আল মু’মিনের দাসী

 পাঁচতালা সিড়ি ভেঙে বাসায় ঢুকতেই ট্যান্ট্রাম শুরু করলো জেরীন। 

-তুমি না বললা দোকান থেকে চকেট কিনে দিবা আ আ আ। কেন দিলা না আ আ আ।
– এহহে মা, একদম মনে ছিল না। বাসার নিচে থাকতেই মনে করলা না কেন।
– লাগবে না। লাগবে না। কিছু লাগবে না আয়ায়ায়া।

সকালে একটা রুটি খেয়ে বেড়িয়েছিল শায়লা, এখন দুপুর। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। বাচ্চাটাকেও খাওয়াতে হবে। ওর ও ক্ষুধা লেগেছে নির্ঘাত। খাবারদাবার গুছাবে নাকি নিচে গিয়ে চকলেট কিনে আনবে ভাবতে ভাবতে বাথরুমে ঢুকলো সে।

বাথরুমের দরজার ছিটকিনি আটকাতে যেয়েই বুক ধড়াস করে উঠলো শায়লার। হাতের আংটিটা নেই। ছোট্ট তিন পাথরের আংটি। অনেক শখ করে কেনা। ঈদের উপহার হিসেবে পাওয়া টাকা জমিয়ে কেনা। সামান্য লুজ হতো হাতে, তাই ডান হাতে পড়তো যেন খেয়াল থাকে। কই হারালো!!

ব্যাগ থেকে চাবি বের করার সময় ব্যাগে পরে যায়নি তো?
বাথরুম থেকে বেড়িয়ে তন্ন তন্ন করে ব্যাগ খোঁজে শায়লা। ওদিকে ব্যাক গ্রাউন্ডে বাজছে কান্নার সুর আ আ আ।

নেই ব্যাগে নেই। আতিপাতি করে খোঁজে সে। সব ঢালে ব্যাগ থেকে। টাকার ব্যাগ, খুচরা কয়েন, এলোমেলো পরে থাকা কলম, চোখে দেয়ার কাজল, চুলের কয়েকটা ব্যান্ড, বাচ্চার একটা ডায়াপার। কোন আংটি নেই।

রিকশা একদম বাসার সামনেই থেমেছে। মানে রাস্তায় পড়েনি। হয় রিকশায়, নয়তো বাসার কোথাও। সিড়িটা একবার দেখলে কেমন হয়?

-মা চলো চকেট কিনে আনি।
লাগবেনা লাগবেনা বলতে বলতে মেয়েও পিছু নেয়।

সিড়িতে নেই। গেটের কাছেও নেই। নেই তো নেই। চকলেট কিনে উপরে উঠে আসে।

হঠাৎ কি ভাবে দুই হাত তুলে দুয়া করে সে।
‘আল্লাহ, খুব সুন্দর ছিল আংটি টা। আপনি আমাকে এতদিন এটা পরতে দিয়েছেন, অনেক শুকরিয়া। এটা খুঁজে পাওয়া যদি আমার জন্য কল্যাণকর হয় তাহলে প্লিজ এটা পাইয়ে দিন। আর যদি এটা হারিয়ে থাকাতেই কল্যাণ থাকে তবে এর বিনিময়ে আমাকে দুনিয়ায় এবং আখিরাতে আরো উত্তম কিছু দিন। আর এই সময়ে আমি যেন মনে মনেও অকৃতজ্ঞের মত কিছু না ভাবি যাতে আপনি নারাজ হন।’

দুয়া টা করেই কেন যেন অনেক হালকা লাগে শায়লার। মেয়েকে গোসল করাতে ঢোকে সে। 
………

পাখির ডাকে চমকে ওঠে শায়লা।
নাহ, কলিংবেল বাজছে। হনুফা আসছে কাজ করতে।

-হনুফা আজকে ঝাড়ুটা একটু যত্ন করে দিও তো আপু, কিছু কাজের জিনিস পাচ্ছিনা। খাট আলমারির নিচে ঢুকে থাকতে পারে।

-আইচ্ছা আফা।

সে নিজেও হনুফার পিছন পিছন ঘুরে।

-টেবিলের নিচে ঝাড়ু দাও হনুফা। খাটের নিচটা আবার দাও। ওকি আলমারির নিচ যে বাদ পরে গেল সোনা।

