লাভস্টোরি

-উম্ম মারঈয়াম

দেখবে না দেখবে না করেও রিয়েকশন লিস্টে ক্লিক করে ফেলেছে মুন। ঠিক যা ভেবেছিল তা-ই! ৬৫ টা লাইকের পাশে একটা লাভ জ্বলজ্বল করছে।

টানা এক সপ্তাহ ধরে এই লাভস্টোরি চলছে। রাশেদের স্টেটাস, ছবি, শেয়ার সবকিছুতে সায়মা সুলতানার লাভ রিয়েকশন।

যতবার চোখে পড়ে, মুনের মাথায় আগুন ধরে যায়। মনে হয় রাশেদের খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে পারলে শান্তি লাগত!

একটা ডিভোর্সি মহিলা নির্লজ্জের মত বাচ্চার বন্ধুর বাবাকে লাভ দিয়ে যাচ্ছে। এই লাভ কি শুধু মুন একা দেখছে! বউয়ের সাথে ঝগড়া করে দেয়া স্টেটাসে লাভ কে দেয় লোকে কি তা দেখে না?

রাগ কমাতে রাত্রির সাথে শেয়ার করেছিল এই যন্ত্রণার কথা। রাত্রি উলটো বলল তোরা হুজুর হুজুরনিরা একটু বেশিই পজেসিভ। সব পোস্টে লাভ দিচ্ছে মানে এই মহিলা লাইক বাটন চিনেই না। এই লাভের কোনো মাহাত্ম্য নেই।
মুন মানতে পারে না। কই মুনের স্টেটাসে তো লাভ দেয় না! লাইকও দেয় না। সিংগেল মাদাররা অনেক ছলাকলায় পারদর্শী হয়। এটাও সেই কেস নিশ্চিত। আর কাউকে না পেয়ে ওর ভাল মানুষ হুজুরটার পিছু নেয়নি তো?

সুদূর ভার্চুয়াল লাভের প্রতিক্রিয়া এসে গড়ালো খাবার টেবিল পর্যন্ত। অয়নকে অনেক আগেই খাইয়ে ঘুম পাড়ানো হয়েছে। এখন দুজনের খাবার পালা। শুরুটা অন্যান্য দিনের মতই ছিল। কিন্তু ঐ যে ভার্চুয়াল লাভের প্রভাব!

তরকারিতে লবণ বেশি হয়েছে কেন এ প্রশ্নের জবাবে সায়মা সুলতানার অপ্রত্যাশিত অনুপ্রবেশ-
“যাও তোমার সায়মা সুলতানার কাছে যাও! কম লবণে পুষ্টিকর তরকারি রেঁধে খাওয়াবে!”

এরপর আর পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে না। ভেতরে ভেতরে চমকে গেলেও ঝগড়ায় রাশেদের গলার তেজ কম ছিল না। মুন কি সেদিনের ফেসবুক আলাপচারিতার কথা জেনে গেছে?

জানলেই কী! রাশেদের নিয়ত তো পরিষ্কার। এই অনবরত লাভ বাণে জর্জরিত হয়েই না রাশেদ সায়মাকে নক করেছিল! মেসেঞ্জারে সালাম দিয়ে একদিনের অপেক্ষা। উনি সীন করেছেন ঠিকই, রিপ্লাই দিলেন একদিন পর।
সালামের উত্তর পাওয়ার সাথে সাথে রাশেদ কীবোর্ডে ঝড় তুলে বলল, “আপু মনে হয় আমার পোস্ট নিয়মিত পড়েন।”

ওপাশ থেকে ধীরে সুস্থে উত্তর এল, “জ্বী ভাই সময় পেলে নিউজফীডে সবার পোস্টই পড়া হয়।”
“আপু, আপনি আমার লেখায় লাইক দিলেই তো পারেন!”

“লাভ দিবেন না” কথাটাকে এর থেকে আর মার্জিতভাবে বলা যায় না। সায়মা আপুর আর কোনো উত্তর নেই।

উনি লাভ দিবেন ঠিকই, কিন্তু ইনবক্সে ভাব দেখাবেন। নাকি ফেসবুকের হালচাল বোঝেন না? এরপর থেকে রাশেদের মনে ভীষণ অস্বস্তি। এই স্ক্রীনশটের যুগে কথাগুলো যদি অন্যের হাতে চলে যায়! কে বুঝবে লাইক চাওয়া মানে লাভ না চাওয়া?

