অসহায়ত্ব 

– বিনতে মামুন

আলমারি থেকে পুরনো কাপড় গোছগাছ করতে গিয়ে বেগুনি ফুলওয়ালা ছোট্ট জামাটা চোখে পড়ল সায়মার। ফাতিমার জন্মের আগ দিয়ে ওর বাবা শখ করে কিনে এনেছিল। জামাটা যেদিন প্রথম বারের মত ফাতিমার গায়ে চড়ানো হয় সেদিনের দৃশ্যটা মনে পরে তার- জামার কাঁধটা খসে পড়ছে আর ঝুলটা পায়ের পাতা থেকে অন্তত এক ইঞ্চি নিচে, তা দেখেই ওর বাবার সে কী উচ্ছাস! সায়মার ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসি ফুটে উঠলো।

আজ জামাটার উপর হাত বুলিয়ে শিহরিত হচ্ছে সায়মা। তার ফাতিমা ছোট ছিল বটে, তাই বলে এত! আসলেই ফাতিমা আল্লাহর ইচ্ছায় বড় হয়ে যাচ্ছে। সায়মা পাশ ফিরে ঘুমন্ত ফাতিমাকে দেখে। গভীর প্রশান্ত চেহারা। সায়মা দু’ আ পড়ে ফু দিয়ে দেয় ফাতিমাকে।

আসলেই ছোট্ট এতটুকুন ছিল সে। তার ঘরময় আলো ছড়িয়ে বেড়ানো টুকটুকে মেয়েটি এইতো কদিন আগেই ছিল বিছানা য় বন্দি। ভাষা বলতে ঐ এক কান্না। সায়মার মনে পড়ে একদিন সলাহ পড়তে গিয়ে খেয়াল ছিল না কতক্ষণ পার হয়ে গেছে। হঠাত গোঙানির শব্দে চমকে উঠে সে। দেখে, তার ছোট্ট মণিটা প্রাকৃতিক কাজ সেরে ওভাবেই মাখামাখি করে পরে আছে। চোখে মুখে আতংকের ছাপ। কোন বিচিত্র কারণে কাঁদতে পারেনি। মাকে দেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। সেদিন আসলেই খুব অসহায় মনে হয়েছিল তার শিশুটিকে।

পৃথিবীর বুকে যারাই এসেছে তাদের সবাইকেই জীবনের এই নাজুক স্তরটি পার করতে হয়। পরিচর্যাকারীর নিরলস পরিশ্রম আর অকৃত্রিম ভালবাসার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠে এক একটি প্রাণ। আলহামদুলিল্লাহ্। এই ভাবনা গুলো আমাদের কতটুকু ভাবায়?

সায়মা আলতো করে মেয়ের ছোট্ট তুলতুলে হাতে চুমু খায়।খেয়াল করে ফাতিমার নখ বড় হয়ে গেছে। যেহেতু ঘুমিয়ে আছে, তাই এখনি কেটে দেয়ার উপযুক্ত সময়। ফাতিমার নখ কাটায় অদ্ভুত ভয়, নখ কাটা নিয়ে রীতিমত হুলুস্থুল বাঁধে।

সায়মা খুব যত্নের সাথে নখ কাটতে থাকে। নখ কাটার সময় তার দাদুর কথা মনে পরে। শেষ বয়সে সে তার দাদুর নখ কেটে দিত। প্রথম যেদিন দাদু তাকে অনুরোধ করেছিলেন নখ কেটে দিতে, সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে সায়মার। দাদুর চোখের কোনে চিকচিক করা পানি আর কাঁপতে থাকা ভরাট কণ্ঠসর সব মনে পরে যায়। দাদুর কথা গুলো কানে বাজে সায়মার, “সারা জীবন নিজের কাম নিজে করছি, নিজের কাপড় নিজে ধুইছি,বেগম সাহেবারে পাকের ঘরে সাহায্য করছি। আর এহন, নিজে বাথরুম সারতে পারিনা, জামার বোতাম লাগাইতে পারিনা, নিজের নখটাও কাটতে পারি নারে দাদু……”।

সায়মার গলায় দলা পাকিয়ে উঠল। হঠাৎ করেই তার মনটা বিষন্ন হয়ে যায় ।এই মুহুর্তে তার স্রষ্টার সান্নিধ্য খুব দরকার।

সায়মা ঠিক করে কিছুক্ষণ কুরআন তিলাওয়াত করে মন টা কে শান্ত করে নেবে। কোন সুরা পড়া যায় ভাবতে ভাবতে পাতা ওল্টাতে থাকে আর কুরআনের একটি আয়াতে চোখ আটকে যায়-

“আল্লাহ- তিনি দূর্বল অবস্থায় তোমাদের সৃষ্টি করেন, অতঃপর দূর্বলতার পর শক্তিদান করেন, এরপর শক্তির পর দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।” (সুরাহ আর-রুম: ৫৪)

সায়মা থমকে যায়। জীবনে প্রথম বারের মত নিজেকে খুব নগন্য, খুব মলিন মনে হতে থাকে। সে কী ই বা ছিল, আর কি হতে যাচ্ছে। সায়মার অবাক লাগে ভাবতে, কী অদ্ভুত দম্ভ আচ্ছন্ন করে রাখে মানব মন কে! মহান স্রষ্টার সামনে অবনত হতে বাধা দেয়।

তীব্র এক অসহায়ত্ব বোধ সায়মাকে কুঁকড়ে দেয়। তার চোখ দুটো আর বাঁধ মানে না।

………………..

#রৌদ্রময়ী_ফ্রাইডেরিমাইন্ডা