পড়িয়া রইয়াছে। তিনি মুকুন্দবাবুর সামনে ডাল রাখিয়া পুনরায় অন্ন লইতে গেলেন। অন্ন লইয়া ফিরিয়া দেখেন ডালের বাটি শূন্য। তিনি অন্ন রাখিয়া ডালের বাটি লইয়া অন্দরমহলে যাত্রা করিলেন তাহা পূর্ণ করিয়া আনিতে। ডাল লইয়া তিনি আসিয়া দেখেন অন্নের গামলা শূন্য।

বেচারা দরিদ্র মানুষ লজ্জায় মরিয়া গিয়া পুনরায় অন্ন আনিতে গেলেন অন্দরমহলে। অন্ন লইয়া ফিরিয়া দেখেন ডালের বাটি শূন্য। এমনি করিয়া চলিতে লাগিল। পাঁচ বার ডাল ও অন্ন অদল- বদল করিয়া আনিতে আনিতে অবশেষে মুকুন্দবাবু ক্ষান্ত দিলেন। কারণ, তাহার আবার ক্ষুধামন্দা। ঠিক মত আহার করিতে পারিতেছেন না।

মুকুন্দ বাবুর স্বল্প আহারের নমুনা দেখিয়া সেই দরিদ্র লোকটি বলিল-

“আপনার ক্ষুধামন্দা হইয়াছে, বদ্যির কাছে যাইতেছেন দুঃখজনক বটে। কিন্তু মহাশয়, আমার দুঃখটা অন্য জায়গায়। আমি এতবার ভিতর-বাহির করিলাম কিন্তু ভাত আর ডালকে একটিবারের জন্যও একত্রিত করিতে পারিলাম না! উহাদের মধ্যে সাক্ষাৎ করাইয়া দিতে পারিলে নিজেকে একেবারে ধন্য মনে করিতাম!!”

মুকুন্দ বাবুর ক্ষুধামন্দা
জাকিয়া সিদ্দীকি

অগাস্ট ২২, ২০১৯ইং