– দিসি তো আফা।

-আবার দাও আমাকে দেখায়।

পাওয়া গেলনা। ধুর, মেয়েকে ভাত খাওয়াই, খামাখা সময় নষ্ট। 

ঝাড়ু শেষে হনুফা বালতিতে পানি নিয়ে আসে,ঘর মুছবে। শায়লা ভাত মাখায় ডাল দিয়ে মেয়ের জন্য, একটু লেবু চিপে নেয় উপরে। পাখির পেট মেয়ের। দুই লোকমা খেয়েই আর খাবেনা।

-আফা দেখেন তো, এটা কি?
মিটিমিটি হাসছে হনুফা। হাতে একটা আংটি। তিন পাথরের। এঁটো হাত নিয়েই সিজদায় পরে যায় শায়লা।

……..

দুপুরে মেয়েকে ঘুম পাড়াতে যেয়ে শায়লারও চোখ বুজে আসে। মেয়ের ঘুম আসেনা, মা চোখ খুলে রাখতে পারেনা। কত্ত কাজ পরে আছে।

কলিংবেলের শব্দে ধড়মড় করে উঠে বসে শায়লা। মেয়ের ঘুম ভাঙার আগেই দরজা খুলতে হবে। পড়িমরি করে ছুটে দরজা খোলে।

শাহেদ দাঁড়ানো দরজায়।

– আজ এত তাড়াতাড়ি?
– ঘটনা আছে। বসতে দাও আগে।

পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় শায়লা। তিন ঢোকে পানিটা শেষ করে দেয় শাহেদ।

– প্রমোশনের অর্ডার টা দিয়ে দিল শিলু।
– আলহামদুলিল্লাহ!!! বলেই সিজদায় শুকর দেয় শায়লা।

অনেকদিন ধরে এই প্রমোশনের অপেক্ষায় ছিল ওরা।

– তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
-আমার জন্য? কি? কেন?
-আহ প্যাকেট টা খুলেই দেখোনা।

কাপা হাতে প্যাকেট খোলে শায়লা। প্যাকেট টা দেখে মনে হচ্ছে ক্রেস্টের বক্স ভিতরে। প্রমোশোন উপলক্ষে কি ক্রেস্ট দেয় নাকি আজকাল? ক্রেস্ট দিয়ে সারপ্রাইজ দিচ্ছে কেন ভদ্রলোক মনে মনে অবাক হয় সে।

প্যাকেট খুলতেই বের হয় একটা নেকলেস, সোনার।
হতভম্ব হয়ে গেছে সে। দুপুরের দুয়া কবুল করে নিয়েছেন আল মু’মিন। যা চেয়েছিল তা তো দিয়েছেনই সেই সাথে আরো উত্তম উপহার পাঠিয়েছেন। তিনি যে রাজাদের রাজা। তাঁর কাছে হাত পেতে কেউ নিরাশ হয়না।

সিজদায় শুকুর দেয়ার কথাও মনে আসেনা তার এতটাই হতভম্ব হয়ে যায় সে। শুধু মাথায় আসে একটি বাক্য, “আমি তো তোমায় ডেকে কখনো নিরাশ হইনি মালিক।”**

পরিশিষ্ট : নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেছেন, আল্লাহতালা বলেছেন, ‘বান্দা আমার প্রতি যেমন ধারণা রাখে, আমি তার সাথে তেমন আচরণ করি। সে যখন আমাকে স্মরণ করে, আমি তার সংগেই থাকি। সে আমাকে মনে মনে স্মরণ করলে আমিও তাকে আমার মনে মনে স্মরণ করি। সে আমাকে কোন সমাবেশে স্মরণ করলে আমি এর চেয়েও উত্তম সমাবেশে তাকে উল্লেখ করি। আর সে যদি আমার দিকে এক বিঘত এগিয়ে আসে, আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে যাই। সে আমার দিকে হেঁটে এলে, আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।’
বুখারী ও মুসলিম।

** সুরা মারিয়াম, আয়াত ৪

” আল মু’মিনের দাসী”
নূরুন আলা নূর
(১৭ নভেম্বর ২০১৭)