মুনের মুখে সায়মা সুলতানার নাম শুনে রাশেদের রাতের ঘুম হারাম। অনেকক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ শেষে ওর মনে হলো ভুল বোঝাবুঝির অবসান হওয়া দরকার। মুনও ঘুমায়নি। অয়নের ক্লাসমেটের মা সায়মা সুলতানা তার ঘুমেও বাদ সেধেছে।

রাশেদ যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায়ই জানতে চেয়েছিল এই মহিলা কীভাবে ওদের সাংসারিক জীবনে ঢুকে গেল। মুন স্বাভাবিক থাকতে পারল না। এত লাভের পরও এই মহিলা সংসারে ঢুকবে না! বরং রাশেদের নির্লিপ্ততাই বিস্ময়কর। লাভের নোটিফিকেশন কি ও পায় না?

– সায়মা সুলতানা লাভ দিলে আমি কী করতে পারি? আমার কী দোষ?

– ঠিক আছে। তোমার যখন দোষ নেই, তাহলে আমি ঐ মহিলার সাথে কথা বলব। বলে দিব যাতে আর লাভ না দেয়।

– পাগল তুমি! কোনো দরকার নেই কথা বলার!

ব্যস! সন্দেহ কাটাতে গিয়ে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হল। দুজনের রাতের ঘুম ওরা তুলে দিল সায়মা সুলতানার হাতে।

দু:খ কষ্ট অনেকটাই ফেসবুককেন্দ্রিক হয়ে গেছে বলে মুন ঐ মাঝরাতেই বিরাট বক্তৃতা দিল ফেসবুক মঞ্চে। বক্তৃতার বিষয়বস্তু স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্য।

আর রাশেদ ব্যাটম্যানের ছবিটা বদলে শশ্রুমন্ডিত নুরানী চেহারাটা প্রোফাইল পিকচারে ঝুলিয়ে দিল। এটা পুরাতন অস্ত্র। প্রোফাইলে হুজুরের ছবি মুন একেবারেই মানতে পারে না! আজকালকার মেয়েদের উপর বিশ্বাস নেই ওর।

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্যে রাশেদ গা করল না। কিন্তু রাশেদের প্রোফাইল পিকচারে মুন জ্বলে পুড়ে ছাই।

একদিন, দুইদিন, তিনদিন গেল। রাশেদের ছবিতে “তেনার” লাভ নেই। এমনকি কোনো পোস্টেও লাভ নেই।

মুনের হালকা পাতলা রাগ অভিমানে মেশানো সন্দেহ এখন আতংকে রূপ নিয়েছে। এ আতংকে কোনো খাদ নেই। তবে কি গোপনে ভালবাসার আদান প্রদান চলছে?

এখন পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়ার অবস্থাও নেই। রাশেদ সকালে অফিসে গিয়ে রাতে ফেরে। দু’জনের কথা হয় না। মুন সারাদিন ঘরেই থাকে। বাইরে যাওয়া বলতে অয়নকে স্কুল থেকে আনা নেয়া।

ফেরার পথে দূর থেকে কয়েকবার সায়মাকে দেখে অন্তর আত্মায় আগুন ধরে যায় মুনের। পারিবারিক শিক্ষা ভব্যতা সভ্যতা জলাঞ্জলি দিয়ে খুব বলতে ইচ্ছে করে তোর জন্যে আমার সংসারের আজ এ অবস্থা! বলা হয় না। অতটা নিচে নামতে পারবে না। তবে সুযোগ পেলে একদিন কিছু না কিছু একটা বলবেই সে!

সুযোগ আসতে দেরি লাগল না। একদিন অয়নকে নিয়ে ফেরার পথে জায়েদ দৌড়ে এল ওর সামনে। পেছন পেছন তার মা সায়মা সুলতানাও দৌড় দিয়েছে।

“আন্তি আন্তি আমি রাশেদ আংকেলের উপর ভীষম রাগ করেছি।”

মুন স্তম্ভিত। এখন কি এই ক্লাস ওয়ানের বাচ্চাকেও আংকেলের পেছনে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে! অন্য কোনো বাচ্চা হলে ভীষণ শব্দে হেসে কুটিকুটি হয়ে যেত মুন। কিন্তু মা-ছেলের যৌথ প্রযোজনার চক্রান্তে হাসির কিছু নেই।

জায়েদ আবার বলতে শুরু করল, “আংকেলের ব্যাতমেনের ছবিতা ফেসবুকে নেই কেন? আমি ব্যাতম্যান দেখলেই লাভ দেই। দেখলেই লাভ….”
কথা শেষ হওয়ার আগেই ঠাস করে একটা চড়। এলোপাতাড়ি মারের সাথে অসহায় সিংগেল মাদারের কান্না- তুই আবার আমার ফেসবুক ধরেছিস? আবার!

ঘটনার আকস্মিকতায় মুন বরফের মত জমে গেছে। লাভ স্টোরিটা একটা অবুঝ শিশুর একক প্রযোজনা ছিল।

আহারে অবুঝ বাচ্চাটা! আহারে!!

………………………